ব্যাপক শিল্পায়নের বিকল্প নেই by মোহাম্মদ কবীর আহমদ

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি ও শিল্প খাতের উৎপাদন বিশেষ অবদান রাখলেও সম্প্রতি রেমিটেন্স প্রবাহ ভালো থাকার প্রেক্ষাপটে এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা হয়ে থাকে। কিন্তু উচ্চহারে রেমিটেন্স প্রাপ্তি কখনও কখনও কতটা অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে, তা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে রেমিটেন্স খাতে অনিশ্চয়তার বিষয়টি সব সময় বিবেচনায় রাখা উচিত। বাংলাদেশে ২০১৩ সালের রেমিটেন্স প্রবাহের দিকে তাকালে এক ধরনের স্বস্তি মেলে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৩ সালে রেমিটেন্স প্রবাহের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে রেমিটেন্স খাতে বাংলাদেশের ১৫ বিলিয়ন ডলার আয় হতে পারে। ২০০৮, ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১ সালে রেমিটেন্স খাতে বাংলাদেশের আয় ছিল যথাক্রমে ৮.৯৩, ১০.৫২, ১০.৮৫ ও ১২.০৭ বিলিয়ন ডলার। এ খাতে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে হয়তো আগামী বছরই আমরা ২০০৮ সালের দ্বিগুণ রেমিটেন্স অর্জন করতে সক্ষম হব। এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের ধসও নামতে পারে। কারণ বিশ্বমন্দাসহ অনেক কারণে এ খাতে আয় কমে যেতে পারে।
গত কয়েক বছরে কৃষি খাতে বাংলাদেশের যে অর্জন হয়েছে, তা অব্যাহত রাখার জন্য বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে কৃষি খাতে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও কৃষি খাতে যাতে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায় তার জন্য বিজ্ঞানীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই বিশেষভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কৃষি খাতের কিছু বৈজ্ঞানিক সাফল্য আমাদের উচ্চাকাক্সক্ষী হতে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক সাফল্যের বহুমুখী প্রয়োগের জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। আমরা জেনেছি, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের বিস্তৃত নিচুভূমি সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাবে। এতে আগামীতে বাংলাদেশের মোট আবাদি জমির পরিমাণ অনেক কমে যাবে। ক্ষতিপূরণ বাবদ উন্নত দেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থ উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় সহায়ক হবে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি, বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন চলাকালে উন্নত দেশগুলো যেসব আশ্বাস দিয়ে থাকে পরবর্তী সময়ে সেসব আশ্বাস বাস্তবায়নে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়। কাজেই উন্নত দেশগুলো থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ আমরা কী পাব, তা নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের কৃষিজ উৎপাদনে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, তার লক্ষণ এখনই স্পষ্ট। জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আবাসন ও অন্যান্য খাতে আবাদি জমির পরিমাণও কমে যাচ্ছে।
উল্লিখিত আলোচনায় এটাই স্পষ্ট হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উচ্চহারের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখার জন্য শিল্প খাত নিয়ে বিশেষভাবে ভাবতে হবে। এ খাতে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদ্যমান শিল্প-কারখানার উৎপাদন কোনো কারণে হ্রাস পাওয়ার আশংকা দেখা দিলে সমস্যা সমাধানে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
শিল্প-কারখানা বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে স্বল্পমূল্যের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ প্রাপ্তি একটি বড় ভূমিকা পালন করে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে যাতে কোনো রকম জটিলতা সৃষ্টি না হয় তার জন্য জ্বালানি ব্যবহারে বৈচিত্র্য আনতে হবে। আগামী দিনগুলোতে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকট কতটা তীব্র আকার ধারণ করতে পারে, বিভিন্ন জ্বালানির উচ্চমূল্যে তারই আভাস মেলে। আগামী কয়েক দশক পরও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে যাতে কোনোরকম সংকট সৃষ্টি না হয়, তা বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
সম্প্রতি জেলা ও উপজেলা শহরে নানারকম ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিকশিত হয়েছে। যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে জেলা, উপজেলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের উদ্যোক্তারা আরও নতুন উদ্যমে তাদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে পারবেন। জেলা এবং উপজেলা শহরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের মূল ক্রেতা দরিদ্র কৃষক। সরকারি পর্যায় থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা প্রদান অব্যাহত রাখা হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন খরচ কমবে। এতে কৃষকের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। কৃষকের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে তা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বিভিন্ন পণ্যের বাজারমূল্য বৃদ্ধি পেলে শিল্প-কারখানার শ্রমিকসহ সীমিত আয়ের মানুষের জীবনমানও কমে যাবে। তাই নিত্যপণ্যের বাজার যাতে অস্থিতিশীল না হয় সেদিকেও নজর রাখতে হবে। কৃষি ও শিল্প-কারখানার উৎপাদন অব্যাহত রাখার মধ্য দিয়ে আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে। প্রয়োজনীয় সহায়তা পেলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারাই এক সময় যৌথভাবে বৃহৎ পরিসরে শিল্প-কারখানা স্থাপনে উৎসাহিত হবেন। দেশে শিল্প-কারখানা বিকশিত হলে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে প্রযুক্তির গবেষণায় নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। এভাবেই একদিন আমাদের দেশের গবেষকরা নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনে চমক দেখাতে সক্ষম হবেন।
কম আমদানি এবং কাক্সিক্ষত মাত্রায় রেমিটেন্স প্রবাহ অব্যাহত থাকার প্রেক্ষাপটে আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান রিজার্ভ পরিস্থিতি সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু আমদানি বাড়লে এবং রেমিটেন্স প্রবাহে বিঘ ঘটলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ দ্রুত কমে যাবে। ওই রকম পরিস্থিতি মোকাবেলায় রফতানি আয় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্যের মান নিশ্চিত করতে পারলে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন রফতানি পণ্যের চাহিদা বাড়বে।
রফতানি পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে অনেক কৃষিজ পণ্য রফতানির উপযোগী হয় না। ওই পরিস্থিতিতে উৎপাদনকারী স্থানীয় বাজারে কম দামে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হন। এসব সমস্যা দূর করার জন্যও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য কম সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উৎপাদন বহুগুণ বাড়ানো সম্ভব। প্রযুক্তির গবেষণা একটি দেশকে কতদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে তার অন্যতম দৃষ্টান্ত ভারত। সাধারণভাবে উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতির নির্মাতা দেশের কথা বললে যেসব দেশের নাম আলোচনায় আসে, সেখানে ভারতের নাম খুব একটা আলোচিত হয় না। অথচ স্বল্প সময়ের প্রস্তুতিতে মঙ্গল অভিযানে অংশ নিয়ে দেশটি নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে। মঙ্গল অভিযানের জন্য তৈরি করা নাসার মহাকাশ যানের তুলনায় ভারতের তৈরি মহাকাশ যানের খরচ পড়েছে অনেক কম। এটাও একটা বড় ধরনের রেকর্ড। মাত্র কয়েক দশকের মহাকাশ গবেষণার মধ্য দিয়ে ভারত আজকের অবস্থানে আসতে সক্ষম হয়েছে। এ দৃষ্টান্ত বিবেচনায় রাখলেই স্পষ্ট হয় প্রযুক্তির গবেষণা একটি দেশকে কতদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম।
রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে যাতে শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত না হয়, সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবার নজর রাখতে হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচির সময়ও যাতে কলকারখানার উৎপাদন অব্যাহত থাকে, তা নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য জরুরি।
পরিবেশ সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে আগামী দিনগুলোতে জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার কমানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে নানারকম চাপ আসতে থাকবে। সম্প্রতি জাপানে সংঘটিত দুর্ঘটনার পর পরমাণু-বিদ্যুতের বিপক্ষে বিশ্বব্যাপী জনমত জোরালো হচ্ছে। পরমাণু-বিদ্যুৎবিষয়ক বিদ্যমান প্রযুক্তিতে আমূল পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত এ বিষয়ে বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান জনমতের ক্ষেত্রে তেমন পরিবর্তন আসবে না, এমনটাই অনুমান করা যায়। এ পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিরাপদ জ্বালানি হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের ব্যবহার বাড়তে থাকবে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে এসব জ্বালানির মূল্যও দ্রুত বাড়তে থাকবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেভাবে ব্যাপক শিল্পায়ন শুরু হয়েছে, উন্নয়নের এ ধারা আরও গতিশীল হবে, এটাও অনুমান করা যায়। উচ্চমূল্যে আমদানিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে স্বাভাবিকভাবেই পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। ওই পরিস্থিতিতে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখা কত কঠিন হবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। আগামী দিনগুলোতে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই রফতানি বাণিজ্যে টিকে থাকতে হবে। তখন এমনও হতে পারে, নামমাত্র লাভে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রেও তুমুল প্রতিযোগিতা শুরু হবে। এসব পরিস্থিতি যেসব দেশ যত সফলভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে, রফতানি বাণিজ্যে তাদেরই আধিপত্য তত বিস্তৃত হবে। আগামী দিনের প্রতিযোগিতার বিশ্বে আমরা যাতে আমাদের বাণিজ্যের প্রসার অব্যাহত রাখতে পারি তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। আগামী দিনের বাস্তবতার কথা বিবেচনায় রেখে সব দেশই দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে চেষ্টা করবে। ওই পরিস্থিতিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণায় যে দেশে যত সাফল্য আসবে, তারাই তত দ্রুত এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্যাপক উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রতিটি দেশ বিশেষভাবে সতর্ক থাকার পরও প্রায় সাত দশক পর বিশ্বমন্দার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। গত কয়েক বছরে বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে অনুমান করা যায়, আগামীতেও যে কোনো সময় পরিস্থিতির আরও অবনতির আশংকা দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব দেশই আগাম প্রস্তুতির কথা ভাবছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে আগামীতে সৃষ্ট যে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবেলার জন্য আমাদের দেশে বিদ্যমান শিল্প-কারখানার উৎপাদন যাতে কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়, তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকেও বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে আধুনিক প্রযুুক্তির গবেষণায় যাতে এগিয়ে থাকা যায় সে জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে।
মোহাম্মদ কবীর আহমদ : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.