শিক্ষকদের জন্য প্রতিশ্র“তির মুলা আর কতদিন? by মোঃ সিদ্দিকুর রহমান

স্বাধীনতার আগে যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ননম্যাট্রিক, ম্যাট্রিক পাস শিক্ষকদের দিয়ে পূর্ণ ছিল, আজ সেখানে স্থান করে নিয়েছে টগবগে উচ্চশিক্ষিত তরুণরা। কিন্তু শিক্ষক সমাজ আজ হতাশ। তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে বারবার প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করা হচ্ছে। নানা অজুহাতের মাধ্যমে অহেতুক সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। ৩০ বছর আগে আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম, শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা উন্নীত হবে। পাশাপাশি অন্য পেশার মতো বেতন-ভাতা দেয়া হবে। অথচ আমরা আজ হতাশ। নার্স, কৃষি সহকারী, সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক, মেডিকেল সহকারী, পুলিশ সদস্যদের মর্যাদা ও বেতনস্কেল আপগ্রেড করা হয়েছে, অথচ প্রাথমিক শিক্ষকদের ক্ষেত্রে শুধুই সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির আন্দোলনের মুখে ২০০৬ সালের ১৬ জুলাই সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তার মধ্যে ছিল- ১. সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদটিকে প্রথম শ্রেণীর পদে উন্নীতকরণের জন্য সংস্থাপন মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। ২. প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষকের পদটি দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীতকরণের বিষয়ে সভা নীতিগতভাবে ঐকমত্য পোষণ করে এবং প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীতকরণের জন্য সর্বসম্মত সুপারিশ প্রদান করে। তবে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম গ্রহণের আগে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সব বিধিমালা ও আর্থিক সংশ্লেষ বিষয়ে একটি রিপোর্ট কমিটি সভায় পেশ করবে। ৩. সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার থেকে উপজেলা শিক্ষা অফিসার পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিদ্যমান ২০ ভাগ কোটার স্থলে ৩০ ভাগ কোটা নির্ধারণের জন্য সংস্থাপন মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে ইত্যাদি।
বর্তমান সরকার আসার পর বিগত সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোর ধারাবাহিকতাকে আমলে নেয়নি। বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির দাবি সত্ত্বেও প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর পদমর্যাদায় উন্নীতকরণসহ শিক্ষকদের বেতন স্কেল আপগ্রেড করেনি। দীর্ঘ ৪ বছর ৮ মাস আশ্বাসের মুলা ঝুলিয়ে সময়ক্ষেপণ করেছে। গত ২৪ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভার পর্যালোচনা ও সিদ্ধান্ত নিুরূপ-
১. প্রস্তাবিত পদসমূহের পদমর্যাদা ও বেতনস্কেল উন্নীতকরণের বিষয়ে জানানো হয়, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পঞ্চম থেকে বৃদ্ধি করে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত সম্প্রসারণ হবে। ২০১৩ সালে সারাদেশের প্রত্যেক উপজেলা/থানায় ১টি করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণী খোলা হয়েছে। ৬ষ্ঠ শ্রেণী চালুকৃত প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ে ২ জন করে স্নাতক/স্নাতকোত্তরসহ বি-এড/ডিপ.ইন.এড পাস শিক্ষক সংযুক্তি/বদলির কার্যক্রম মাঠ পর্যায়ে চলছে। যেহেতু সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, সেহেতু নিুমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের প্রচলিত গ্রেডের মতো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল হওয়া প্রয়োজন।
২. শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়ে বিদ্যমান নিয়োগ বিধিমালার কতিপয় বিধান সংশোধনের প্রয়োজন অনুভূত হওয়ায় বর্তমানে প্রস্তাবিত নিয়োগবিধি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুবিভাগের সুপারিশ, প্রশাসনিক উন্নয়ন-সংক্রান্ত সচিব কমিটির সুপারিশ সাপেক্ষে চূড়ান্তকরণের উদ্দেশ্যে পিএসসির মতামত গ্রহণের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে মর্মে জানানো হয়েছে। প্রস্তাবিত নিয়োগবিধি অনুযায়ী সহকারী শিক্ষকদের যোগ্যতা হল পুরুষ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ন্যূনতম দ্বিতীয় বিভাগ/শ্রেণী সমমানের জিপিএসহ স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রি এবং মহিলা প্রার্থীদের ক্ষেত্রে উচ্চমাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগ/সমমানের জিপিএসহ উত্তীর্ণ অথবা স্নাতক বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। এছাড়া প্রধান শিক্ষক পদে সরাসরি নিয়োগের জন্য কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ন্যূনতম দ্বিতীয় বিভাগ/শ্রেণী/সমমানের জিপিএসহ স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রি থাকার শর্ত প্রস্তাব করা হয়েছে।
৩. বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৭,৬৭২। কর্মরত প্রধান শিক্ষক সংখ্যা ৩৭,৬৭২। তাদের বেতনস্কেল ১৩তম থেকে ১০ম ও ১৪তম থেকে ১১তম গ্রেডে উন্নীত করা হলে ভাতাদিসহ ১১৯ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। সহকারী শিক্ষক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বর্তমানে কর্মরত ১,৬৭,৬৭২ জন এবং প্রশিক্ষণবিহীন ২০,০০০ জন। বেতনস্কেল উন্নীত করা হলে ভাতাদিসহ ১৯৭ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। সর্বমোট আর্থিক সংশ্লেষ (১১৯+১৯৭) = ৩১৬ কোটি টাকা মর্মে প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি দেশের সব বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ২৬,০০০ জাতীয়করণের পদক্ষেপ গ্রহণ করায় এবং বিদ্যালয়হীন গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন ১৫০০ প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে সর্বমোট আর্থিক সংশ্লেষ প্রতিবছর কী হতে পারে, তা প্রস্তাবে উল্লেখ নেই।
৪. প্রস্তাব অনুযায়ী বেতনস্কেল উন্নীত করা হলে পেনশন, গ্র্যাচুইটি ও উন্নত বেতনস্কেল অনুযায়ী হবে। সেক্ষেত্রে প্রকৃত আর্থিক সংশ্লেষ অনেক বাড়বে। অর্থবিভাগের প্রতিনিধি জানান, যেহেতু এক্ষেত্রে ব্যাপক আর্থিক সংশ্লেষ রয়েছে, সেহেতু এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে অর্থ বিভাগের মতামত নেয়া প্রয়োজন।
৫. প্রস্তাবে দেখা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুই ধরনের প্রধান শিক্ষক পদ রয়েছে। একটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, যাদের বেতনস্কেল ১৩ নম্বর গ্রেড থেকে ১০ নম্বর গ্রেডে উন্নীতকরণের প্রস্তাব করা হয়েছে। অপরটি প্রশিক্ষণবিহীন প্রধান শিক্ষক, যাদের বেতনস্কেল ১৪ নম্বর থেকে ১১ নম্বর গ্রেডে উন্নীতকরণের প্রস্তাব করা হয়েছে। একই পদবির ২টি ভিন্ন স্কেলের পদকে ২য় শ্রেণীর পদে উন্নীতকরণের প্রস্তাবটি কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন।
৬. প্রধান শিক্ষকদের পদ ২য় শ্রেণীতে উন্নীত করা হলে ওই পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ন্যূনতম স্নাতক ২য় শ্রেণী হবে। সেক্ষেত্রে বর্তমানে যারা এসএসসি পাসসহ প্রধান শিক্ষক রয়েছেন এবং যাদের স্নাতক ডিগ্রি নেই তাদের কীভাবে ২য় শ্রেণীর পদে পদায়ন করা হবে? বিষয়টি সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন এবং এক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের মতামতও প্রয়োজন।
৭. বর্তমানে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বেশ কয়েকটি বিভাগে ১৩-১৬ নম্বর গ্রেডের কর্মচারীরা কর্মরত রয়েছেন, যাদের সংখ্যা অনেক বেশি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ সহকারী শিক্ষকদের বেতনস্কেল আপগ্রেড করা হলে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসনসহ অন্যান্য বিভাগের কর্মচারীদের কাছ থেকেও বেতনস্কেল উন্নীতকরণের দাবি আসবে। সুতরাং শিক্ষকদের বেতনস্কেল উন্নীতকরণের আগে এ বিষয়টিও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
৮. বর্তমানে সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের (এটিও) বেতনস্কেল ৮০০০-১৬৫৪০ টাকা। তারা বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ অন্য সহকারী শিক্ষকদের কার্যক্রম মনিটর করে থাকেন এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শন করেন। প্রধান শিক্ষকদের বেতনস্কেল ৮০০০-১৬৫৪০ টাকায় উন্নীত করা হলে তাদের বেতনস্কেল সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের সমান হবে। সেক্ষেত্রে মনিটরিং কর্মকর্তা হিসেবে সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের কাছ থেকে বেতনস্কেল উন্নীতকরণের দাবি আসতে পারে। ফলে উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও তদূর্ধ্ব পদোন্নতির পদগুলোর বেতনস্কেল পর্যায়ক্রমে উন্নীতকরণের দাবিও আসতে পারে, যা পর্যালোচনাযোগ্য।
৯. বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৭,৬৭২। সম্প্রতি প্রায় ২৬,০০০ বেসরকারি বিদ্যালয় জাতীয়করণের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এবং বিদ্যালয়হীন গ্রামে আরও ১৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে উপরোক্ত সরকারি প্রাথমিক স্কুলের জন্য বিপুলসংখ্যক প্রধান শিক্ষকের প্রয়োজন হবে। এসব পদকে ২য় শ্রেণীর পদমর্যাদায় উন্নীত করা হলে পদসমূহের নিয়োগ, পদোন্নতি, শৃংখলাজনিত কাজ বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের আওতাভুক্ত হবে। ফলে কর্মকমিশনের কাজের ব্যাপকতা বাড়বে। সুতরাং প্রস্তাবটি বিবেচনার আগে এ বিষয়টিও সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। বর্ণিত ৬ নম্বর ক্রমিকে এসএসসি পাস প্রধান শিক্ষকদের কথা বলা হলেও বাস্তবে ৩০ বছর ধরে কোনো এসএসসি পাস প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়নি।
শিক্ষকদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতে অর্থ সংকটের চিরাচরিত দোহাই দেয়া হয়েছে। শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতনস্কেল বিবেচনা করার আগে সর্বাগ্রে তাদের কাজের গুরুত্ব বিবেচনা করা উচিত। প্রাথমিক শিক্ষকরা জাতি গড়ার কারিগর। শিক্ষকরা তাদের প্রাপ্য অধিকার ও মর্যাদা চাইলে শুরু হয় সরকারের আর্থিক টানাপোড়ন। অথচ রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি অনেকের কাছে সামান্য বলে মনে হয়! মনে রাখতে হবে, শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় অপচয় নয় বরং তা দেশের উন্নয়নে বিনিয়োগ। শিক্ষকদের মর্যাদা ও আপগ্রেড বেতনস্কেল শিগগির বাস্তবায়ন হবে- এ প্রত্যাশাই করছি।
মোঃ সিদ্দিকুর রহমান : প্রাথমিক শিক্ষাবিষয়ক গবেষক ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি

No comments

Powered by Blogger.