উদ্যত অস্ত্র, শঙ্কিত জীবন by সাযযাদ কাদির

মাথায় সাদা টুপি। পরনে সাদা পাঞ্জাবি ও পায়জামা। যেন এক সফেদ মুসল্লি, তারাবি নামাজ সেরে বেরিয়েছেন ঈদের কেনাকাটায়। এক হাত দিয়ে কানে ধরে রেখেছেন সেলফোন, কথা বলছেন কারও সঙ্গে।
কিন্তু তা নয়। অন্য হাতে তার উদ্যত রিভলবার। সে রিভলবার থেকে একের পর এক বেরোয় গুলি। রাজপথে লুটিয়ে পড়ে শিকার। মোটরসাইকেলে চেপে সাঁ করে বেরিয়ে যায় মুসল্লিবেশী।

৩০শে জুলাই রাতে এ খুন ঘটে প্রকাশ্যে। রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানে, জমকালো বিপণি ‘শপারস্‌ ওয়ার্ল্ড’-এর সামনে। খুনের পুরো দৃশ্য ধরা পড়ে ওই বিপণির সামনে থাকা ক্লোজ সারকিট ক্যামেরায়। এরপর দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে মিডিয়ায়। দেশবাসী দেখতে পান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুব সংগঠন যুব লীগের ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ)-এর সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কী’র নৃশংস হত্যাদৃশ্য। এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার একটি কারণ সম্ভবত পোশাক দেখে খুনিকে হেফাজত বা জামায়াত-শিবির কর্মী ভেবে মহল বিশেষের উৎসাহিত হয়ে পড়া। যেন এক মোক্ষম সুযোগ পাওয়া গেছে প্রচার-অভিযান চালিয়ে তাদের ঘায়েল করার। কিন্তু র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) দ্রুত খুনিকে গ্রেপ্তার করে পানি ঢেলে দেয় সে উৎসাহে। জানা যায়, খুনি অন্য কেউ নয়- যুবলীগেরই আরেক নেতা। তার নাম এইচ এম জাহিদ সিদ্দিক তারেক। সে যুবলীগের ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ)-এর যুগ্ম সম্পাদক। তবে যুবলীগের কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, তারেক নয় খুনি সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল। সে যুবলীগের ঢাকা মহানগর (উত্তর)-এর সাংগঠনিক সম্পাদক। মিল্কীকে খুন করার সময় তার আশপাশে ছিল বাড্ডা’র কানী সোহেল ও মগবাজারের রবিন। চঞ্চলের ভগ্নিপতি রফিকুল ইসলাম কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা। র‌্যাব অবশ্য চঞ্চলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী শাহ আলমকে গ্রেপ্তার করে তারেকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী। শেষে ৩১শে জুলাই রাতে র‌্যাব-এর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধ’-এ নিহত হয় তারেক ও শাহ আলম। যুবলীগের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজির খবর অজানা নেই কারও। পত্রিকান্তরের খবরে জানা যায়, পিডিবি, ওয়াসা, ডেসা, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ও সিএমএমইউ’র টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ হয় চঞ্চলের হাতে। এই টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ নিয়েই খুন হয় মিল্কী। এ খুনে নেতৃত্ব দিয়েছে চঞ্চল, তারেক ও তাদের সহযোগীরা। যুবলীগের পদ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ খরচ করেছে এরা। চঞ্চল নিজে খরচ করেছে অন্তত ৮০ লাখ টাকা। এছাড়া তার অন্তত ২০ জন ক্যাডারকে বিভিন্ন পদে বসাতে খরচ করেছে ২০-৫০ লাখ টাকা। মিল্কী হত্যা সূত্রে যুবলীগের ভেতরকার অনেক কর্মকাণ্ডের খবর আসছে মিডিয়ায়। এ সব খবর যে নতুন বা অজানা তা কিন্তু নয়। যেদিন থেকে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায় সন্ত্রাসীদের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে রাজনীতির, সন্ত্রাসীরাও উপযুক্ত অভয়াশ্রম হিসেবে বেছে নিয়েছে- সেদিন থেকে এ সবই হয়ে চলেছে। নেতানেত্রীরা কথায়-কথায় দেশে বইয়ে দিচ্ছেন উন্নয়নের জোয়ার, আর প্রতিপক্ষদের মধ্যে শুধু দেখে বেড়াচ্ছেন চোর-সন্ত্রাসী। কিন্তু কেমন আছেন দেশবাসী? প্রতিদিনের  খবরাখবর থেকেই বোঝা যায় উদ্যত অস্ত্রের নিচে কিভাবে কাটছে তাদের শঙ্কিত জীবন, আর এই অস্ত্রধারী ‘সোনার ছেলে’রা কেমন গিজগিজ করছে ওইসব নেতানেত্রীদেরই ছায়াতলে। খুনির ওই মুসল্লিবেশ নিয়ে কিছু বলি। ওই বেশ দেখে মনে পড়েছিল গত ৫ই মে’র ঘটনাপ্রবাহ। সেদিন ছিল হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধের কর্মসূচি। পরে তারা অবস্থান নিয়েছিল মতিঝিলের শাপলা চত্বরে। তাদের কর্মসূচি বানচাল করতে সব রকম ফন্দিফিকিরই করেছিল সরকার। সড়ক, নৌ, রেলপথ বন্ধ করা হয়েছিল, পথে-পথে দলীয় লোকজনকে দিয়ে হামলা চালিয়ে খুন-জখমও করা হয়েছিল। তারপর ছিল পুলিশি দমন-নির্যাতন, তাদের পাশাপাশি দলীয় ক্যাডারদের প্রকাশ্য মারপিট। আর ছিল নাশকতা। শুনেছিলাম দলীয় কর্মীদের মধ্যে শ’ শ’ সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা টুপি বিলি করার কথা। ওগুলো পরে হেফাজতি বেশ ধারণ নানারকম দুষ্কর্মে লিপ্ত হওয়ার দৃশ্যও কিছু দেখা গেছে। যেমন... মারপিট, দোকানপাট লুট, ব্যাঙ্ক ও সোনার দোকানে হামলা, অগ্নিসংযোগ, ফুটপাতের বইপত্র ও অন্যান্য দোকানে জ্বালাও পোড়াও, নারী সাংবাদিকের সঙ্গে অশোভন আচরণ, গাছ কাটা ইত্যাদি, ইত্যাদি। এখন বুঝতে পারছি, বিলি করা সেসব টুপি পাঞ্জাবি পায়জামা একেবারে ফেলনা ছিল না, কাজে লাগছে এখনও!
sazzadqadir@rediffmail.com

No comments

Powered by Blogger.