ওবামা কি অপেক্ষায় থাকবেন? by হুসাইন আজাদ

একক ক্ষমতাবলে সিরিয়ায় হামলার ইঙ্গিত দিয়েও শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা মিত্রগুলোর পিছুটান এবং নড়বড়ে অবস্থানের কারণে সিরিয়া অভিযান নিয়ে ওবামার এই নরম সুর সিরিয়া আক্রমণের ব্যাপারে তার আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসারই ইঙ্গিত।

এক্ষেত্রে সবারই জানার আগ্রহ এখন একটাই-কংগ্রেস থেকে অভিযানের সমর্থন পাবেন তো ওবামা? আর সমর্থন না পেলে, তিনি কি একক সিদ্ধান্তেই হামলা চালাবেন?

ধারণা করা হচ্ছে রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট কংগ্রেসে ডেমোক্রেট দলীয় প্রেসিডেন্ট ওবামার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা হতে পারে। তবে এই বিরোধিতা কোন পর্যায়ের হবে তার আভাস কিছুটা পাওয়া যাচ্ছে। যেমন রিপাবলিকান দলীয় সিনেটর ও সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জন ম্যাককেইন এবং একই দলের সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম এক বিবৃতিতে ওবামার সীমিত পরিসরের হামলার প্রস্তাবে ‘না’ ভোট দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

তারা বলেছেন, সীমিত পরিসরে হামলা হলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ও এর শত্রু দেশগুলোর কাছে ‘ভুল বার্তা’ যাবে।

তবে শনিবার সিরিয়া অভিযানের পক্ষে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে কংগ্রেস সদস্যদের উদ্দেশ্যে ওবামা বলেন, আসাদকে শায়েস্তা না করলে অন্য দেশগুলোও এই ধরনের নিষিদ্ধ অস্ত্র ব্যবহার করতে উৎসাহী হবে। এক্ষেত্রে নাম উচ্চারণ না করলেও ইরান ও উত্তর কোরিয়ার প্রতি ইঙ্গিত করেন তিনি।

ওবামার বক্তব্য অনুযায়ী, কংগ্রেসের অনুমোদন প্রাপ্তির জন্য অপেক্ষা করা হলে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ এক সপ্তাহেরও বেশি সময় আপাতত সিরিয়ায় হামলা হচ্ছে না।

তবে কংগ্রেসে প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলে কী জবাব পাবেন ওবামা? হ্যাঁ নাকি না?

এক্ষেত্রে একটি কথা বলে রাখা ভালো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যুদ্ধে জড়ানোর আগে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধী আইন প্রণেতারা যুদ্ধের বিরোধিতা করলেও, শেষ মুহূর্তে এসে ঠিকই তারা প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করেন।

ফ্ল্যাশব্যাক ইরাক, আফগান, কসোভো ও ভিয়েতনাম যুদ্ধ

১৯৬০ এর দশকের শুরুর দিকে ভিয়েতনামে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আশঙ্কায় দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের সাম্যবাদবিরোধীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে কলঙ্কিত এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, যুদ্ধে জড়ানোর ব্যাপারে ভোট আহ্বান করা হলে কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়ে ৮৮টি আর না ভোট পড়ে কেবল ২টি। অন্য দিকে, ৪১৬-০ ভোটে ভিয়েতনাম যুদ্ধকে অনুমোদন দেয় হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভস।

তবে ভিয়েতনামে সৈন্য পাঠালেও শেষ পর্যন্ত সেখান থেকে বিপর্যস্ত হয়েই ফিরতে হয় মার্কিন বাহিনীকে। সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে পর্যদুস্ত হওয়ার পাশাপাশি প্রায় ৫৮ হাজার মার্কিন সেনা নিহত হয় ওই লড়াইয়ে। মারা যায় প্রায় অর্ধকোটি ভিয়েতনামি, লাওস ও কম্বোডীয় নাগরিক।

এরপর ১৯৯১ সালে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর ব্যাপারেও কংগ্রেসে ভোট আহ্বান করা হয়। দেশটির রাজপথে এই যুদ্ধে জড়ানোর ব্যাপারে হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও সিনেটে ৫২-৪৭ এবং হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে ২৫০-১৮৩ ভোটে অনুমোদন লাভ করে সামরিক অভিযানের প্রস্তাব।

তবে একমাত্র ১৯৯৯ সালে কসোভোয় আগ্রাসন পরিচালনাকারী সার্বিয়ার  বিরুদ্ধে মার্কিন বাহিনীকে অভিযানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত চাওয়া হলে বিভক্ত মতামত পান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। সিনেটের পক্ষ থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর কসোভোয় অভিযান শুরু করলেও তীব্র আপত্তি আসে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস থেকে।

