পাকিস্তানে শান্তি কত দূর?

এ মাসের ২ তারিখ থেকে পাকিস্তানি তালেবানের সঙ্গে নওয়াজ শরিফের সরকারের শান্তি আলোচনা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঠিক তার আগের দিনই মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনী সিআইএর ড্রোন হামলায় তালেবানের প্রধান নেতা হাকিমুল্লাহ মেহসুদ চার সহযোগীসহ নিহত হলে সব ভেস্তে গেছে। তালেবান তার প্রধান নেতাকে হারিয়ে ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়েছে এবং পাকিস্তানের সরকার ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে নতুন করে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। পাকিস্তানজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মধ্যে সতর্কতা বাড়ানো হয়েছে। তারপর, গত সোমবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলি খান পাকিস্তানের পার্লামেন্টে বললেন, তালেবানের সঙ্গে শান্তি আলোচনা আপাতত হচ্ছে না। কারণ, মার্কিন বাহিনী ড্রোন হামলা চালিয়ে শান্তি প্রক্রিয়াকে ‘সাবোটাজ’ করেছে। প্রতিরক্ষা উৎপাদনবিষয়ক মন্ত্রী রানা তানভীর হুসাইন বলেছেন, আলোচনা এখন হবে না, কারণ তালেবান বেশ খেপে আছে। তারা ঠান্ডা হওয়ার পর আলোচনা প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু করা হবে বলেও মন্তব্য করেছেন এই মন্ত্রী। পাকিস্তানি তালেবান নামে পরিচিত সংগঠনটি পাকিস্তানের কয়েকটি ইসলামপন্থী জঙ্গি ও জিহাদি গোষ্ঠীর এক মিলিত প্ল্যাটফর্ম বা মোর্চা। আনুষ্ঠানিকভাবে ‘তেহরিক-ই-তালিবান, পাকিস্তান’ নামে তালিকাভুক্ত এই সংগঠনকে অনেক আগেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
কিন্তু তাতে সুফল ফলেনি, বরং তালেবানের সন্ত্রাসী তৎপরতার চাপ ও প্রভাব ক্রমশ এতটাই বেড়েছে যে সরকারের নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হয়েছে, তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় বসে কোনো একটা সমঝোতামূলক বন্দোবস্তে পৌঁছা যায় কি না। পাকিস্তানি তালেবানের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর; তারা পাকিস্তানের সংবিধান মানে না, গোটা পাকিস্তানে শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। তাই তারা আপাতত চাইছে পাকিস্তানের সাতটি উপজাতীয় অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য নিরঙ্কুশ করতে। সরকারের প্রতি তাদের দাবি, উপজাতীয় অঞ্চলগুলো থেকে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সরিয়ে নিতে হবে। এ ছাড়া তারা যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলা বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ দিয়ে আসছে। কিন্তু নওয়াজ শরিফ যদিও নির্বাচনের আগে তালেবানদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে ড্রোন হামলা বন্ধ করবেন, কিন্তু বাস্তবে সেটা তাঁর পক্ষে করা সম্ভব নয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদবিরোধী তৎপরতার সবচেয়ে সফল অংশ হচ্ছে ড্রোন হামলা। তারা আফগানিস্তান থেকে আল-কায়েদাকে প্রায় পুরোটাই ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে ড্রোন হামলা চালিয়ে। পাকিস্তানেও তালেবান জঙ্গিদের ওপর ড্রোন হামলা চালানো তাদের নিয়মিত কাজ। ড্রোনের সাহায্যে তারা ইয়েমেন, সুদান ও সোমালিয়ায়ও প্রচুরসংখ্যক ইসলামি জঙ্গিকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে।
সুতরাং এই মোক্ষম অস্ত্র তারা ত্যাগ করবে এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। পাকিস্তানে সিআইএর ড্রোন হামলার বিরুদ্ধে জনমত অত্যন্ত প্রবল। সরকারও প্রতিটি ড্রোন হামলার পরে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন কেউ নেই, যাকে ড্রোন হামলার সমর্থনে প্রকাশ্যে কিছু বলতে শোনা গেছে। সরকার ও সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করে চালকবিহীন বিমান থেকে মিসাইল ও গোলা নিক্ষেপ করে পাকিস্তানি নাগরিকদের হত্যা করার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করছে। এটাই তাদের প্রধান আপত্তির