সামিউল থেকে ঐশী, অত:পর by রফিকুজজামান রুমান

সামিউলের কথা আমাদের মনে আছে কি? মনে থাকলে ভালো, আর না থাকলে সে দায় পুরোপুরি আমাদের নয়। মনেরও ধারণ ক্ষমতার একটি সীমা আছে।
এই দেশ, এই সমাজ এতো বেশি হৃদয়ক্ষরণমূলক ‘অঘটনের’ জন্ম দেয় যে তাতে প্রলেপের পর প্রলেপ পড়ে মন হয়ে যায় এক জড় পদার্থ। আর আধুনিক গণতন্ত্রে এই কৌশল এখন প্রতিষ্ঠিত যে ক্ষমতার চর্চা করার জন্য এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য জনগণের সামনে একটার পর একটা ‘ইস্যু’ উপস্থাপন করতে হবে। এবং মিশেল ফুঁকোর ভাষায়, ক্ষমতার এই চর্চার মধ্য দিয়ে শাসকগোষ্ঠী নতুন নতুন ‘সত্য’ উৎপাদন করবেন। সত্য তা-ই যা ক্ষমতার পরিপূরক। ক্ষমতা-চর্চার বাইরে থেকে সত্যকে ‘ডিফাইন’ করার ক্ষমতা কারো নেই। জীবন্ত কিংবদন্তী নোয়াম চমস্কি তার এক লেখায় বলেছেন, একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ৭০ ভাগ মানুষের সে দেশের ‘পলিসি মেকিং’ এ কোনো ভূমিকা নেই (নিউএজ, আগস্ট ২০, ২০১৩)। আমাদের দেশে এই হার কতো হবে তা গবেষণা ছাড়াই অনুমান করা যায়। সুতরাং, ‘পলিসি মেকিং’ নয়; ‘সকল ক্ষমতার উৎস’ যে জনগণ তারা এখানে ব্যস্ত নতুন নতুন ‘ইস্যু’ আর ‘সত্য’র ভারবহনের কর্মযজ্ঞে। পুরনো ‘সামিউলদের’ কথা মনে না থাকাই স্বাভাবিক।
ছোট্ট ছেলে সামিউল। ২০১০ সালের ২৪ জুন রাজধানীর আদাবরে  মায়ের পরকীয়া প্রেমিক আরিফের হাতে মায়েরই সহযোগিতায় নিহত হয় সামিউল। আরিফ এবং মা আয়েশার অনৈতিক সম্পর্ক দেখে ফেলার ‘অপরাধে’ই সামিউলকে জীবন দিতে হয়। প্রধান আসামী আরিফ গ্রেফতারের পর র‌্যাব সদর দপ্তরে যে স্বীকারোক্তি দেয় তাতে মায়ের পরিকল্পনার কথা জানা যায়। সে বলে, “ এশা (আয়েশা) আমাকে বলল, ‘ছেলেটা (সামিউল) বাড়াবাড়ি করছে। আমাদের সম্পর্কের কথা ওর বাবাকে বলে দেবে বলে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছে। ওকে একটা শিক্ষা দাও।’ ১৯ জুন রাতে এশার ঘরে ওর সামনেই আমি সামিউলের গলা টিপে ধরি। এশা পা চেপে ধরে রাখে। তারপর বালিশ চাপা দিই। এতে সামিউল মারা যায়।” (প্রথম আলো, ২৯ জুন ২০১০)।
মায়ের হাতে কিংবা মায়ের সহযোগিতায় সন্তান হত্যার চেয়ে নির্মম আর কিছু হতে পারে কিনা আমাদের জানা নেই। এই মা পাগল (ওহংধহব) কোনো মা না। নিজের রক্তের সন্তানের প্রতি তার ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। এর জন্য সরকার বা ক্ষমতার কোনো প্রশ্নও প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত নয়। তবু কেন এই নির্মমতা? এখানে এসেই অপরিহার্য হয়ে যায় আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা ও সভ্যতার নির্মোহ বিশ্লেষণ। প্রয়োজন হয়ে পড়ে বৈশ্বিক মুক্তবাজার অর্থনীতির হাত ধরে ‘তরঙ্গায়িত’ আকাশ সংস্কৃতির একতরফা আগ্রাসনের আপাদমস্তক ব্যবচ্ছেদ। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবার কেউ নেই। নেই কারণ সেখানেও খেলা করে রাজনীত ও ক্ষমতার সূক্ষ্ম গাণিতিক হিসেব, যেখানে দিনশেষে বিবেচনায় থাকে শুধুই ‘পুঁজি’। পুঁিজর জন্য দরকার বাজার। বাজারে আসা নতুন নতুন ‘প্রোডাক্ট’ এর জন্য চাই ভোক্তাশ্রেণি। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, মিডিয়া সব ব্যস্ত আপনাকে ভোক্তা বানাতে। প্রয়োজনের চাহিদা পূরণের পর আপনার মধ্যে সৃষ্টি করা ‘অপ্রয়োজনের’ চাহিদা; আপনি সেই চাহিদার পেছনে ছুটছেন বলেই প্রতিবাদহীন হয়ে যাচ্ছেন, ‘ক্ষমতার উৎস’ আপনি জানতেও পারছেন না আপনাকে নিয়ে কারা খেলছে, কিভাবে খেলছে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর স্যামুয়েল হানটিংটন সেজন্যই বলেছেন, জনগণকে অন্ধকারে রাখতে পারলেই ‘ক্ষমতা’ শক্তিশালী হয়। অন্ধকারেই দিন কাটছে আমাদের। যে সমাজ নিজের সন্তানকে হত্যা করা থেকে মা কে বিরত রাখতে পারে না, সেই অন্ধকার সমাজের অন্ত:সারশূন্যতার মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় এক একজন ঐশী। ক্ষমতাবানরা এই অন্ধকার দূর করতে চান না, কারণ এই অন্ধকারই তাদের দেয় ক্ষমতা চর্চার নিরঙ্কুশ নিশ্চয়তা।

