মানবতা লংঘনের রাজনীতির অবসান চাই by মাহমুদুল বাসার

একদল আরেক দলের মন্দ দিকটি অনুকরণ করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল করে তুলছে। আর এটাই এখন আমাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতি এখন পুরোমাত্রায় জনস্বার্থের বিপক্ষে চলে গেছে। রাজনীতি এখন মানুষের কাছে ভয়াবহ আতংকের নাম। দেশে বর্তমানে যেন অঘোষিত গৃহযুদ্ধ চলছে। দেশ মূলত অচল, স্থবির হয়ে পড়েছে। নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নে একমত না হলে যে দেশে লাগাতার হরতাল আসবে, এটা জানা কথা। এটাও অজানা নয় যে, হরতাল এখন আগের মতো অহিংস থাকবে না। তবে এতটা হিংস তার পথ ধরবে, তা দেশের মানুষ ভাবতে পারেনি। রাজনীতির একটি মৌলিক নীতি হচ্ছে ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’। প্রতিপক্ষকে জব্দ করার কৌশল আগে যেমন ছিল এখন আর তেমন নেই। কৌশল পরিবর্তন হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও হয়েছে। পরিবর্তনটা ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে হয়েছে অনেকটাই কালচারাল পদ্ধতিতে। কিন্তু গোটা মধ্যপ্রাচ্যে হয়েছে রক্তাক্ত অগণতান্ত্রিক পথে। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশেও পরিবর্তনের কৌশলটা গণতন্ত্রের প্রক্রিয়ার মধ্যে না থেকে রক্তাক্ত অগণতান্ত্রিক পথ ধরেছে। তাই আমাদের দেশের হরতালের রাজনীতি মানবতা লংঘনের রাজনীতিতে রূপ নিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অভিযোগ তুলেছেন, ১৮ দলীয় জোটের দুই দফায় ১২০ ঘণ্টা হরতালে চরমভাবে মানবাধিকার লংঘন করা হয়েছে। এর জন্য কাকে দায়ী করে মনে সান্ত্বনা পাব? ব্যাপারটা তো সেই তর্কের মতো- ‘ডিম আগে না মুরগি আগে?’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আগেও সংঘাত হয়েছে। এ সরকারের কাঠামো নিয়ে, প্রধান উপদেষ্টা নিয়ে এমনকি উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নিয়েও বিতর্ক, বাকযুদ্ধ, হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও, অবরোধ হয়েছে। খুব সম্ভবত এ কথা সরাসরি বলার অবকাশ নেই যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেয়া হল না বলে বর্তমান সংঘাত লেগেছে। বরং এ কথা বলাই শ্রেয়, বড় দুই দলের মধ্যে সমঝোতা হল না বলে দেশ রক্তাক্ত জনপদে পরিণত হতে চলেছে। অতীতে দুই নেত্রীই যথেষ্ট হেনস্থা হয়েছেন, তারপরও তারা এক জায়গায় বসে নির্বাচনের ফর্মুলা তৈরি করতে পারলেন না। এই না পারার পরিণতি দেশে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ ডেকে আনছে।
এদেশের নাগরিক হিসেবে অনুতাপে মরে যাচ্ছি, আমাদের শিশু-কিশোররা অসুস্থ, জেদাজিদির রাজনীতির নির্মম শিকার হচ্ছে দেখে। ফুলের মতো ফুটন্ত বয়সে তারা জীবন হারাচ্ছে, অন্ধত্বের শিকার হচ্ছে, পঙ্গু হচ্ছে, না হয় অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে। পত্রিকায় শিরোনাম এসেছে, ‘বাড়ি যাওয়া হল না মনিরের’, ‘হরতালে গাজীপুরে অগ্নিদগ্ধ স্কুলছাত্রের মৃত্যু’। কী নিষ্পাপ চেহারা, কী মায়াবী মুখমণ্ডল, টানা টানা চোখ। মাথায় ঘন কালো চুল। হরতালের রাজনীতির শিকার হল। পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে বেড়ে ওঠার আগে এমন একটি সম্ভাবনাময় মানবশিশু অকালে হরতালের আগুনে ঝলসে পুড়ে গেল। এর দায় কে নেবে? এই দোষ কাকে দেব?
গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানার বড়কাঞ্চনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র ছিল মনির হোসেন। বাবা রমজান আলী ছিলেন পেশায় একজন ভ্যানচালক। ১৮ দলীয় জোটের ডাকা ৬০ ঘণ্টা হরতাল চলাকালে সোমবার গাজীপুর চৌরাস্তায় জাতীয় আইন কলেজের পাশে রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয় এই কিশোর। যারা জেএসসি পরীক্ষার্থী তারাও কিশোর। যারা পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষার্থী তারাও মনিরের মতোই অবুঝ শিশু। এদের কে বাঁচাবে?