বিষয়। অন্যদিকে পাকিস্তানের জনসাধারণের একটা বড় অংশের আপত্তি হলো, ড্রোন হামলা চালিয়ে শুধু যে তালেবানসহ ইসলামপন্থী জঙ্গিদেরই হত্যা করা হচ্ছে তা তো নয়, একই সঙ্গে প্রচুরসংখ্যক বেসামরিক মানুষও নিহত হচ্ছে। এমন যদি হতো যে সিআইয়ে ড্রোন হামলা চালিয়ে শুধু জঙ্গিদেরই হত্যা করছে, তাহলে সাধারণ মানুষের তেমন আপত্তি ছিল না। দৈনিক ডন এমন কথাই লিখেছে: তালেবান প্রধান হাকিমুল্লাহ মেহসুদ নিহত হওয়ার পর সারা পাকিস্তানের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। কিন্তু ড্রোন হামলায় নিরীহ সাধারণ মানুষের হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে প্রচুর।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের প্রশাসন দাবি করে যে ড্রোন হামলায় বেসামরিক নাগরিকদের হতাহত হওয়ার ঘটনা যত বেশি বলে মনে করা হয়, আসলে ততটা নয়। পাকিস্তান সম্প্রতি বলেছে, ২০০৪ সাল থেকে এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত পাকিস্তানে সিআইএর ড্রোন হামলায় মোট যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার মধ্যে বেসামরিক নাগরিক ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টের দেওয়া এক হিসাব অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সিআইএ পাকিস্তানে ড্রোন হামলা চালিয়েছে মোট ৩৭৮ বার। এতে মোট নিহত হয়েছে তিন হাজার ৬৪৪ জন মানুষ। তাদের মধ্যে বেসামরিক নাগরিক ৯৪৮ জন, এর মধ্যে ২০০ জন শিশু। আহত প্রায় দেড় হাজার। মার্কিন প্রশাসন ড্রোন হামলায় নিহত বেসামরিক নাগরিকদের সংখ্যার বিষয়ে একমত না হলেও স্বীকার করে যে জঙ্গিদের পাশাপাশি বেসামরিক মানুষ, বিশেষ করে নারী-শিশুদেরও মৃত্যু হয়েছে। বারাক ওবামার ড্রোন কর্মসূচির বিরাট সাফল্যের বিপরীতে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এটাই। কিন্তু তাই বলে, জনমতের চাপে, এমনকি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার তীব্র সমালোচনার চাপে ওবামা ড্রোন কর্মসূচি ত্যাগ করবেন, এমন কোনো সম্ভাবনাই নেই। আফগানিস্তান, ইয়েমেন, সোমালিয়ার মতো পাকিস্তানেও তালেবানসহ ইসলামি জঙ্গি গ্রুপগুলোর প্রধান মাথাব্যথা সিআইএর ড্রোন হামলা। সে দেশের সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত সেটা বন্ধ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগ না করছে,
ততক্ষণ পাকিস্তানি তালেবান সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হবে না। কিন্তু নওয়াজ শরিফের সরকার এ ক্ষেত্রে কতটা সফল হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা উৎপাদনবিষয়ক মন্ত্রী রানা তানভীর হুসাইন বলেছেন, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর এমন সামরিক প্রযুক্তি আছে, যা দিয়ে সিআইএর ড্রোনগুলোকে ভূপাতিত করা সম্ভব, কিন্তু তা করা সমীচীন হবে না। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করে দেশটির আকাশসীমা ব্যবহার করে বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানি নাগরিকদের হত্যা করে চলেছে, অথচ তাদের এই বেআইনি, যুদ্ধাপরাধের সমতুল্য তৎপরতা বন্ধ করতে পাকিস্তান একটা ড্রোনও গুলি করে কেন ভূপাতিত করেনি বা করছে না—এটা একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন। পাকিস্তানি তালেবানের কাছে হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর আছে। সম্ভবত সে কারণেই তারা তাদের অনেক পুরোনো বন্ধু নওয়াজ শরিফের কথাও বিশ্বাস করে না। তালেবান জানে, দলনির্বিশেষে পাকিস্তানের সব সরকার এবং দেশটির সামরিক বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের ওপর কী নিদারুণভাবে নির্ভরশীল! তাদের সঙ্গে শান্তি স্থাপনের অর্থ তো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেই মিটমাট করে ফেলা। কিন্তু তা কি হয়? এ মুহূর্তে তারা নিজেদের কর্তব্য স্থির করেছে, তাদের প্রধান নেতা হাকিমুল্লাহ মেহসুদের হত্যার বদলা নেওয়া জরুরি। এখন পাকিস্তানের জনগণের দিনরাত্রি কাটছে সেই আতঙ্কে।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.