সংকটে, অগ্রযাত্রায় ইউনেস্কো by কাজী ফারুক আহমেদ

গতকাল ছিল জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা ইউনেস্কোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এদিনই জানা গেল, বাংলাদেশ এ সংস্থার নির্বাহী বোর্ডের সদস্য পুনঃনির্বাচিত হয়েছে। নতুন রূপে পুরনো সংকটের আবর্তে ৬৯ বছরে পা দিয়েছে এ সংস্থা। ইতিমধ্যে বকেয়া চাঁদা পরিশোধ না করায় ৮ নভেম্বর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল এ বিশ্ব সংস্থার ভোটাধিকার হারিয়েছে। ২০১১ সালে ফিলিস্তিনকে ইউনেস্কোর পূর্ণ সদস্যপদ দেয়ার পর থেকে ওই দুটি দেশ চাঁদা বন্ধ করে দেয়। ইউনেস্কোর বিধান অনুযায়ী ৮ নভেম্বর সকালের মধ্যেই বকেয়া সব চাঁদা পরিশোধ করার কথা ছিল। না পারলে কেন পারছে না তা জানালেও চলত। কিন্তু দেশ দুটি এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় তাদের ভোটাধিকার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যায়। উল্লেখ্য, ইউনেস্কোর মোট বাজেটের ২২ শতাংশ পাওয়া যেত যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কিন্তু তা না পাওয়ায় সংস্থাটির বাজেটে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। চাকরি হারানোর আশংকা দেখা দিয়েছে ৩০০ লোকের। আর্থিক সংকট মোকাবেলায় মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা এর মধ্যে সাড়ে ৭ কোটি ডলারের তহবিল সংগ্রহ করেছেন। তবে তা দিয়ে পুরনো কর্মসূচিগুলো কতটুকু ভালোভাবে চালানো যাবে, জরুরি কর্মসূচি নেয়া যাবে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ১৬ নভেম্বর ইউনেস্কোর গঠনতন্ত্র স্বাক্ষরের দিন। ১৯৪৫ সালের এদিনে গঠনতন্ত্র লন্ডনে স্বাক্ষরিত হওয়ার পরের বছর ৪ নভেম্বর ২০টি দেশের অনুমোদনের মধ্য দিয়ে এর কার্যকারিতা শুরু হয়। বর্তমানে ইউনেস্কোর সদস্য রাষ্ট্র ১৯৫টি। ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ইউনেস্কোর গঠনতন্ত্র শুরু হয়েছে কবি, কূটনীতিক, মার্কিন কংগ্রেসের গ্রন্থাগারিক আর্চবল ম্যাকসেলের বিখ্যাত বাক্য দিয়ে : যেহেতু মানুষের মনেই যুদ্ধের সূত্রপাত, সেজন্য সেখানেই যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ রচনা করতে হবে। ২১ ফ্রেব্র“য়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের কারণে ইউনেস্কো বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। একই সঙ্গে বিশ্বের ৬ হাজার ভাষাকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষায় ভূমিকা পালনের জন্য ইউনেস্কোর নাম উচ্চারিত হয় বিশ্বব্যাপী।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ঐতিহ্য, প্রযুক্তি নিয়ে বছরের পর বছর কাজ করে যাওয়া ইউনেস্কো বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত। ১৯৬৬ সালে প্যারিসে ইউনেস্কোর উদ্যোগে বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতিনিধিদের সম্মেলনে শিক্ষকদের অধিকার, করণীয় ও মর্যাদা সংক্রান্ত সুপারিশমালা গৃহীত হওয়া এর একটা বড় কারণ। তবে ১৪৫ অনুচ্ছেদবিশিষ্ট ওই সুপারিশমালা ছিল নার্সারি, কিন্ডারগার্টেন, প্রাথমিক, কারিগরি, বৃত্তিমূলক, চারুকলাসহ স্কুলে পাঠদানকারী শিক্ষকদের জন্য। মাধ্যমিক (উচ্চ)-পরবর্তী স্তরগুলোর সুস্পষ্ট উল্লেখ সেখানে ছিল না। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালের ১৫-১৮ সেপ্টেম্বর প্যারিসে ইউনেস্কোর এক বিশেষ অধিবেশনে উচ্চতর স্তরে শিক্ষা দানকারী শিক্ষকদের মর্যাদা সংক্রান্ত সুপারিশ প্রণীত হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ১৯৬৬ ও ১৯৯৭ সালের উভয় সুপারিশমালা যুগ্মভাবে শিক্ষকদের মর্যাদা সনদ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং বিশ্বব্যাপী সর্বস্তরের শিক্ষক ওই সনদের স্মারক দিবস হিসেবে প্রতিবছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করবেন।
