দেশ ও সমাজ- অসংগতি আর অসংগতি by মোহাম্মদ কায়কোবাদ

পৃথিবীর এক-সহস্রাংশ ভূমির প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে মানবসভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মানুষ এর ২৪-সহস্রাংশের থাকা-খাওয়া,
চিকিত্সা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করছে বাংলাদেশ—এ নিয়ে আমরা গর্ববোধ করতেই পারি। কী কারণে এ সূচকে আমাদের শীর্ষাবস্থান বিশ্বের জ্ঞানী-গুণী সমাজবিজ্ঞানীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না, তা-ই আশ্চর্যের বিষয়! বিশ্বের অর্থনীতিবিদেরা এ সাফল্যকে উত্সাহী করতে একটি সূচকের সূচনা করতে পারেন। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অদক্ষ ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের যে অবদান, তা মনে করে শিক্ষিত সম্প্রদায় কিঞ্চিত্ লজ্জা পেতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নেতারাও, যাঁরা এই খেটে খাওয়া মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধা দিতে ব্যর্থ হলেও, তাঁরা দেশের কল্যাণে নিবেদিত এবং তাঁদের সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে’ অবস্থানকে বিসর্জন দিয়ে দেশ গড়ার কাজে নিজেদের নিবেদন করতে পারি। সীমিত সম্পদের বহু সমস্যার দেশে কেবল অসাধারণ নেতৃত্বই আমাদের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি এনে দিতে পারে, যা করেছে একসময়ে আমাদের সমকাতারে অবস্থান করা কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম। আমাদের সমাজের ওপরের স্তরের মানুষের কাজে ও কথায় যে অসংগতি। কিছু অসংগতির ফিরিস্তি দিয়েই আজকের লেখা।

১. রাজধানীতে এমনিতেই যানজটে প্রাণ ওষ্ঠাগত। এর মধ্যে ভিআইপিদের বাড়তি নিরাপত্তায় মৃত্যুপথযাত্রী রোগীসহ সবাইকে দাঁড় করিয়ে বাঁশি বাজিয়ে অধিকতর যানজট সৃষ্টি অনেকটা উপহাসের মতো। জনকল্যাণে কাজ করার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নিজের ব্রত হিসেবে একাধিকবার উল্লেখ করেছেন। যানজটে ক্ষুদ্র মানুষের জীবন বিপন্নের মতো ক্ষুদ্র বিষয় যদি আমলে না-ও নিই, যানবাহন ও জ্বালানির যে পরিমাণ অপচয় হয়, তা নিশ্চয়ই আমাদের মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশের জন্য অসহনীয় দণ্ড। ভিআইপিদের যাতায়াতের জন্য জনগণের পয়সা খরচ করে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিয়ে কীভাবে আকাশপথকে ব্যবহার করা যায়, তা ভাবার সময় এসেছে।


২. যানজটের ভয়ে সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, আইনপ্রণেতা ও আইনরক্ষকেরা যখন বিপরীত লেনে বেআইনিভাবে গন্তব্যে ছোটেন, তাতে কিন্তু সাধারণ নাগরিকেরা আইন লঙ্ঘন করতে উত্সাহী হয়।

৩. অসহনীয় যানজটের শহরে জাতীয় নির্বাচনে উত্সাহী প্রার্থীরা ততোধিক উত্সাহী সমর্থকদের নিয়ে হেঁটে, রাস্তা আটকে, মোটরসাইকেলে মিছিল করে যাত্রীদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। কোনো সন্দেহ নেই, নিজেদের প্রাণপ্রিয় নেতার প্রার্থিতার সময় তাঁদের জনসমর্থন দৃষ্টিগোচর করা প্রয়োজন। তাই বলে সাধারণ মানুষের যাতায়াত স্তব্ধ করা, দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করা এ রকম কর্মকাণ্ড ও কর্মসূচি নিশ্চয়ই অন্তত দেশাত্মবোধের অনুকূলে নয়। উপরন্তু, এ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সময়ও রাস্তায় নষ্ট হচ্ছে, যেখানে তাঁরা নানাভাবে দেশের কল্যাণে তাঁদের সময়, শ্রম, প্রজ্ঞা ও দক্ষতা কাজে লাগাতে পারতেন।

