বর্জনে নির্বাচন ঠেকে না, কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা?

বিরোধী দল বা জোট নির্বাচন বর্জন করলে যে সব সময় নির্বাচন ঠেকে থাকে এমন নয়। বর্জন বা বয়কটের নির্বাচনের উদাহরণ আছে সাম্প্রতিক দুনিয়ায়। এই সেদিন, ৬ নভেম্বর মধ্য এশীয় দেশ তাজিকিস্তানে হয়ে গেল এ ধরনের একটি নির্বাচন। ১৯ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় গণপরিষদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে নেপালের মাওবাদীরা। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়ার বিরোধী জোটও ২৩ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। ছিয়ানব্বইয়ের ১৫ ফেব্রুয়ারি একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে বাংলাদেশ। আবার নির্বাচন আসছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের কাছে মনোনয়নপত্র বিক্রিও শুরু করে দিয়েছে। এসব কিছুতেই নেই বিরোধী দল বিএনপি ও তার জোট। নেই নির্বাচন নিয়ে সমঝোতার কোনো লক্ষণও। আরেকটি বর্জনের নির্বাচনের দিকেই কি এগোচ্ছে বাংলাদেশ? নব্বইয়ের পর নির্বাচন বর্জনের বড় ধরনের ঘটনা ঘটেছে এমন কয়েকটি দেশ হচ্ছে: ঘানা, টোগো, মালি, আইভরি কোস্ট, গাম্বিয়া, গায়না ও ভেনেজুয়েলা। আর নব্বইয়ে গণতন্ত্রের পথে নতুন যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ। এই দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয়বারের মতো নাম উঠতে যাচ্ছে বাংলাদেশের? গণতন্ত্রের বিবেচনায় তাজিকিস্তান, মৌরিতানিয়া বা নেপালের কাতারে ফেলা যাবে না বাংলাদেশকে। তাজিকিস্তানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় আছেন ২০ বছর ধরে।
আন্তর্জাতিকভাবে তিনি পরিচিত একজন একনায়ক হিসেবে। আর মৌরিতানিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট মোহামেদ আবদেল আজিজ ২০০৮ সালে ক্ষমতা দখল করেছেন অভ্যুত্থান করে। বিরোধী জোট কখনো তাঁকে মেনে নেয়নি, বিবেচনা করে স্বৈরাচার হিসেবে। বিরোধী জোট কো-অর্ডিনেশন অব ডেমোক্রেটিক অপজিশন (সিওডি) নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে ২০০৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজতন্ত্র বিলোপের পর গণতন্ত্রের পথে মাত্র যাত্রা শুরু করেছে নেপাল। বর্জনের নির্বাচনগুলোর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলে না। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আমরা এই দেশগুলোর চেয়ে যতই উচ্চমানের ভাবি, সামনের নির্বাচনটি যদি একটি বয়কটের নির্বাচন হয়, তবে এই দেশগুলোর নামের পাশেই স্থান পাবে বাংলাদেশের নাম। ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দল ছাড়া একটি নির্বাচন করেছিল বিএনপি। তখন বিএনপির বাইরে নির্বাচনে অংশ নেওয়া যে দলটির নাম নানা কারণে পরিচিত ছিল, সেটি ফ্রিডম পার্টি। ৩০০ আসনের মধ্যে ৪৮টিতে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচন করা সম্ভব হয়েছিল ২৫২টি আসনে আর নির্বাচন কমিশন গেজেট আকারে ফল প্রকাশ করতে পেরেছিল ২৪২টি আসনের।
এসব তথ্য-উপাত্তের মধ্যে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষণ প্রকাশ পায়নি। সেই নির্বাচনের পর বিএনপি যে সরকার গঠন করেছিল, তার মেয়াদ ছিল দেড় মাস। ইতিহাসে কোনো কিছুরই হুবহু পুনরাবৃত্তি ঘটে না। এবারের নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত যদি বিএনপি অংশ না নেয়, তবে সেটাও কোনোভাবেই ’৯৬ সালের নির্বাচনের অবিকল কিছু হবে না। সেই নির্বাচনের শিক্ষা বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কাজে লাগাবে। বর্জনের নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আজকের দুনিয়ায় নির্বাচন কোন দেশের শুধু অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়, এক সঙ্গে আন্তর্জাতিকও। আর আমাদের মতো দেশগুলোর নির্বাচনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটা ভূমিকা থাকে। তারা পর্যবেক্ষণ করে কী পেল, তার ওপর ভিত্তি করে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে কি না, তার একধরনের সনদ পাওয়া যায়। সম্ভবত সেই বিবেচনা থেকেই জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গে গত সেপ্টেম্বরে বৈঠকের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নির্বাচনে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক পাঠানোর অনুরোধ করেছেন। সদস্যদেশগুলোর নির্বাচনে সহায়তা করার জন্য জাতিসংঘের একটি বিভাগ রয়েছে।
রাজনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অধীনে কাজ করে ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স বিভাগ। গত দুই বছরে ৫৯টি সদস্যদেশে নির্বাচনী সহায়তা দিয়েছে জাতিসংঘ। তবে বিশ্বে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘ যে ভূমিকা পালন করে, এর কোনো নির্দিষ্ট বা সব দেশের জন্য একইভাবে প্রযোজ্য মডেল নেই। বিষয়টি অনেকটা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থার মতো। সহায়তার বিষয়টিকে সাধারণভাবে তিনটি ভাগে করা আছে; ১. কারিগরি সহায়তা, ২. নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও অন্যান্য মূল্যায়ন ৩. নির্বাচন তদারকি ও নির্বাচন অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রথম ধরনের সহায়তার খুব প্রয়োজন নেই। কারণ, ১৯৯০ সালের পর থেকে ধারাবাহিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, ফলে কারিগরি ক্ষেত্রে অনেকটাই সক্ষমতা অর্জিত হয়েছে। আর তৃতীয় ধরনের সহায়তাটি অর্থাৎ নির্বাচন তদারকি বা অনুষ্ঠানের কাজটি শুধু বিশেষ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ করে থাকে। ১৯৯২-১৯৯৩ সালে পুরো দায়িত্ব নিয়ে কম্বোডিয়ার নির্বাচন করেছিল সংস্থাটি। ২০০৪-২০০৫ সালে আফগানিস্তান বা ২০০৫ সালে ইরাকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ কিছু সদস্যদেশের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কাজটি সেরেছিল। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে পর্যবেক্ষক পাঠানোর যে অনুরোধ করেছেন, সেটা দ্বিতীয়টি অর্থাৎ ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও অন্যান্য মূল্যায়ন’-এর মধ্যেই পড়ার কথা।
জাতিসংঘের রাজনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ওয়েবসাইট বলছে, কোনো দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে মূল্যায়ন করে তাকে বৈধতা দেওয়ার কাজটি একটি রাজনৈতিক বিষয়। ফলে এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বা সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্তের প্রয়োজন পড়ে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার কুশীলবদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থাহীনতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছলেই শুধু এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যায়। এর বাইরে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছোট বিশেষজ্ঞ পর্যবেক্ষক দলকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানো হয় এবং সেসব দল মহাসচিবের কাছে অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন দিয়ে থাকে। শেখ হাসিনার পর্যবেক্ষক পাঠানোর অনুরোধের মাত্রাটি আসলে কী? এটা কি শুধু ছোট ‘বিশেষজ্ঞ পর্যবেক্ষক দল’ পাঠানো, নাকি জাতিসংঘের কাছ থেকে নির্বাচনের ব্যাপারে সার্টিফিকেট চাওয়া? যদি জাতিসংঘের কাছ থেকে নির্বাচনের ব্যাপারে ম্যান্ডেট প্রত্যাশা করা হয়, তবে নিরাপত্তা পরিষদ বা সাধারণ পরিষদের জটিল সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এগোতে হবে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ‘কুশীলবদের পারস্পরিক আস্থাহীনতা’ দূর করার প্রক্রিয়ায়ও জাতিসংঘকে ভূমিকা পালন করতে হবে। তবে জাতিসংঘের ছোট ‘বিশেষজ্ঞ পর্যবেক্ষক’ দলের কথা বলা হয়ে থাকলে ভিন্ন কথা।ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের আওতাও এখন ব্যাপক। নির্বাচন-পূর্ব, নির্বাচনের দিন ও নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি সবই বিবেচনায় নেওয়া হয়। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশন (ইউ-ইওএম) পাঠানো হবে কি হবে না, সেটা নির্ভর করে আগাম একটি মিশনের (এক্সপ্লোরেটরি মিশন) রিপোর্টের ওপর। ইউ-ইওএম পাঠানো ‘কার্যকর’ হবে কি না, সেটাই তারা বিবেচনা করে দেখে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সব দলের অংশগ্রহণ, বিশেষ করে খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে সেই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ইইউর কাছে কতটুকু ‘কার্যকর’ হিসেবে বিবেচিত হবে?
এক্সপ্লোরেটরি মিশন কি প্রধান বিরোধী দলবিহীন কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার সুপারিশ করবে? গণতন্ত্রের সঙ্গে যেমন নির্বাচনের সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়টি। কোনো দল নির্বাচন বর্জন করলে জনগণের প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ কমে আসে। আর বাংলাদেশের মতো দেশে নির্বাচন বর্জন মানে তো শুধু শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন থেকে সরে আসা নয়। নেপালের মাওবাদীরা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও দেশজুড়েই এখন ছড়িয়ে পড়েছে সংঘাত ও সহিংসতা। বাংলাদেশে তো সংঘাতের পর্ব এখন থেকেই চলছে। শেষ পর্যন্ত বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করলে পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাবে। এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আগ্রহী না হয়, তবে শুরুতেই আন্তর্জাতিকভাবে এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। আর বিএনপি ও ১৮ দলের সমর্থকেরা যদি ভোট দিতে না যায়, তবে দেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ নির্বাচনের বাইরে থাকবে। মানে এই ভোটারদের কাছে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। আগেই বলেছি, কোনো দলের নির্বাচন বর্জনে হয়তো নির্বাচন ঠেকে না, প্রশ্নটি গ্রহণযোগ্যতার। কোনো নির্বাচন যদি ‘গ্রহণযোগ্য’ না হয়, তবে তাকে ‘নির্বাচন’ বলার সুযোগ থাকবে কি?
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.