গাজীপুরের মনির হোসেনের আগে ককটেল হিংস্রতার শিকার হয়েছে তিন শিশু। তাদের অগ্নিদগ্ধ চেহারা জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। সড়ক বিভাজনের মধ্যে লাগানো গাছের ফুল তুলে রাস্তা পার হচ্ছিল আট বছরের শিশু সোহেল মিয়া। এ সময় মোটরসাইকেল আরোহী তিন যুবক এসে কয়েকটি ককটেল নিক্ষেপ করে দ্রুত পালিয়ে যায়। একটি ককটেল বিস্ফোরিত হয় রাস্তায়। এতে শিশুটির হাত-পাসহ শরীর ঝলসে যায়। সোমবার (২৮-১০-১৩) হরতাল চলাকালে সকাল ৭টার দিকে বগুড়া শহরের রেলস্টেশন সংলগ্ন সাতমাথা-তিনমাথা স্টেশন সড়কে এ ঘটনা ঘটে। সোহেলকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সে সেউজগাড়ি রেলবস্তিতে মা-বাবার সঙ্গে থাকত। তার বাবা শহীদুল ইসলাম একজন রিকশাচালক। শুধু সোহেল নয়, সেদিন হরতাল সমর্থকদের ককটেলে আহত হয়েছে বগুড়ার আরও দুই পথশিশু। সকাল ১০টার দিকে শহরে স্টেশন ক্লাব সংলগ্ন ঝাই-জঙ্গলে কাগজ কুড়াচ্ছিল ৭ বছরের শিশু রনি ও ৮ বছরের শিশু মিল্টন। সেখানে পড়েছিল অবিস্ফোরিত একটি ককটেল। কৌতূহলবশত লাল কাগজ মোড়ানো ককটেল দুটি একজন হাতে নিলে তা বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এতে স্পি­ন্টারের আঘাতে মারাত্মক আহত হয় পথশিশু দুটি। স্থানীয় লোকজন উদ্ধার করে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে ফেনী যাচ্ছিল লাইফ লাইন নামের একটি অ্যাম্বুলেন্স। রোববার (২৭.১০.১৩) রাত ৩টার দিকে সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড এলাকায় পৌঁছলে গাড়ি লক্ষ্য করে ছুটে আসে পাথর। এতে অ্যাম্বুলেন্সটির দুটি কাচ ভেঙে যায়। অ্যাম্বুলেন্স চালক মাহবুব বলেন, ‘ওই অবস্থায় গাড়িটি নিয়ে দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করি।’ ৬০ ঘণ্টার হরতাল চলাকালে সোমবার দুপুর পর্যন্ত এভাবে চারটি অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখা হয়। এ অবস্থায় চাহিদা থাকা সত্ত্বেও চালকরা ভয়ে অ্যাম্বুলেন্স চালাচ্ছিল না। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন রোগী ও স্বজনরা।
এভাবে প্রায় সারা দেশে রোগী বহনকারী গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স আক্রান্ত হচ্ছে। লাশ বহনকারী রেড সিগন্যাল লাগানো গাড়িকেও রেহাই দেয়া হচ্ছে না। অর্থাৎ রাজনীতির উত্তেজনা মানবতা উপড়ে ফেলছে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হরতালকারীরা পত্রিকাবাহী গাড়িতে ককটেল নিক্ষেপ করছে, তাতে সাংবাদিকরা মারাত্মক আহত হচ্ছেন। এর মধ্যে পত্রিকায় আমরা দেখেছি, একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা অফিসে এবং কয়েকটি টিভি চ্যানেল অফিসে ককটেল-বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। বিকট আওয়াজে তা বিস্ফোরিতও হয়েছে।
হরতালে কাজে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলোর। তাদের ওপরই পড়ছে হরতালের আগুন আর ককটেল। পরিবারের প্রধান রোজগেরে লোকগুলো আহত হওয়ায় একদিকে কাজ বন্ধ, আয় বন্ধ, অন্যদিকে তাদের চিকিৎসা খরচ দিতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি আর্থিক কষ্টও তাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। রোববার রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর শাজাহানপুরে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ছুড়ে দেয়া পেট্রল বোমায় ঝলসে যায় চালক আইয়ুব আলীর বুকের নিচ থেকে তলপেট পর্যন্ত ও বাঁ পা।
পুড়ে যায় মুখমণ্ডলও। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার শরীরের ১০ শতাংশ পুড়ে গেছে। সুস্থ হতে অন্তত দু’সপ্তাহ সময় লাগবে। এখন দরিদ্র, খেটে খাওয়া আইয়ুব আলীর সংসার কে চালাবে? হরতালকারীদের ছুড়ে মারা ককটেলে ৪৫ বছরের রংমিস্ত্রি আবদুর রহমান বাঁ চোখ হারিয়েছেন।
তাকে ভর্তি করা হয়েছে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে। বাঁ চোখে ব্যান্ডেজ নিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন তিনি। উদাহরণ আর বাড়াতে চাই না। পত্রিকার পাতাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেছি, অসহায়, গরিব, নুন আনতে পান্তা ফুরানো মানুষেরা; নিু আয়ের পেশাজীবী-শ্রমজীবী এবং অসহায় শিশু-কিশোররা ককটেল বিস্ফোরণের শিকার হচ্ছে। এতে মায়ের কোল খালি হচ্ছে। দরিদ্র সংসারের রোজগার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পেটে লাথি পড়ছে।
এই মানবতা লংঘনের রাজনীতি কবে শেষ হবে?
মাহমুদুল বাসার : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক, গবেষক

No comments

Powered by Blogger.