মানবতার ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব

জন্মগতভাবে বিশ্বের সব মানুষ রক্তসম্পর্কীয় গভীর ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। তারা সবাই মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.) এবং আদি মাতা বিবি হাওয়া (আ.)-এর সন্তান। এ কারণেই জগতের সব মানুষ পরস্পর ভাই ভাই। একই পিতামাতা থেকে জন্মগ্রহণ করে বংশপরম্পরায় মানুষ বিভিন্ন জাতি-ধর্ম, দল-মত, সম্প্রদায় ও গোত্রে বিভক্ত হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি; যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো।’ (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩)
প্রাক-ইসলামি যুগে আরবের গোত্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহ, সংঘাত-সহিংসতা, প্রতিহিংসা ও শত্রুতা বিরাজ করছিল। কথায় কথায় ঝগড়া-বিবাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি, খুনোখুনি ও বিনা কারণে রক্তপাত নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। প্রতিশোধ গ্রহণই ছিল তাদের নেশা। ফলে গোটা আরব জাতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এহেন নিশ্চিত ধ্বংসোন্মুখ কঠিন অবস্থা থেকে তাদের ইসলামই রক্ষা করেছিল। কাজেই মানবজাতির জন্য একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থাস্বরূপ ইসলাম হচ্ছে মুসলমানদের প্রতি সৃষ্টিকর্তার একান্ত অনুগ্রহ ও আশীর্বাদ। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে এবং তিনি তোমাদের হূদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুণ্ডের প্রান্তে ছিলে, আল্লাহ তা থেকে তোমাদের রক্ষা করেছেন। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর নিদর্শন সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করেন, যাতে তোমরা সৎ পথ লাভ করতে পারো।’
(সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩) ইসলাম-পূর্ব মানবজাতি একে অপরের শত্রুভাবাপন্ন ছিল। এই শত্রুতা এমন চরম আকার ধারণ করত যে তারা ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হতো আর এই যুদ্ধ বহুদিন যাবৎ স্থায়ী থাকত। শান্তির ধর্ম ইসলাম এক মুসলমানের সঙ্গে অন্য মুসলমানের ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি স্থাপন করেছে এবং তাদের পরস্পরের মধ্যে বিবাদ মীমাংসার তাগিদ দিয়েছে। জাহেলি যুগে আরব ও অনারবদের মধ্যে সর্বদাই দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগে থাকত। ইসলাম তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তুলে ঐক্যবদ্ধ করল। মহানবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেছিলেন, ‘অনারবদের ওপর আরবদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই এবং আরবদের ওপরও অনারবদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ এতে প্রাক-ইসলামি যুগের যাবতীয় কুসংস্কার, অন্ধ অনুসরণ এবং ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত-সংঘর্ষ ও হানাহানি অপসৃত হয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় তাওহিদভিত্তিক মানবতার ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের সমাজ, যা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে নিতান্তই বিরল। ইসলামই সব মুসলমানকে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভালোবাসার হাত প্রসারিত করল। তাই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে একতাবদ্ধ হয়ে এক মুসলমান অপর মুসলমানকে কোনো প্রকার দুঃখ-কষ্ট দিতে পারে না এবং অন্যায়-অত্যাচার বা জুলুম-নির্যাতন করতে পারে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘একজন মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সে তাকে অত্যাচার করবে না এবং তাকে শত্রুর কাছে সমর্পণও করবে না।
আর যে ব্যক্তি তার কোনো ভাইয়ের প্রয়োজনে এগিয়ে আসে, আল্লাহ তার প্রয়োজনে এগিয়ে আসেন।’ (বুখারি ও মুসলিম) তিনি আরও বলেছেন, ‘তোমার ভাইকে সাহায্য করো। সে অত্যাচারী হোক অথবা অত্যাচারিতই হোক, যদি সে অত্যাচারী হয় তবে তাকে তার অত্যাচার করা হতে বাধা প্রদান করো। আর যদি সে অত্যাচারিত হয় তবে তাকে সাহায্য করো।’ (দারেমি) আরববাসী যে কদর্য অবস্থার মধ্যে নিপতিত ছিল তা থেকে আল্লাহ তাদের রক্ষা করেছেন এবং বলেছেন এখন থেকে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে, কাজেই তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না, পরস্পর দ্বন্দ্ব-কলহ ও বিবাদ-বিসম্বাদে লিপ্ত হবে না। ইসলাম পৃথিবীতে বিরাজমান সর্বপ্রকার শত্রুতা, বিভেদ ও বৈষম্য বিদূরিত করে দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধে আবদ্ধ করেছে। পবিত্র কোরআনে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করবে এবং নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না, তাহলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে; আর তোমরা ধৈর্য ধারণ করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন।’ (সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৪৬) ঐক্য শব্দের অর্থ হলো একতা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতার ফলে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের দিক দিয়েও মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
যেমন দুটো দেশ বা দুটো দল ঐক্যবদ্ধ হলে বা শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় উপনীত হলে তখন আর কোনো অশান্তি নেই। শান্তি চুক্তিতে ঐক্যবদ্ধ একটি জাতি হিসেবে তাদের গড়ে তুলতে এ সমুদয় সাযুজ্য কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। প্রকৃতপক্ষে ভ্রাতৃত্বের নিদর্শন হলো একজন মানুষ অন্য মানুষের প্রতি দয়া, মায়া ও সহানুভূতি প্রদর্শন করবে। তারা একে অপরের সুখে সুখী হবে এবং একে অপরের দুঃখে দুঃখী হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তুমি মুমিনদের তাদের পারস্পরিক দয়া প্রদর্শন, পারস্পরিক ভালোবাসা প্রদর্শন এবং পারস্পরিক সহানুভূতি প্রদর্শনের ব্যাপারে একই দেহের ন্যায় দেখবে। যখন দেহের কোনো একটি অঙ্গ কষ্ট অনুভব করে তখন এ জন্য সব দেহই নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে থাকে।’ (বুখারি ও মুসলিম) অতএব, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে মানবজাতিকে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। এক দল বা গোত্র অন্য দল বা গোত্রের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে না। এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের ওপর আভিজাত্য প্রকাশ করবে না। সবার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য সৌহার্দ্য ভাব স্থাপন করতে হবে। সমাজে মানুষে মানুষে যে সংঘাত-সহিংসতা, কলহ-বিগ্রহ, হানাহানি, খুনোখুনি, লুটতরাজ, হিংসা-বিদ্বেষ ও পরশ্রীকাতরতা চলছে, এসব অনাচার থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সবাইকে মানবতার ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.