দুই নেত্রীর নিয়ত
প্রধানমন্ত্রী ফোন করেছেন বিরোধী দলের নেত্রীকে। নৈশভোজে আমন্ত্রণ করেছেন। হরতাল প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছেন। টিভি স্ক্রলে এসব দেখে আমারও আশাবাদী হতে ইচ্ছে করে। আমি ভাবি, এমন হয় যদি একটু পর টিভি স্ক্রলে দেখি, বিএনপি ও তার জোটসঙ্গীরা হরতাল প্রত্যাহার করেছে (বা অন্তত ২৮ তারিখে নৈশভোজের আমন্ত্রণের সম্মানে সেদিনের হরতাল প্রত্যাহার করেছে) এবং বলেছে, নৈশভোজের আলোচনায় কোনো অগ্রগতি না হলেই কেবল তারা আন্দোলনের পথে যাবে। আমাদের রাজনৈতিক প্রত্যাশা কম ক্ষেত্রে পূরণ হয় এ দেশে। এবারও তা হলো না। বিএনপি হরতাল প্রত্যাহার করেনি এবং বলেছে, হরতাল শেষ হলে কেবল তারা আলোচনায় বসবে। বিএনপির যুক্তি হচ্ছে, তার জোটের নেতারা পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে হরতাল প্রত্যাহার করার সুযোগ নেই বলে হরতাল চলবে। আমি আবারও ভাবি, ‘বিএনপি কি এটি বলতে পারত না যে ঠিক আছে, হরতাল প্রত্যাহার করব, যদি সংলাপে বসার আগ পর্যন্ত কোনো রকম পুলিশি হয়রানি না হয়, আন্দোলনকালে গ্রেপ্তার হওয়া নেতা-কর্মীরা মুক্তি পান এবং গত কয়েক দিনে পুলিশি হামলায় নিহত হওয়ার ঘটনাগুলো তদন্ত করা হয়।’ বিএনপি এটি বললে প্রধানমন্ত্রী কি তা প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন?
প্রত্যাখ্যান করা হলে বা প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির পরও পুলিশি অভিযান অব্যাহত থাকলে বিএনপির আন্দোলন কি আরও বেশি মানুষের কাছে তখন গ্রহণযোগ্য হতো না? রাজনৈতিক নেতারা নিশ্চয়ই আমাদের চেয়ে বেশি বোঝেন, একে অপরকে অনেক বেশি ভালো করে চেনেন। তাই হয়তো বিএনপি অনমনীয় রয়ে গেল। নৈশভোজ বা সংলাপ হলে হয়তো আওয়ামী লীগও অনমনীয় থাকবে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধানের পদ থেকে শেখ হাসিনার সরে যাওয়ার প্রশ্নে। তাহলে সমাধান হবে কীভাবে? এর সম্ভাবনাই বা কতটুকু? আমাদের দুই নেত্রীর রাজনৈতিক ইতিহাসে সরকারপ্রধান হিসেবে শুভবুদ্ধিজনিত সমাধানের লক্ষ্যে বড় ছাড় দেওয়ার কোনো ঘটনা আমরা দেখিনি। অতীতে আমরা বিএনপিকে বিরোধী দলগুলোর দাবি এবং বিএনপি-নিয়ন্ত্রিত ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে জনগণের আকাঙ্ক্ষা মেনে নিতে দেখেছি কেবল বাধ্য হওয়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়লে। এবার কি আওয়ামী লীগ সরকার রাজপথের তীব্র আন্দোলনের চাপে বাধ্য না হলে নিজে থেকে বড় ধরনের কোনো ছাড় দেবে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে? এত হতাশার হয়তো কারণ নেই।
প্রধান দুটি দল ইতিমধ্যে কিছুটা ছাড় দিয়েছে তাদের আগের অনমনীয় অবস্থান থেকে। আওয়ামী লীগ ‘দলীয় সরকার’ থেকে সরে এসে ‘সর্বদলীয় সরকারের’ প্রস্তাব দিয়েছে। বিরোধী দল ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ থেকে সরে এসে ‘নির্দলীয় সরকারের’ কথা বলছে, নির্দলীয় ব্যক্তিদের নির্বাচিত করিয়ে আনার কথা বলে প্রকারান্তরে প্রধানমন্ত্রী বর্ণিত সংবিধান কাঠামোর মধ্যে সমাধানে রাজি থাকার ইঙ্গিত দিয়েছে। দুই প্রস্তাবকে সমন্বিত করে আওয়ামী লীগের প্রস্তাব অনুযায়ী বর্তমান সাংসদ এবং বিএনপির প্রস্তাব অনুযায়ী ‘নিরপেক্ষ, নির্দলীয়’ সাংসদদের সমন্বয়ে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা সম্ভব। আমি বিশ্বাস করি, এ নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছানো দুষ্কর নয়। কিন্তু তাতে কি নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান কে হবেন এবং নির্বাচন নিয়ে আরও বহু গুণে গুরুতর সংকট বা অনিশ্চয়তাটি কেটে যাবে? দুই দলের নিয়ত ঠিক থাকলে এই সংকটের সমাধানও সম্ভব। আওয়ামী লীগ বলছে, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হবেন অবশ্যই শেখ হাসিনা। বিএনপি বলছে, কোনোভাবেই এ পদে শেখ হাসিনা থাকতে পারবেন না, থাকতে হবে নিরপেক্ষ কাউকে।
