বিএনপির নেতাদের রিমান্ড

বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা সাধারণভাবে রিমান্ডসর্বস্ব, যা মানবাধিকারের পরিপন্থী। এমনকি ২০০৩ সালে হাইকোর্ট বিভাগের একটি রায়ে রিমান্ড প্রদানে যেসব বাধানিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। হাইকোর্ট বলেছিলেন, অনধিক তিন দিনের বেশি রিমান্ড দেওয়া যাবে না। কিন্তু বিএনপির নেতাদের দুটি মামলায় প্রত্যেককে আট দিন করে রিমান্ড দেওয়া হয়েছে। হাইকোর্ট বলেছিলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কারাগারে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। সে জন্য কাচের দেয়ালবিশিষ্ট বিশেষ কক্ষ লাগবে। সেখানে আত্মীয় বা আইনজীবীর দৃষ্টিসীমায় জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশনাও ছিল। কিন্তু সেই কক্ষ তৈরি করা হয়নি। পরিহাস হচ্ছে, তৎকালীন বিএনপি সরকার ওই রায় মেনে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেনস্তা তারাও কম করেনি। হাইকোর্টের ওই রায় মানলে নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষা পেত। কিন্তু সেটা মেনে চলাকে তারা তাদের অপশাসনের পথে বাধা মনে করেছিল।
এখন নিজেরাই সেই ফাঁদে পড়েছে। জ্যেষ্ঠ নেতাদের রিমান্ড বলে বিএনপি এখন বড় গলায় শোর তুলেছে। তারা ক্ষমতায় এলেও পরিস্থিতির উন্নতি হবে, সেই ভরসা কম। আদালতকে উচ্চ আদালতের ওই নির্দেশনা এবারে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বিএনপির আইনজীবীরা। তাতে প্রতিকার মেলেনি। এটা তাই আমাদের অবাক করেছে। কারণ, হাইকোর্টের রায়ের পরে কতগুলো অগ্রগতি ঘটেছে। নিম্ন আদালত যা অস্বীকার করতে পারেন না। প্রথমত, ২০০৩ সালের পরে বিচার বিভাগ পৃথক হয়েছে। সংবিধানমতে, হাইকোর্টের রায় নিম্ন আদালতের জন্য বাধ্যতামূলক। যদিও ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগ সরকারের দায়ের করা লিভ পিটিশন মঞ্জুর করেছেন। কিন্তু কোনো স্থগিতাদেশ দেননি। শুনানি বা নিষ্পত্তিও হয়নি। ২০১২ সালে আপিল বিভাগ এক রায়ে বলেছেন, যে ক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে হাইকোর্টের কোনো রায়ের ওপর আপিল বিভাগ স্থগিতাদেশ দেবেন না, সে ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা থাকবে।
আমরা এদিকে আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের আশু প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ আশা করছি। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার এবং তাঁকে হাজতে রেখে ‘জিজ্ঞাসাবাদ’ করার মাধ্যমেই পুলিশ প্রধানত অপরাধ সংঘটন-সংক্রান্ত তথ্যাবলি পেয়ে থাকে। অথচ কোনো সভ্য দেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় এ ধরনের নির্ভরশীলতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। আইনের রাজনৈতিক অপপ্রয়োগের কারণে গোটা পুলিশি ব্যবস্থার নীতি-নৈতিকতা যথেষ্ট নড়বড়ে হয়ে আছে। তথাকথিত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি-নির্ভর একটি অনুসন্ধান ও তদন্তব্যবস্থা কার্যত বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি ছাড়া কিছু নয়। বিএনপির পাঁচ নেতাকে হয়তো ডিবি অফিসের তথাকথিত হাজতখানায় রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এটা আদালত অবমাননার শামিল। আর জিজ্ঞাসাবাদে কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করা কেবল ওই রায়েরই নয়, সংবিধানেরও লঙ্ঘন। সংবিধান নির্দিষ্টভাবে কারও নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য আদায় এবং অভিযুক্তের সঙ্গে লাঞ্ছনাকর আচরণ নিষিদ্ধ করেছে। রিমান্ডে এই দুটোই ঘটে বলে অভিযোগ আছে।

No comments

Powered by Blogger.