না, না-লেখার মাঝে কষ্টই বেশি by বদিউর রহমান

ইংরেজ কবি জন মিল্টন ‘প্যারাডাইজ লস্ট’ লিখে টের পেয়েছিলেন যে, অতঃপর ‘প্যারাডাইজ রিগেইন্ড্’ না লিখলে হয়তো তার আত্মা অতৃপ্ত থেকে যাবে। তাই স্বর্গ হারানোর পর স্বর্গের পুনঃপ্রাপ্তির চমৎকার কাব্যিক রচনা তিনি মানবসমাজকে উপহার দিয়েছিলেন। ভুলের খেসারতে স্বর্গ হারানো পরবর্তী সময়ে বড় হয়ে দেখা দেয়নি, বরং ভুলের অনুতাপ আর অনুশোচনার সুফল হিসেবে আবার স্বর্গপ্রাপ্তিই বড় হয়েছিল। মিল্টন মহাকাব্যে বিখ্যাত হলেন, মানবজাতি সৃষ্টি-রহস্য থেকে বাস্তবমুখিতায় স্বর্গ হারানো আর স্বর্গ পুনঃপ্রাপ্তির খেসারত ও তৃপ্তি উপলব্ধি করে মহাতৃপ্ত হল। আমরা বুঝতে সক্ষম হলাম যে, হারানোতে অস্থির হতে নেই, পুনঃপ্রাপ্তির সুযোগ রয়েছে। মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে/হারা শশির হারা নিশি অন্ধকারেই ফিরে আসে- কী এক চিরন্তন অমোঘ বাণী! ফেইলিওর ইজ দ্য পিলার অব সাকসেস- এটাও কি কম মূল্যবান? অতএব হতাশ হয়ে লাভ কী, বরং ক্ষতিই বেশি। রবার্ট ব্র“স না হয় সব সময় সবার পক্ষে হওয়া সম্ভব নাও হতে পারে, কিন্তু তার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতে দোষ কিসের? আমিও ভাবলাম, দেশসেবার জন্য আমার তো আর ‘নন্দলাল’ হলে চলবে না; ভুল-ভ্রান্তিবিহীন নখ-কেশ না হয়ে হাত-পা হয়েই তো কাজ করতে হবে। ভুলভ্রান্তি তো যে কাজ করে তারই হবে। আশাবাদী মানুষের চিরন্তন সজীবতা আমি ধরে রাখতে চাই। চির নতুনেরে দিল ডাক-এর মধ্যে থাকাই বেশ উত্তম মনে হয়।
অনেক চিন্তাভাবনা করে দেখলাম, নন্দলাল হয়ে ঘরে বসে থাকলে দেশসেবা হয় না। ভয়কে জয় করে বেরুতেই হয়। আমি একজন না লিখলে জগৎ-সংসারের কিছুই আসে যায় না। কেউ কারও জন্য থেমে থাকবে না। অক্ষমতাজনিত কারণে লেখা সম্ভব না হলে সে ভিন্ন কথা। লেখকের যেমন কমতি নেই, পত্রপত্রিকারও সংখ্যা কম নয়; ভালো-মন্দে পত্রিকার পৃষ্ঠা ভরতে হয়, হবেও; অতএব মূল ফসলের সঙ্গে আগাছাও থাকবে। তারপরও ধান ও ভুসিতে সহঅবস্থান থাকে। বাতাসে ভুসিমুক্ত না করা পর্যন্ত শুধু ধান পাওয়া যাবে না। এটা লেখকের বেলায় যেমন সত্য, তেমনি অন্য পেশার বেলায়ও প্রযোজ্য। রাজনীতির বেলায় ‘ধান-ভুসির’ ছড়াছড়ি তো আমাদের দেশে কেবল দেখেই চলেছি। অতএব না লিখলে ধান-ভুসির আলাদাকরণ যে বিঘিœত হবে, এ সত্য অস্বীকার করা যাবে না। ধান-ভুসি, গাছ-অগাছ, শেক্সপিয়র-ওভারসিয়ার সবগুলোকে এক পাল্লায় এক ভেবে চুপ করে হজম করে নিয়ে না লেখার মাঝে কষ্টই বেশি। অতএব লিখতে হবে, না-লেখার মাঝে আনন্দ যা-ই থাকুক, তার থেকে লেখার মাঝেই আনন্দ বেশি এটা মেনেই নিজকে সচল রাখতে হবে।
কিছু বিষয় ভেতরে জমাট বেঁধে থাকে। বলে কিংবা লিখে নিজেকে হালকা না করলে এ জমাট বিষয়ের সে কী জ্বালা! কান ঝালাপালা করানো টকশো না হোক, মোগল সাম্রাজ্যের দুনিয়া কাঁপানো প্রেমের উপাখ্যান না হোক, গামছাওয়ালার না-পাওয়ার হতাশা থেকে উদ্ভূত প্যাঁচাল না হয় নাইবা হল, ‘আগাচৌ’ কিংবা ‘বউ’র সাপ্তাহিক-পাক্ষিক রাজা-উজির মারা কিছু না হোক, অন্তত জমির দলিলে বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ দেয়ার মতো কিছু একটা হলেই বা মন্দ কী? না লিখলে কি এটা বলা যেত যে, আলী (আওয়ামী লীগ) বোধহয় এবার একটু ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে চাচ্ছে। তা না হলে সাংবাদিক পেটানো সংসদ সদস্য কি আর গ্রেফতার হতেন! লোকে বলে, এ গ্রেফতারের সায় দিয়ে আলী এক ঢিলে দু’পাখি মারার কৌশল নিয়েছে। সামনে এখনও সম্ভাব্য ও প্রত্যাশিত জাতীয় নির্বাচন। এক্ষেত্রে ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে হলে চমকপ্রদ কিছু করা প্রয়োজন। সুযোগ যখন এলো, অমনি কাজে লাগানো! দীর্ঘদিন ধরে নিজ দল আলী এবং নিজ নেতা হাসিনাকে যেভাবে এ সংসদ সদস্য বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছিলেন, তা আর কত মানা যায়? টকশো এবং লেখায় এমন একটা ভাব তুলে ধরছিলেন যে, তিনি একজন আদর্শ-বোদ্ধা রাজনীতিক, তিনি অন্যায়ে আপসে নেই। বস্তুত কোনো এক ‘মাত্রা’র অনুষ্ঠানে এ সংসদ সদস্য ধীরস্থিরভাবে গুছিয়ে কথা বলে একটা ‘ভাব’ সৃষ্টি করতেও যে সক্ষম হয়ে অনেক শ্রোতার মনে আসন করে নিয়েছিলেন, তা স্বীকার করতেই হয়। অতএব এবার তাকে ‘সাইজ’ করতে হবে, দেখ বাবা, হাউ মেনি রাইস ইন হাউ মেনি পেডি! দ্বিতীয়ত, জাতীয় নির্বাচনের আগে আলীর তথা সরকারের ভাবমূর্তি সৃষ্টির জন্য দেখতে হবে যে নিজ দলের চৌকস সংসদ সদস্য হলেও আইনের কাছে ছাড় নেই। অতএব নূরুননবী শাওন পার পেয়ে গেলেও এ বেচারা ধরা খেলেন। জনমনে একটা ধারণা স্পষ্ট আছে যে, দলীয় হাইকমান্ড না চাইলে রনি সাহেবও পার পেয়ে যেতেন, গ্রেফতার অন্তত হতেন না। পুলিশ এবং বিচার ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা যে পর্যায়ে এসেছে, তাতে এমন ধারণা হয়তো অমূলক নয়। ইব্রাহিম হত্যায় শাওনকে গ্রেফতার করা হলে তখনকার পুলিশ কমিশনারের আল্লাহকে হাজির-নাজির মেনে শাওনকে নির্দোষ দাবির কসম না খেলে; লিমন-ঘটনায় দায়ী আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী সদস্য গ্রেফতার হলে, লোক-পেটানো সংসদ সদস্য বদির বিষয়ে আগেই আইনি ব্যবস্থা নেয়া হলে আলীকে আজ এমন ভাবমূর্তি শূন্যতায় পড়তে হতো না। টেন্ডারবাজ-অস্ত্রবাজ ছাত্রলীগ-যুবলীগ ‘সূর্য-সন্তান’দের বা সোনার ছেলেদের কথা তো বলাই ‘অপরাধ’ হয়ে যেতে পারে। তবুও বলতে চাই, এ নজিরটা ভালো হল, আলীর ভাবমূর্তিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। এ কথাগুলো না লিখতে পারলে কষ্টই বেশি হতো, তা-ই লেখা হল।
ভালো কথা, সৈয়দ আশরাফের পদত্যাগ নিয়ে পত্রিকার খবর তো তিনি অস্বীকার করলেন। অনেক আগেই দৈনিক সমকালে একবার এমন ‘বদল’ প্রত্যাশিত মর্মে মত ব্যক্ত করেছিলাম। এবার শেষ মুহূর্তে সৈয়দ সাহেব হয়তো ‘মওকা’ বুঝে কেটে পড়তে চেয়েছিলেন; পাঁচ সিটির পরাজয় মেনে নিয়ে কেটে পড়া তার মতে হয়তো জাতীয় নির্বাচনে পরাজয় মেনে নেয়ার চেয়ে অনেক বেহেতের। কিন্তু শেখ হাসিনা কি অবুঝ যে পাঁচ সিটির ফলে ডুবুডুবু নৌকার এ দুঃসময়ে তাকে ছেড়ে দেবেন? তাকে যেতে দিলে দলের এক মহাবিপর্যয় হয়তো দেখা দিত। আশরাফবিহীন অবস্থায় হয়তো অনেক অজানা কথা বেরিয়ে যেত, দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-মতদ্বৈধতা হয়তো আরও প্রকাশ্য হতো। অতএব যায় দিন যাক, ডুবি-ভাসি একসঙ্গেই থাকি, নতুন করে থলের বিড়াল বের করে নতুন ফ্রন্ট খোলার দরকার কী? সৈয়দ সাহেবের পদত্যাগ-প্রস্তাবের সঙ্গে (বাস্তবই হোক আর গুঞ্জনই হোক) দলনেত্রীর সম্মত না হওয়ার আরেকটি মোক্ষম কারণও রয়েছে বলে অনেকের ধারণা। সেটা হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এখন আবার কাকে সাধারণ সম্পাদক করবেন? দল গোছানোর জন্য দক্ষ ও সাংগঠনিক শক্তিসম্পন্ন প্রবীণ কাউকে এ পদে আনা হলে তাতে হিতে-বিপরীত যদি হয়ে যায়? তার প্রভাব যদি দলনেত্রীর একচ্ছত্র প্রভাবকে কিছুটা হলেও ‘মলিন’ করে দেয়? আলীর মধ্যে নেতা তো ধরতে গেলে একজনই এবং তিনি খোদ শেখ হাসিনাই! সৈয়দ সাহেবের যত সমালোচনা আর আলীর মতো বড় দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যত ব্যর্থতাই থাকুক, শেখ হাসিনা তো তাকে নিয়ে সন্তুষ্ট ও স্বস্তিতে রয়েছেন, নাকি? এজন্যই তো গত কাউন্সিলে আবার সৈয়দ সাহেবকে স্বপদে বহাল রেখেছেন নেত্রী।
আলী ও বাজাদের (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) মধ্যে একটা বড় মিল হচ্ছে, দুই নেত্রীই গণতান্ত্রিকভাবে স্বেচ্ছাচারী, একক ক্ষমতালিপ্সু এবং অন্য নেতৃত্বের বিষয়ে অসহিষ্ণু। অপরদিকে বড় অমিলটা হচ্ছে, বাজাদ-নেত্রী যথাসম্ভব ‘মাইকের’ কাজ করিয়ে নিতে চান সাধারণ সম্পাদক বা অন্য নেতাদের দ্বারা। তিনি অনেক বিষয়েই গালে আঙুল ঠেকিয়ে বসে থেকে ‘নেত্রীসুলভ’ নীরবতায় আগ্রহী। অতএব মির্জা ফখরুল গং যথেষ্ট গলাবাজি আর চাপাবাজি হরদম চালিয়ে যান, নেত্রী থাকেন নিরাপদ। এর বিপরীতে আলীর দলনেত্রী নিজে হরহামেশা ‘মাইকের’ কাজ করতে ভালোবাসেন, ‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ পর্যন্ত’ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রেই তার একক রাজত্ব-কর্তৃত্ব, সাধারণ সম্পাদক থাকেন নীরব। সৈয়দ সাহেব ঘুমিয়ে থাকেন বা ‘কেমন-কেমন’ হয়ে থাকেন, তাতেই বরং নেত্রী সন্তুষ্ট। তিনি একাই আলী, তিনিই সব। অতএব তার প্রভাব-প্রতিপত্তি সামান্যতমও ক্ষুণœ হোক, তা নেত্রী চাইবেন কেন? চাইলে তো গত কাউন্সিলেই সাধারণ সম্পাদক পদে অন্তত একজন যোগ্য, দক্ষ, সাংগঠনিক ক্ষমতাসম্পন্ন নেতাকে আনতে পারতেন, নাকি? দেশবাসীর প্রিয় দল আলীকে অধঃপতনে নেয়ার ষোল আনা দায় কি একা শেখ হাসিনার, সৈয়দ সাহেবের কিছুটাও থাকবে না? এ কথাগুলো লিখতে না পারলে পেটে হয়তো ‘বদহজম’ হতো, তাই লিখে হালকা হলাম।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে আলী কী খেলা খেলতে চায়, তা নিয়ে বোধকরি আলাদাভাবেই লেখা শ্রেয়। এখন সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলা যায় যে, এ বিচারটাই এখন আলীর আগামী নির্বাচনের জন্য হাতের পাঁচ (যা আগেও বলেছি)। আলী হয়তো ভাবছে, এ বিচার দীর্ঘায়িত করে অসম্পন্ন কাজ সম্পন্ন করার দোহাই দিয়ে আবার ভোট চাওয়া যাবে। ইস্যুটাকে জিইয়ে রেখে ফায়দা হাসিল করা যাবে। বিলম্বিত রায়, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং আপিলের সময়ক্ষেপণ দেখে আমজনতার তেমন ধারণা হয়তো অমূলক নয়। কিন্তু এমন যদি কেউ ভেবে থাকেন যে, এ মেয়াদে এ বিচারের দৃশ্যমান বড় অংশ শেষ করে রায় কার্যকর করতে পারলেই জনগণ আলীকে বেশি বিশ্বাস করবে- তখন কি এ ধারণা উড়িয়ে দেয়া যাবে? এ স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আলাদাভাবে পরেই লিখি। কারণ না-লেখার মাঝে কষ্টই বেশি।
বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

No comments

Powered by Blogger.