গল্প- ছোট কামা by নুসরাত ফাতেমা

‘এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে! তুই আমার চটিজোড়া পায়ে দিয়েছিস কেন?’
‘বেশ করেছি। তুই আমার খাতার মলাট ছিঁড়েছিস কেন?’

‘এবার কিন্তু মারামারি শুরু হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি।’
‘হোক শুরু। আমিও রেডি।’
শুরু হয়ে গেল রোজকার মতো দড়াম-দাড়াম, ঢুসুম-ঢাসুম! মানে, অরিন আর তুরিনের মারামারি। ওরা দুই বোন। এক বছরের ছোট-বড়। অরিন বড়, তুরিন ছোট।
পিঠাপিঠি বোন, তাই বন্ধুত্বের মতো ঝগড়াটাও বেশ ভালো জমে। কিন্তু আজ ওদের ঝগড়া শুরু হতে না হতেই শেষ। কারণ, ঝগড়ার মাঝখানে মা এসে জানালেন, ছোট মামা আসছে!
খবর শুনেই মারামারি বন্ধ। একজন আরেকজনের চুলের মুঠি ছেড়ে হাত ধরে বসে পড়ল। অন্য দিন যেখানে কে কার আগে গোসল করবে, এই নিয়ে হাঙ্গামা বেধে যায়, সেখানে আজ দুজন একসঙ্গে গোসল করতে ঢুকে গেল। খাবারের টেবিলে যেখানে কাকে কম দেওয়া হলো, কাকে বেশি দেওয়া হলো—এ নিয়ে ধন্ধুমার কাণ্ড ঘটে, সেখানে আজ দুজন খেতে বসল এক প্লেটে।
কী হলো ওদের? কে এই ছোট মামা, যার আসার খবরে দুই বোন হঠাৎ বদলে গেল!
ছোট মামা আক্ষরিক অর্থেই ‘ছোট’। অরিন-তুরিনের সঙ্গে বয়সের তফাতটা খুব বেশি না হলেও, মামা ওদের জন্য একটা ‘রেড সিগন্যাল’। দেখা হলেই শুরু হয় তার জ্বালাতন। এই যেমন তুরিনের গত জন্মদিনে, নানুমনি নিজ হাতে মজার একটা কেক বানিয়ে সুন্দর করে টেবিলে সাজিয়ে রেখেছিলেন। কোথা থেকে ছোট মামা কাদাটাদা মেখে এসে নানুকে তারস্বরে ডাকতে লাগল। টেবিলের ওপর কেকটা পেয়েই কাদামাখা হাতে কেক তুলে খাওয়া শুরু করল। এরপর আর সেই কেক খাওয়া যায়? অরিনের সন্দেহ হয়, মামা বোধহয় হাঁটতে জানে না। সারাক্ষণ সে দৌড়ায়, নয়তো লাফায়!

বিকাল চারটা। অরিন, তুরিন আরাম করে ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ অরিনের মনে হলো, কে যেন ওর মুখে পানি ছেটাচ্ছে। চোখ খুলতে না-খুলতেই মনে হলো, কে যেন ওর শরীরে এক বালতি পানি ঢেলে দিল। ধরমর করে উঠে বসল অরিন। দেখল, ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো বের করে মামা হাসছে।

‘মামা, কখন এলে? দেখলাম না তো!’

‘মুখ হাঁ করে গরুর মতো ঘুমাচ্ছিলি, দেখবি কী করে? যা, জলদি তৈরি হয়ে নে। তোদের নানুবাড়ি নিয়ে যেতে এসেছি।’

নানুবাড়ি যাওয়ার কথা শুনে অরিন-তুরিন হইহই করে উঠল। ছোট মামার যন্ত্রণার কথা ভেবে একটু দুশ্চিন্তাও হচ্ছিল বৈকি।



দুই.

অরিন-তুরিনের বড় মামার মেয়ে জেরিন। গ্রামের বাড়িতে তিন বোন মিলে দারুণ মজায় সময় কাটছিল। সকালে ঘুম ভেঙেছে নানুর হাতে বানানো ভাপা পিঠার গন্ধে। সারা দিন মামার দেখা নেই। সন্ধ্যায় দেখা গেল, মামা ফুটবল হাতে বাড়ি ফিরছে। অরিন-তুরিনের ছোট মামা হলেও, জেরিন তাকে ডাকে ছোট কাকু বলে। একজন মামা ডাকবে, অন্যজন কাকু ডাকবে—তা হবে না। তাই একসঙ্গে হলে ওরা মামাকে ডাকে কামা বলে। কাকু + মামা = কামা!