শেখ হাসিনাই থাকলে তা হবে নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের বিজয়; বিএনপির পছন্দসই নিরপেক্ষ কেউ থাকলে তা হবে নির্বাচনের আগেই বিএনপির বিজয়। মাঝামাঝি পথ তাহলে কোনটি? সাদামাটাভাবে দেখলে মাঝামাঝি সমাধান হতে পারে, শেখ হাসিনার বদলে আওয়ামী লীগের কোনো সাংসদকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে বিবেচনা করা। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বা তোফায়েল আহমেদের মতো কাউকে কি সরকারপ্রধান হিসেবে মেনে নেবে বিএনপি, এমনকি আওয়ামী লীগ? ২০০৬ সালে বিচারপতি কে এম হাসানের বদলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান পদে আওয়ামী লীগের পছন্দ ছিল বিচারপতি মাহমুদূল আমীন চৌধুরী। বিকল্প হিসেবে এখন কি ঠিক তাঁকেই নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে মেনে নিতে প্রস্তুত আছে আওয়ামী লীগ এবং একই সঙ্গে বিএনপি?
যাঁদের কথা বললাম, তাঁদের কেউ নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হলে নির্বাচনের আগে একতরফা বিজয় মিছিল বের করার সুযোগ নেই বড় দুটো দলের কারোর। এমন সমাধান কি আসলেই সম্ভব? আমি বিশ্বাস করি, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে, এমন একটি সমাধানের সত্যিকারের নিয়ত থাকলে তা করা সম্ভব। এই নিয়ত প্রধানত থাকতে হবে ক্ষমতাসীন দলকে। বিরোধী দল যা চাইছে (নির্দলীয় প্রধান), তাতে আওয়ামী লীগের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নষ্ট হওয়ার বড় কোনো আশঙ্কা নেই। কিন্তু সরকার যা চাইছে (শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল), তাতে বিরোধী দলের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নষ্ট হওয়ার অবশ্যই যৌক্তিক আশঙ্কা রয়েছে। আবার নির্বাচনকালীন সরকারকাঠামো বাস্তবায়িত করার সাংবিধানিক ক্ষমতা রয়েছে কেবল সরকারের, বিরোধী দলের নয়। এসব বিবেচনা করে বলা যায় যে সমঝোতার দায়দায়িত্ব সবার, কিন্তু এটি প্রধানত হচ্ছে সরকারের। প্রশ্ন হলো, সরকারের কি আসলেই নিয়ত রয়েছে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের? সুষ্ঠু নির্বাচন হলে যদি বিরোধী দল জিতে আসে,
অন্য দলটির যথেচ্ছ ক্ষমতা প্রয়োগের অবসান ঘটে এবং তারা বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় নতুন সরকারের। এই আশঙ্কা এবারের নির্বাচনের ক্ষেত্রেও রয়েছে। এটি জেনেশুনেও সত্যিই কি গণতন্ত্রের স্বার্থকে সবার ওপরে স্থান দিয়ে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে আন্তরিক রয়েছে এবারের সরকারি দলটি? আমি দুঃখিত, আমার মনে হয় না এতটা গণতান্ত্রিক চেতনা রয়েছে বর্তমান সরকারের (এমন চেতনা অতীতে ছিল না বিএনপি সরকারেরও)। যদি তা থাকে, তাহলে সংবিধান বা আদালতের রায় কোনো সমাধানের পথে বাধা হতে পারে না। যদি তা থাকে, তাহলেই কেবল শান্তিপূর্ণ একটি রাজনৈতিক সমাধান দেখব আমরা। অন্যদিকে এমন চেতনা না থাকলে রাজপথের সংঘাতের মধ্য দিয়ে একটি রক্তক্ষয়ী মীমাংসা দেখতে পাব আমরা। এই সংঘাতে বিএনপি জিতলে একটি অংশগ্রহণমূলক কিন্তু তিক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, আওয়ামী লীগ জিতলে একটি একতরফা নির্বাচন হবে, আর কেউই না জিতলে এবং দীর্ঘদিন অচলাবস্থা বিরাজ করলে অরাজনৈতিক শক্তির উত্থান অবধারিত হয়ে উঠতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয় আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমাধান। আমাদের দুই নেত্রী কি সত্যিই বুঝতে পারছেন তা বা বুঝতে চাইছেন?
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments