বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিরতায় শিক্ষক রাজনীতি by একেএম শাহনাওয়াজ

জাতি হিসেবে বড় দুর্ভাগ্য বহন করছি আমরা। যখন একান্তে ভাবি কী হতে পারত এ দেশটি আর কী হচ্ছে, তখন বিমর্ষ হয়ে যাই। এগিয়ে চলার সূচক হতে পারত ঊর্ধ্বমুখী, অথচ তা ঘুরে এখন নিুগামী। অপার সম্ভাবনার দেশ আমাদের। প্রজন্মকে প্রণোদনা দেয়ার জন্য যখন ঐতিহ্যের সৌন্দর্য ও শক্তিকে সামনে আনা জরুরি তখন ঐতিহ্য বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রাণান্ত প্রয়াস দায়িত্বশীলদের। শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রে যেখানে উজ্জ্বল ঐতিহ্যের ঠাস বুনন রয়েছে- এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়- সেখানে প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করা এবং তাদের মধ্যে দেশপ্রেম ছড়িয়ে দেয়ার কাজটুকু কি আমরা করতে পারছি? এক্ষেত্রে বড় দাগে দায়িত্ব নেয়ার কথা রাজনীতিক ও সমাজবিদদের। কিন্তু এসব কাঠামোতে কঠিন দলতান্ত্রিক ও স্বার্থবাদী রাজনীতি আসুরিক শক্তি নিয়ে সব সম্ভাবনাকে দলিত-মথিত করে দিচ্ছে। এমন সংকটে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার একটি বড় ভূমিকা থাকে। ইউরোপে রেনেসাঁস সৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত বিবেক একটি বড় ভূমিকা রেখেছিল। আমাদের দেশে একসময় সমাজ ও রাজনীতিতে বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আইয়ুব আমলে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে উত্তাল আন্দোলনের নেতৃত্ব এসেছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। এ পর্বগুলোতে অধিকাংশ শিক্ষক একটি মহৎ আদর্শ ধারণ করে শিক্ষকতায় আসতেন। জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃজনে ছিলেন নিবেদিত। ছাত্রছাত্রীর আদর্শ ছিলেন তারা। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তরকালে ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জাতীয় রাজনীতির দুষ্কৃতি অনুপ্রবেশ করতে থাকে। ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের অপব্যাখ্যা বা অপব্যবহার হতে থাকে। স্বায়ত্তশাসনের অধিকার অনেক সময় স্বেচ্ছাচারে পরিণত হয়। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হবেন সব ঘরানার মানুষের গাইড ও ফিলোসফার, সেখানে নষ্ট রাজনীতির অক্টোপাস আটকে ধরে তাদের। জাতীয় রাজনীতির অনুসারী হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও বহুধাবিভক্ত হতে থাকেন। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের গাইড হওয়ার বদলে আজ্ঞাবহ লেজুড়ে পরিণত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতিকরণ এতটা স্থূলভাবে হতে থাকে যে, সেখানে জ্ঞানচর্চার বদলে পদ-পদবি এবং দল ভারি করার লোভটাই বড় হতে থাকে।
১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ গণতন্ত্র যেমন দিয়েছে, তেমনি শিক্ষকদের ফেরেশতাতুল্য মনে করার যথেষ্ট স্বাধীনতাও দিয়েছে। এ স্বাধীনতার অপব্যবহারে আমাদের রাজনীতির শিক্ষকরা সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় বেতন-ভাতা নিয়ে যৌক্তিক ও অযৌক্তিক কারণেও কর্তব্যভ্রস্ট হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে ভাগাড়ে পরিণত করছেন। অনেক সময় তারা ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থসিদ্ধির জন্য আইন-কানুন, মানবিকতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ- কোনো কিছুকে আমলে না নিয়ে দানবীয় আচরণ করেন, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিচয়ের সঙ্গে তেমন মেলানো যায় না। শিক্ষকতা পেশার ভেতর এমন স্থূলতা অনেক আগে থেকেই অনুপ্রবেশ করেছে। এখন এর বাড়বাড়ন্ত দশা। এই অসুস্থতার প্রধান কারণ শিক্ষক রাজনীতি জাতীয় রাজনীতির বৃত্তে বন্দি হয়ে যাওয়া। একজন শিক্ষকের কাছে প্রত্যাশিত বিবেক সেখানে আর কাজ করে না। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা বা আশপাশে ঘুরঘুরে স্বভাব যাদের, তাদের মধ্যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। আবার কোনো কোনো রাজনীতির ঘরানা আছে, যেখানকার শিক্ষকরা একটি আদর্শিক জায়গা থেকে নিজেদের সংগঠিত রাখেন। ক্ষমতা কেন্দ্র থেকে দূরে থাকেন বলে সুবিধাবাদী অনাচারে তারা তেমন যুক্ত থাকেন না। যদি অনাচার সৃষ্টিকারী দলগুলোর ‘আন্দোলনে’র মাঠ দাবড়ে বেড়ানো শিক্ষকদের একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক বৃত্তান্তের ওপর একটি নিরপেক্ষ তদন্ত হয়, তবে অনেক প্রশ্নের হয়তো উত্তর পাওয়া যাবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ভিসিবিরোধী দুটি শিক্ষক গ্র“পের আন্দোলনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেজ যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে অনেক শিক্ষক এ আন্দোলন নিয়ে জাতীয় দৈনিকে লেখালেখি করেছেন। এছাড়াও অনেক কলামিস্ট কলাম লিখেছেন। সম্পাদকীয়ও প্রকাশিত হয়েছে অনেক কাগজে। এসবের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের সামনে যে মেসেজটি পৌঁছে গেছে তা হচ্ছে- কিছুসংখ্যক শিক্ষক পরিচয়ের ঈর্ষাকাতর মানুষ নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে একটি অস্থিতিশীলতা চাপিয়ে দিয়েছেন। যে কারণে আন্দোলনকারী দুই গ্র“পের শিক্ষকদের কিছু অংশ ছাড়া অন্যসব দলীয় ও নির্দলীয় শিক্ষকের এতে কোনো সমর্থন নেই। অন্তত তিনটি শিক্ষক গ্র“পের শিক্ষক নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে তাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছেন। এর বাইরে শিক্ষার্থীদের কোনো খণ্ডিত অংশেরও সমর্থন-সহানুভূতি পাননি আন্দোলনকারী শিক্ষকরা। বরঞ্চ শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখার জন্য শিক্ষার্থীরা মিছিল পর্যন্ত করেছে।
এমন দুর্বল অবস্থানে থেকে অত্যন্ত বিতর্কিত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে খেলো কয়েকটি দাবি নিয়ে একজন নির্বাচিত ভিসিকে উৎখাতের আন্দোলন কখনও সাফল্য বয়ে আনতে পারে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আন্দোলনে এখনও যেহেতু দুই ভিন্নমতের পক্ষের মধ্যে মারামারি-হাতাহাতির সংস্কৃতি চালু হয়নি, তাই সংখ্যায় যতজনই হোন, মাঠ প্রতিরোধহীন থাকায় দাপট দেখাতেই পারেন। এ কারণে একজন নির্বাচিত ভিসি, পাশাপাশি একজন শিক্ষক ও আন্দোলনকারীদের সহকর্মী ড. আনোয়ার হোসেনকে বিনা নোটিশে অশিক্ষকসুলভ আচরণে ৮৪ ঘণ্টা বন্দি করে রাখতে পারেন তার অফিস কক্ষে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক ছাত্র এখন কাবুলে জাতিসংঘের অফিস কর্মকর্তা। আমাকে টেলিফোনে দুঃখ করে বললেন, চমৎকার একটি ইমেজ তৈরি করেছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, তোমাদের এই শিক্ষক আন্দোলন সবই বিসর্জন দিল। এখন নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়। ঠিক একইভাবে সেদিন একজন প্রবীণ অধ্যাপিকা বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস মিস করলে মাঝে মাঝে বাইরের পরিবহনে ঢাকা থেকে আসি। এখন বাসযাত্রী কারও কারও মন্তব্যে কান রাখা যায় না।
২৭ আগস্ট বাংলা একাডেমি গিয়েছিলাম। আমার ছাত্র উপপরিচালক ড. মিজানের চেম্বারে বসেছিলাম। আরেক সহপরিচালক সায়রাও এলো। জাহাঙ্গীরনগরের এই দুই সাবেক শিক্ষার্থী একই ধরনের হতাশা ব্যক্ত করছিল। এরই মধ্যে এলেন একজন গুণী মানুষ। লে. কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ আলী। এই মুক্তিযোদ্ধা গবেষণা করেন মুক্তিযুদ্ধের ওপর। ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের কবর শনাক্ত করার কৃতিত্ব রয়েছে তার। এখন বাংলা একাডেমি তার লেখা বীরশ্রেষ্ঠদের জীবনী সিরিজ প্রকাশ করছে। সাজ্জাদ আলী সাহেব একজন বড় ব্যবসায়ী। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক শিক্ষক আন্দোলনে তিনি মহাবিরক্ত। ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন, ২০-২২ লাখ টাকা প্রতিবছর ট্যাক্স দেন। আর সেই টাকার বেতন-ভাতা নিয়ে শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়কে উচ্ছন্নে দিচ্ছেন! বললেন, এখন তো দু’মাস পরপর ভিসি তাড়ানো আপনাদের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। তার ক্ষুব্ধ প্রস্তাব, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে সেখানে একটি আনসার একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হোক। তাতে জাতি কিছুটা উপকার পাবে। জাহাঙ্গীরনগর-সংশ্লিষ্ট আমাদের অবশ্য এমন প্রতিক্রিয়া শুনতে ভালো লাগছিল না। কিন্তু জনপ্রতিক্রিয়া ঠেকাব কিভাবে!
আন্দোলনের জটিলতা থেকে আপাতত বেরিয়ে আসার পথ তৈরি হল শিক্ষামন্ত্রীর আহ্বানে। গত ২৪ আগস্ট শিক্ষামন্ত্রী বৈঠক করেছেন আন্দোলনকারী শিক্ষকদের সঙ্গে। এর আগের রাতে আমি টকশোতে অংশ নেয়ার জন্য একটি টিভি চ্যানেলে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার সহ-আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সময়ের অভিজ্ঞ শিক্ষক নেতা এবং একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনি আমার কাছে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সবশেষ পরিস্থিতি জানতে চাইলেন। আমি জানালাম, আন্দোলনকারী শিক্ষকদের সঙ্গে আগামীকাল শিক্ষামন্ত্রী বৈঠক করবেন। শুনে আমার সহকর্মী তার রাজনৈতিক মেধা থেকে বললেন, আন্দোলনকারীরা নিশ্চয় বেরিয়ে আসার সম্মানজনক পথ খুঁজছেন। কারণ তাদের ভিসি বিতাড়নের এক দফা আদায়ে শিক্ষামন্ত্রী কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন না। অটল থাকলে আন্দোলনকারীদের উচিত ছিল চ্যান্সেলর বা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করা। আগামীকালের আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি ফর্মুলা বের করে আন্দোলন স্থগিত করে দেয়া হবে।
শেষ পর্যন্ত তাই হল। ১৫ দিনের জন্য স্থগিত হল আন্দোলন। এখন পুরো বিষয় তদন্ত করে দেখা হবে। উল্লেখ্য, এতদিন এ তদন্তের আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন ভিসি মহোদয়। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, তদন্তের ফলাফল তিনি মেনে নেবেন। আন্দোলনকারীরা তদন্তের রায় তাদের বিরুদ্ধে গেলে তা মানবেন কি-না তা এখনও জানাননি। এতসব কিছুর পরও ক্যাম্পাসবাসী মনে করছে না অস্থিরতা কেটেছে। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ও সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার পর এখন ক্যাম্পাসে সবকিছু স্বাভাবিক চলার কথা। কিন্তু পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বন্ধ হয়নি। এ মুহূর্তে জরুরি কাজ ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া। শোনা গেল, ২৬ আগস্ট ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিসভা আহ্বান করেও আন্দোলনকারী শিক্ষকদের অসহযোগিতার কারণে সভা স্থগিত করতে হয়েছে।
ঘটনা সত্য হলে একে আমরা আন্দোলনকারী শিক্ষক নেতাদের অবিবেচনাপ্রসূত হঠকারী সিদ্ধান্ত বলে মনে করব। সাধারণ শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করার এখতিয়ার কারও নেই। আমরা মনে করি, এ ধরনের শক্তি প্রদর্শনকারীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সবারই এগিয়ে আসা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিবেশের ক্ষতিসাধন এবং প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি নষ্ট হোক তা কেউ চাইবে না। যেহেতু শিক্ষক দলগুলো রাজনীতি আশ্রিত, তাই যে কোনো পক্ষের বিভ্রান্ত আচরণের দায় সংশ্লিষ্ট দলগুলোকেও বহন করতে হবে। আন্দোলনে যুক্ত আছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শধারী বলে প্রচারিত একটি দল আর তাদের সহযোগী জাতীয়তাবাদী আদর্শধারী বিএনপি গ্র“প। এখন নিজেদের কাদামুক্ত রাখতে উভয় দলের নেতাদের উচিত তাদের অনুসারী শিক্ষকদের সংযত করা। মনে রাখতে হবে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সভ্যতার আলোবঞ্চিত ৭২০ একরের বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপ নয়। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পর্ক রয়েছে সমগ্র দেশবাসীর। সুতরাং সব অনাচারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ যখন প্রশ্ন উত্থাপন করবে, তখন কিন্তু এর দায় রাজনৈতিক দলগুলো এড়াতে পারবে না।
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.