৪. আমাদের জনপ্রতিনিধিরা কিংবা নেতারা নানা কাজে লাইন ভেঙে তাঁদের কাজ আদায় করে নিলে তাতে যে সাধারণ মানুষ খুব ক্ষতিগ্রস্ত হতো, তা নয়। কিন্তু তাঁদের এ বেআইনি শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে উত্সাহী হয়ে শত গুণ বেশি মানুষ ভবিষ্যতে নেতা হওয়ার আশায় শৃঙ্খলাভঙ্গ দিয়ে তাঁদের জীবন শুরু করেন। সমাজের এ শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়দায়িত্বও কিন্তু নেতাদের ঘাড়েই বর্তায়। আমাদের জনপ্রতিনিধিরা নিশ্চয়ই সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের জন্য নয়, বরং এ সমস্যাজর্জরিত দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নিবেদিত। তাই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে না পারলেও তাঁদের নেতৃত্বে সাধারণ মানুষ যে দুর্ভোগ পোহায়, তার অংশীদার হওয়া প্রয়োজন।

৫. আমরা চাইব নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিটি রাজনৈতিক দল দেশের মানুষকে কী দেবে, তার সঙ্গে নিজেরা কী সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে, তারও একটি ফিরিস্তি যাতে থাকে। তাদের শাসনকালে আমরা দেখতে চাই, জনকল্যাণ ও স্বীয় সুযোগ-সুবিধার বাস্তবায়নের অনুপাতটি কী।

৬. দেশের কল্যাণকে জীবনাদর্শ ভেবে নেতারা তাঁদের রাজনৈতিক জীবনে কতবার দল ও কথা পরিবর্তন করেছেন, কতবার পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন, তার ফিরিস্তিও নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কোনো অঙ্গসংগঠনের করা উচিত ‘আপনার ভবিষ্যত্ নেতাকে দেখুন, জানুন’ এ ধরনের একটি কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে।

৭. গত প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয় ভোট ও আসনসংখ্যা প্রাপ্তির মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য, যা কখনোই কাম্য নয়। জনপ্রিয় ভোটের অনুপাতে আসনসংখ্যা হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। এ বিষয়টি বিবেচনায় এনে একাধিক কক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ সূচনা করার বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন, যেখানে উল্লেখযোগ্য প্রতিটি দলেরই প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এখন বড়জোর বড় দলের ঘাড়ে চড়ে ছোট দলগুলো জাতীয় সংসদে আসার সুযোগ পাচ্ছে। অথচ দেশব্যাপী তাদের ভোটের সংখ্যা কিন্তু প্রতিনিধি পাঠানোর জন্য যথেষ্ট।

৮. নির্বাচনকালীন ব্যবস্থা কী রকম হবে, এ রকম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো শেষ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে ফয়সালা করলে তা যে সুচিন্তিত হবে না, এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। তা না হলে কি অবসরপ্রাপ্ত শেষ প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে গ্রহণ করা হয়, যাঁর নির্বাচনে সরকারি দলের সর্বৈব ক্ষমতা এবং বিরোধী দল কেবলই দর্শকের ভূমিকায়!

৯. কথিত আছে, মহামতি লেনিনের শাসনামলে কমরেডরা প্রস্তাব এনেছিলেন সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরের নাম লেনিনের নামে করতে, তাতে লেনিন অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। কেবল তাঁর মৃত্যুর পর শহরটির নাম লেনিনগ্রাদ করা হয়েছিল। আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন সরকারের নেতাদের নামে তাঁদের শাসনামলে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, রাস্তাঘাটের নামকরণ হচ্ছে। অনেক বেশি সম্মানের হতো যদি ক্ষমতায় না থাকা অবস্থায় এ রকম নামকরণ হতো। পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নাম পরিবর্তনে অসম্মানই বেশি।
সমস্যায় জর্জরিত এ দেশে শৃঙ্খলার অভাবে আমরা যাতে আরও পিছিয়ে না পড়ি, আইনের শাসন যাতে প্রতিষ্ঠিত হয়, সে জন্য আমাদের জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করতে পারে। দেশের প্রয়োজনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থ পরিত্যাগ করে, ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সাধারণ মানুষকে দেশ গড়ার কাজে তাঁরা উজ্জীবিত করবেন, আমরা সবাই সেই আশাই করি।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।

No comments

Powered by Blogger.