পুলিশ ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রীকে নিহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় গত ১৬ আগস্ট ২০১৩ রাজধানীর চামেলীবাগের নিজের বাসা থেকে। মেয়ে ঐশী এখন পর্যন্ত পুলিশের কাছে যে স্বীকারোক্তি দিয়েছে, তাতে বাবা-মা’র হত্যাকা-ে তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে বলেই মনে হয়। যে কারণটি সে বলতে চেয়েছে তা হলো তার ‘অবাধ’ জীবনযাপনের পথে বাবা-মায়ের হস্তক্ষেপকে সে সহজভাবে নিতে পারে নি। বাবা-মায়ের প্রতি তার একধরনের ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে তার যে নিজস্ব একটি জগৎ তৈরি হয়েছিল সেখানে পরিবার, মা-বাবা, আবেগ, অনুভূতি সবকিছুর ঊর্ধের এক ‘জীবনবোধ’কেই সে জীবন মনে করেছিল। ‘জীবন ব্যক্তিগত’, তাই সেখানে বাবা হোক, মা হোক, কারোরই বাধা হয়ে দাঁড়াবার সুযোগ নেই  - এমন  একটি বোধ থেকেই হয়ত বাবা-মা’কে হত্যার ‘যুক্তি’ খুঁজে পেয়েছিল মেয়ে ঐশী। সংবাদপত্রে ও টেলিভিশনে সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা এর পেছনের নানা ধরনের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। মনোস্তাত্বিক কারণ। কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই, শুধু মনোস্তাত্বিক কারণ অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে এই ঘটনার ‘পোস্টমর্টেম’ অসম্ভব। এর পেছনে রাজনীতি আছে, আছে রাজনৈতিক অর্থনীতি। এই ঐশী বাবা-মায়ের ঐশী নয়; কলুষিত রাজনীতি এবং তার পথ ধরে ভোগসর্বস্ব অর্থনীতির এক টুকরো ‘উপহার’ এই ঐশী। বাবা-মা ঐশীকে পৃথিবীর আলোয় এনেছেন; অত:পর এই সমাজ, এই রাজনীতি, এই অর্থনীতি ক্রমাগত ঐশীর সামনে উপস্থাপন করেছে অশেষ অন্ধকার। কোন্ বাবা-মায়ের সাধ্য আছে সেই ‘অন্ধকার’ থেকে সন্তানকে দূরে রাখার? পুলিশ বাবাও মেয়েকে ফেরাতে পারেন নি। পারবেন না। অসম্ভব। বাবা মা ধর্মের কথা শোনাবেন, সমাজের পরতে পরতে ধর্মহীনতার চর্চা। বাবা মা নৈতিকতার কথা বলবেন, সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে অনৈতিকতার প্রলোভন। বাবা মা মাদকের বিরুদ্ধে সন্তানকে সতর্ক করবেন, অলি-গলি-পাড়া-মহল্লায় মাদকের অবাধ কেনাবেচা। বাবা মা সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার কথা বলবেন, মিডিয়া আর ‘অল্টারনেটিভ’ মিডিয়া ইন্টারনেটে সংস্কৃতির ‘নীল’ আবেদন। বাবা-মা পারিবারিক মূল্যবোধের বয়ান শোনাবেন, টিভি খুললেই সিরিয়ালের পর সিরিয়ালে নোংরামি, কুটনামী আর পরকীয়ার ‘শৈল্পিক’ রেসিপি। এবং বলতে বাধা নেই, স্বয়ং বাবা-মা’রাই এসব থেকে মুক্ত নন। না হলে মায়ের হাতে সামিউল মারা যাবে কেন?
তাই বাবা-মায়ের নয়, ঐশীর নয়; বিচার করতে হবে এই সমাজের, এই রাষ্ট্রের, এই রাজনীতির যে সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতি এরকম হাজারো ঐশী তৈরির নেপথ্যের কারিগর। রাষ্ট্র চাইলে এক সপ্তাহে দেশকে মাদকমুক্ত করতে পারে। সীমান্ত দিয়ে যেসব মাদক বাংলাদেশে আসে তা পুলিশের নাকের ডগার উপর দিয়েই আসে আর সেই পুলিশের ‘মেয়েরা’ই আবার সেগুলো সেবন করে! যারা মাদক নিয়ে আসে তাদের প্রত্যেকেরই আছে রাজনৈতিক পরিচয়। সরকার আন্তরিক হলে মাদক নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই সম্ভব। সম্ভব আকাশ সংস্কৃতির ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণ। কিšুÍ সরকার কখনো আন্তরিক হয় না। কারণ, ভোগবাদী অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার মধ্যেই তার রাজনীতির লেনাদেনা।
অতএব, সামিউল, ঐশী, অত:পর...অপেক্ষা নতুন কোনো ঐশীর।

লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কলাম লেখক
ইমেইল: rafique.ruman@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.