রাতে ঘুমানোর সময় নানু চমৎকার একটা ভূতের গল্প শুরু করলেন। এর মধ্যে বাগড়া না বাধালে কি ছোট কামার চলে? সে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করল, গল্পটল্প নাকি তার পছন্দ না। নানুর প্যাঁচালে সে নাকি ঘুমাতে পারছে না। তার সঙ্গে যোগ হলেন মা। দুজন মিলে আসরটাই ভেঙে দিল। নানুও বাধ্য হয়ে গেলেন ঘুমাতে।

অরিন, তুরিন, জেরিন—তিনজনেরই ভীষণ রাগ হলো। জেরিন তো বলেই ফেলল, ‘ইচ্ছা করছে কামাকে ধাক্কা দিয়ে খাট থেকে ফেলে দিই।’

রাতে ঘুমাতে ওদের অনেক দেরি হলো। কারণ, প্রায় সারা রাতই ওরা পরিকল্পনা করল, কীভাবে কামাকে একটা শিক্ষা দেওয়া যায়!

তিন.

পরদিন বিকেল। নানাভাই অরিন, তুরিন, জেরিন, বড় মামা-মামি, ছোট মামা, নানুমনি—সবাইকে নিয়ে একটা পাহাড়ে বেড়াতে গেলেন। একমাত্র জেরিনই এর আগেও নানাভাইয়ের সঙ্গে এই পাহাড়ে বেড়াতে এসেছে। বাকিরা এবারই প্রথম। নানাভাই জেরিনকে দায়িত্ব দিলেন, অরিন-তুরিনকে পাহাড়ের পাশে বনের ভেতর ঘুরিয়ে আনতে। সঙ্গে ছোট মামাও চলল।

কী চমৎকার সেই বন! কত নাম না-জানা ফুল, গাছ, পশুপাখি দেখল অরিন, তুরিন। মামা পুরো বনটা দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। জেরিন হঠাৎ অরিন ও তুরিনের কানে কানে বলল, ‘চল, কামাকে রেখে আমরা চলে যাই। একা একা অচেনা বনের ভেতর ভীষণ ভয় পাবে।’

যেই ভাবা, সেই কাজ। মামাকে ফেলে চুপিচুপি চম্পট দিল ওরা।

বনে ঘুরেটুরে অনেকক্ষণ পর ফিরল। কিন্তু ছোট কামা তখনো ফেরেনি। নানাভাই জিজ্ঞেস করতে জেরিন আমতা আমতা করে বলল, ‘কাকু হারিয়ে গেছে।’ এ কথা শুনে নানুমনি, বড় মামি কান্না শুরু করলেন। বড় মামা শুরু করলেন বকাবকি। এদিকে অরিন-তুরিনের তো হাত-পা হিম হয়ে গেছে!

এমন সময় ছোট মামার গলা শোনা গেল। সে ‘বাঘ! বাঘ!’ বলে চিৎকার করতে করতে ছুটে এল জেরিন, অরিন আর তুরিনের দিকে। শুনে সবাই রকেটের গতিতে ছুটতে লাগল, এমনকি বড়রাও! একসময় ওরা পাহাড় ছেড়ে মূল রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

সবাই যখন হাঁফ ছাড়তে ব্যস্ত, তখন ছোট কামা প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, তোমরা সবাই দৌড়ালে কেন?’

নানাভাই, বড় মামাসহ সবাই অবাক। ‘কেন? তুই-ই তো বললি “বাঘ! বাঘ!” তাই তো আমরা ভয় পেয়ে দৌড় দিলাম।’

‘আরে বাঘ বলিনি তো! বলেছি “ভাগ ভাগ!”, মানে পালাও। বনের ভেতর শহীদের সঙ্গে দেখা। গতকাল ওর ফুটবলের পাম ছেড়ে দিয়েছিলাম। ওরা দলবল নিয়ে আমাকে পেটাতে আসছিল। তাই দৌড়ে পালিয়েছি।’

বড় মামি বললেন, ‘কিন্তু ওরা যে বলল তুই হারিয়ে গেছিস?’

‘না না ভাবি, তিনটা বেকুবের সঙ্গে ঘুরতে বের হয়েছি। ভিতুর ডিমদের সঙ্গে বেড়াতে একেবারেই ভালো লাগছিল না। তাই সুযোগ পেয়ে সটকে পড়েছিলাম।’

শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। মুখ গোমড়া হলো শুধু অরিন, তুরিন আর জেরিনের। নাহ্, ছোট কামাকে শায়েস্তা করা অসম্ভব!

ভাবতে মস্তিষ্ক ভিন্ন উপায় ব্যবহার করে।’

সপ্তম শ্রেণী, বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

 

No comments

Powered by Blogger.