বাংলাদেশে ইউনেস্কো শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে আসছে। ২০০৮ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে সক্ষমতা সম্প্রসারণ, ২০০৯ সালে একীভূত শিক্ষা কার্যক্রম, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা উন্নয়নসহ বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রমে নানা কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। বাগেরহাটে ষাট গম্বুজ মসজিদ, পাহাড়পুরে পুরাকীর্তি সংরক্ষণ, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন ঘিরে বিশেষ কার্যক্রম, শিক্ষাক্রমে ডিজিটাল উপাদান সংযোজনে ইউনেস্কোর ভূমিকা প্রশংসার দাবি রাখে। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ মুদ্রণ, প্রস্তাবিত শিক্ষা আইন প্রণয়নে ইউনেস্কো সহায়তার হাত বাড়িয়েছে। শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা সনদ হিসেবে পরিচিত ১৯৬৬ ও ১৯৯৭ সালের দুই সুপারিশমালার মধ্যে প্রথমটি ইউনেস্কোর ঢাকা অফিস থেকে বাংলায় অনুবাদ করে ২০০৮ সালে প্রকাশ করা হয়। সর্বশেষ ১৯৯৭ সালের সুপারিশটিও বাংলায় ছাপা হয়েছে এ বছর। ডেরেক ইলিয়াস বাংলাদেশে ইউনেস্কোর প্রধান থাকাকালে বিশ্ব শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে আমি এ প্রস্তাব রাখি। সম্প্রতি ইউনেস্কো ঢাকা অফিস মার্ক ব্রোর ছায়া শিক্ষা ব্যবস্থার মোকাবেলায় বইটির বাংলা অনুবাদও প্রকাশ করেছে। সমীর রঞ্জন নাথ অনূদিত বইটিতে উল্লেখ করা হয়, গৃহশিক্ষকতা সাধারণভাবে ন্যায়নীতিহীনভাবে সামাজিক অসমতা সৃষ্টি করেছে। আশা করা যায়, আমাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটও বিশ্ব সংস্থাটির দ্বিতীয় ক্যাটাগরি মর্যাদাভুক্ত হবে। তবে প্রায় দুবছর ধরে ইউনেস্কো ঢাকা অফিসে শীর্ষ কর্মকর্তার অনুপস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি প্রশ্ন উঠেছে। এ ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
বর্তমানে ইউনেস্কো অর্থ সংকটে পড়েছে এ কথা সত্য। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের চাঁদা পরিশোধ না করা এর জন্য অনেকটা দায়ী। তবে লক্ষণীয়, অতীতে নীতিগত মতবিরোধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে যেভাবে ইউনেস্কো থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে দেখা গেছে, সম্প্রতিকালে তা হয়নি। আশা করা যায়, ইরানের প্রতি ক্রমাগত নমনীয়তার মতো ইউনেস্কোর ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে পরিবর্তন আসবে। কাক্সিক্ষত এ পরিবর্তনের অপেক্ষায় রয়েছে বিশ্বের সব শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ও শিক্ষানুরাগী মানুষ। এ পরিবর্তন যত দ্রুত হয় ততই মঙ্গল।
অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ : ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান

No comments

Powered by Blogger.