তবে টুইন টাওয়ারে হামলার পর ২০০১ সালে আফগানিস্তান যুদ্ধের প্রশ্নে কিন্তু প্রেসিডেন্ট বুশকে ঠিকই সমর্থন জানিয়েছিলো কংগ্রেস।

এ ব্যাপারে কংগ্রেসে ভোট চাওয়া হলে সিনেটে ৯৮-০ ভোট এবং হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে ৪২০-১ ভোটে পাস হয় যুদ্ধ প্রস্তাব। তবে আফগান যুদ্ধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এখনও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে। অবসরপ্রাপ্ত অনেক কর্মকর্তাই ইতিমধ্যে স্বীকার করে নিয়েছেন অভিযানের নামে পুরোপুরি যুদ্ধে জড়ানো উচিত হয়নি তাদের।

একই রকমভাবে গণবিধ্বংসী অস্ত্র বানানোর অভিযোগে ২০০৩ সালে দ্বিতীয় দফায় ইরাকে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা প্রস্তাবে ভোট আহ্বান করা হলে কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে ৭৭-২৩ ভোটে এবং নিম্নকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে ২৯৬-১৩১ ভোটে অনুমোদন লাভ করেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট বুশ।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তাই দেখা যায়, তর্ক-বিতর্ক সত্ত্বেও যুদ্ধের দামামা একবার বেজে উঠলে ময়দান থেকে মার্কিন প্রশাসন কখনই পিছু হটেনি। প্রথম দিকে আপত্তি জানালেও প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকেই সমর্থন জানায় যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও বিরোধী উভয় পক্ষই।

তবে অতীতের ধারাবাহিকতায় প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও নিজের দেশের আইন প্রণেতাদের সমর্থন পাবেন কি না ওই প্রশ্নের জবাব মিলবে আগামী ৯ সেপ্টেম্বর।

কংগ্রেসে ডেমোক্রেটদের অবস্থান ও ওবামার অনুমোদন প্রার্থনা

আগেই বলা হয়েছে, পররাষ্ট্র ও যুদ্ধনীতির ক্ষেত্রে মার্কিনিরা বিতর্ক করলেও শেষ মুহূর্তে এসে তারা এক হয়ে যান। তাই ওবামার সীমিত পরিসরের অভিযানে ‘না’ ভোট দেওয়ার ইঙ্গিত দিলেও শেষ মুহূর্তে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্রেটিক উভয় দলের আইন প্রণেতারাই হ্যাঁ ভোট দিতে পারেন। এছাড়া আসাদকে শায়েস্তা করতে ব্যাপক অভিযানের প্রস্তাবও হয়তো উঠে আসতে পারে।

এখন বড় কথা হলো, কংগ্রেস অনুমোদন দিলে সিরিয়ায় অভিযান চালানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন ওবামা। তাই অনুমোদন পাওয়ার ক্ষেত্রে কংগ্রেসে ওবামার ডেমোক্রেট পার্টির অবস্থানও এখন বড় ফ্যাক্টর। সার্বিকভাবে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট কংগ্রেসে রিপাবলিকানরা এগিয়ে থাকলেও উচ্চকক্ষ সিনেটে সিরিয়ায় সীমিত পরিসরের অভিযানের অনুমোদন পেতে পারেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এছাড়া, রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে বিতর্ক হলেও ওবামার সিদ্ধান্ত পাস হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

প্রসঙ্গত, কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে ৫২ জন ডেমোক্রেট দলীয় প্রতিনিধি ও ৪৬ জন রিপাবলিকান দলীয় প্রতিনিধি রয়েছেন। দু’জন রয়েছেন স্বতন্ত্র সিনেটর।
অন্য দিকে, হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে রিপাবলিকান দলের প্রতিনিধি রয়েছেন ২৩৩ জন এবং ডেমোক্রেটিক দলীয় সদস্য রয়েছেন ২০০ জন।

অনুমোদন পাওয়া-না পাওয়া এবং ওবামার পরবর্তী সম্ভাব্য সিদ্ধান্ত

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিরোধিতা ও হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও কেবল কসোভো অভিযান ছাড়া আগেকার প্রায় সবগুলো যুদ্ধই কংগ্রেসের অনুমোদন নিয়ে লড়েছিলো মার্কিন বাহিনী। বিরোধিতা করলেও আগের অন্য যুদ্ধগুলোর মতোই সিরিয়া অভিযানকেও অনুমোদন দিতে পারে মার্কিন কংগ্রেস।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, যদি অনুমোদন না পান তবে কি ওবামা তার একক সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করবেন? যদি একক সিদ্ধান্ত প্রয়োগ করবেনই তাহলে অনুমোদনই বা চাইছেন কেন? আর যদি কসোভো যুদ্ধের মতো বিভক্ত মতামত আসে তবে কি করবেন ওবামা? তিনি কি ক্লিনটনের পথেই হাঁটবেন?

No comments

Powered by Blogger.