শ্রদ্ধাঞ্জলি- দুটি মানুষ চলে গেলেন নিভৃতে by সুলতানা কামাল


নার্গিস ভাবি >>নার্গিস জাফর, আমার বাবা ডাকতেন নার্গিস বলে, কিন্তু সাধারণ্যে পরিচয় ছিল তাঁর ‘ভাবি’ বলে। অসাধারণ প্রতিভাধর ব্যক্তি, কবি, সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফরের স্ত্রী নার্গিস জাফর বাংলাদেশের গ্রন্থাগারিকদের অগ্রগামী এবং অগ্রগণ্য সমাজসেবী একেবারেই চুপচাপে সবার অলক্ষ্যে চলে গেলেন ১২ অক্টোবর।
আমাদের পরিবারের শুধু ভাইবোনদের মধ্যেই নয়, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের জন্য ভাবি বলতে স্থানটি এই একজনেরই ছিল, তার আগে-পরে কোনো পরিচিতির প্রয়োজন ছিল না। ভাবি আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে উঠেছিলেন আমরা দুই বোন যখন নেহাতই শিশু তখন থেকেই। তখন বড় বোন আমেনা কাহ্হারের বিয়ে হয়ে নিজ সংসারে অধিষ্ঠিত। মায়ের কাছের জন বলতে সেই ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছি, চিনে এসেছি ভাবিকেই।

ভাবির কাছ থেকেই জেনেছি, বিয়ে হয়ে কলকাতা থেকে যখন চলে এলেন ঢাকায়, তারাবাগে একই চৌহদ্দির মধ্যে আমাদের বাসাবাড়ি, মা সুফিয়া কামালকেই পেলেন তাঁর পরম বন্ধু, মাতৃস্থানীয়া শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে। মায়ের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভাবি ছিলেন তাঁর কাছের মানুষ, তাঁর আদরের ‘বউমা’। মনে আছে মায়ের যত প্রয়োজন-অপ্রয়োজনীয় কাজ, বেড়ানো, সিনেমা দেখা—প্রায় সবকিছুরই সঙ্গী থাকতেন ভাবি। শেষবারের জন্য যখন মাকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়, তাঁর সব আয়োজনে এ ভাবি ছিলেন আমাদের সঙ্গে। এমন কোনো পরিস্থিতি নেই আমাদের জীবনে, যেখানে ভাবি অনুপস্থিত। ভাবি নিজে পেশাগতভাবে গ্রন্থাগারিক ছিলেন। ছোটবেলার স্মৃতিতে গাঁথা রয়েছে, বিকেলবেলা ভাবি অফিস থেকে ফিরছেন, তখনকার ইউএসআইএস পাঠাগার। সুন্দর ছিমছাম করে শাড়ি পরা পায়ে হাইহিল জুতা—আমাদের দৃষ্টিতে ‘বড় হলে কেমন হব’ তাঁর ছবির মতো। ইউএসআইএস পাঠাগারের কারণে সেই সময়কার বিদ্বৎসমাজের সঙ্গে, যাঁর মধ্যে ছিলেন শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ও নাট্যব্যক্তিত্বরা—একটা অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিল। বন্ধু ছিলেন বড় বোন আমেনা কাহ্হারের। বড় বোনও ছিলেন ভিকারুননিসার শিক্ষক। সেই সময় সবচেয়ে সুন্দর, অনুকরণীয় নারীর প্রতিচ্ছবি আমাদের কাছে।
তবে ভাবি কাছে থাকাতে আমাদের কাজও তাঁর সঙ্গেই। ভাবি হারমোনিয়াম বাজিয়ে আমাদের গান শেখাতেন। নাচ তুলে দিতেন। ‘খর বায়ু বয় বেগে’, ‘ধিতাং ধিতাং বলে’, ‘আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে’ এসব গানের সঙ্গে। কিছুদিন পর পরই আমাদের বাড়ির উঠোনে চৌকির ওপর পর্দা খাটিয়ে ‘সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের’ আয়োজন। আমাদের অনুষ্ঠানের প্রধান এবং কখনো একমাত্র দর্শক ভাবি। ভাবি মায়ের সান্নিধ্যে থেকে ক্রমেই জড়িত হলেন নানা সংগঠনের সঙ্গে। নিজের পেশার কারণেও নেতৃত্বে ছিলেন বিজনেস অ্যান্ড প্রফেশনাল উইমেনস অ্যাসোসিয়েশনের। যোগ দিয়েছিলেন মহিলা পরিষদ, লেডিস ক্লাব ইত্যাদি সংগঠনে। কিন্তু আমাদের কাছে ভাবির পরিচয় সেই চিরন্তন ভাবি, মায়ের অকৃত্রিম বন্ধু ও সঙ্গী। কখনো বলতে দ্বিধা রাখেননি ভাবি যে মা তাঁর কাছে কত আপন ছিলেন, ছিলেন কত ভরসার মানুষ। বলতেন, ‘আমার সবচেয়ে প্রাণের মানুষ সুফিয়া কামাল।’
একাত্তরের ভয়ানক দুঃসময়ে যখন আমাদের এবং ভাবির পরিবারের সবাই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, এই দুই নারী দেশের ভেতরে থেকে নিরন্তর সহযোগিতা করে গেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের, যত রকমভাবে সম্ভব সাহায্য করেছেন তাঁদের। প্রতিনিয়ত খোঁজখবর রেখেছেন তাঁর পাশের বাড়িতে গৃহবন্দী বঙ্গবন্ধু পরিবারের। সাহসী, প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এ মানুষটি কখনো কখনো হয়ে পড়েছেন সম্পূর্ণ একা। শেষের দিকে একটা বিষণ্নতা ঘিরে ধরেছিল তাঁকে। জীবন থেকে ক্রমেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন। তাই হয়তো ‘লাইফ সাপোর্ট’-এর আড়ালে কিছুদিন লুকিয়ে থেকে নীরবে চলে গেলেন তিনি। আমাদের জীবনে ভাবির উপস্থিতি, চলাচল অনস্বীকার্য। ভাবি শান্তিতে থাকুন, ভালো থাকুন এই প্রার্থনায়।
সুপ্রিয়া ভাবি
সেই সত্তরের গোড়ার দিকের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘনিষ্ঠ সহপাঠী বন্ধু ফুলটু জানাল, তার যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ভাই ড. শামসুল বারি বিয়ে করেছেন পশ্চিমবঙ্গের একজনকে, যাঁর নাম সুপ্রিয়া—তাঁরা ঢাকায় আসছেন পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। ফুলটুর খুব কাছের প্রিয় বন্ধু আমি, তাই তাঁর ইচ্ছা আমি যেন ওঁদের সঙ্গে পরিচিত হই। সেই মতে ফুলটুদের গেন্ডারিয়ার বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা। সঙ্গে আরেক বন্ধু আহ্বান। নানা অকারণ-ঝুট ঝামেলা, যা এই বয়সে মনে হলে কৌতুকেরই উদ্রেক করে, পেরিয়ে ফুলটুদের গেন্ডারিয়ার বাড়িতে যাওয়া এবং সেই থেকে সুপ্রিয়া ভাবির সঙ্গে বন্ধুত্বের সূচনা। ১২ অক্টোবর নার্গিস ভাবির সঙ্গে তিনিও একই দিন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
ঘটনাচক্রে বারি ভাই আর ভাবি তাঁদের কন্যা সোনাকে নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে আমাদের বাড়ির তিন-চারটা বাড়ির পরেই বাসা নিলেন। আমাদের বাড়ি থেকে আসতে-যেতে বারি ভাই-সুপ্রিয়া ভাবিদের বাড়ি পেরোতেই হয়। আর তখন বাড়ির সীমানাপ্রাচীর সীমানার জন্যই তৈরি করা হতো—বাড়িঘর আড়াল করতে অথবা নিরাপত্তা বিধানের জন্য নয়। তাই বারান্দায় বসা অথবা উঠানে ঘোরাঘুরি করা বারি ভাই আর সুপ্রিয়া ভাবির সঙ্গে নিত্য কুশলবিনিময়। ৩২ নম্বরে এসে সুপ্রিয়া ভাবির পরিচয় হলো আমার মা সুফিয়া কামাল আর বাবা কামালউদ্দীন আহমদ খানের সঙ্গে। এর পর থেকে ভাবির প্রায় নিত্যদিনের অভ্যাসে দাঁড়াল সকালে এসে মা আর বাবার সঙ্গে গল্প করে যাওয়া।
কতবার ভাবি আমাকে বলেছেন, ‘আমার বাংলাদেশের প্রথম আর প্রিয় বন্ধু ছিলেন মাসিমা।’ আমাদের বাড়ির বারান্দায় একসময় রবীন্দ্রসংগীতের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার। সুপ্রিয়া ভাবি নিয়মিত সেই প্রশিক্ষণে অংশ নিতেন নিষ্ঠার সঙ্গে। কী সুন্দর গাইতেন, লিখতেন, অনুবাদ করতেন। তাঁর কুয়ালালামপুর আর জেনেভার বাসার কত স্মৃতি ঘুরেফিরে মনের মধ্যে। সুপ্রিয়া ভাবি যখন যেখানে থেকেছেন, মনে হয়েছে একজন আত্মীয় আছেন। ভাবি অনেক দিন ধরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। যখন ভাবি গুরুতর অসুস্থ কিন্তু বাড়িতেই আছেন বারি ভাইয়ের সেবায়-সাহচর্যে, আমরা মাঝেমধ্যে গেছি ভাবিকে দেখতে। একটি প্রাণবন্ত মানুষ কী করে ক্রমেই হারিয়ে গেলেন আমাদের কাছ থেকে। দেখেছি বারি ভাই কি গভীর ভালোবাসায় ভাবিকে ঘিরে রেখেছিলেন। সুপ্রিয়া ভাবিও চুপচাপেই চলে গেলেন। ভাবির সঙ্গে আমার, আমাদের পরিবারের বন্ধুত্ব চার দশকেরও বেশি সময় ধরে। আমাদের জীবনের, অস্তিত্বের অংশ হিসেবেই আমাদের মাঝেই ভাবিকে খুঁজে পাব আমরা। ভাবির জন্য রইল অগাধ ভালোবাসা।
সুলতানা কামাল: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক এবং সাবেকতত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।

No comments

Powered by Blogger.