ঐশীর বেপরোয়া জীবনে সঙ্গী ১ ডজন বয়ফ্রেন্ড by নূরুজ্জামান

বেপরোয়া জীবনযাপন, অনিয়ন্ত্রিত প্রেম ও মাদক সেবনে বাধা পেয়েই নিজের পিতা-মাতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে ঐশী রহমান।
ঠাণ্ডা মাথার পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমেই মা স্বপ্না রহমানকে কুপিয়ে ও পরে পিতার গলায় খঞ্জর চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। গতকাল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এই নৃশংসতার বর্ণনা করেছে ঐশী। হত্যা মামলায় ঐশী রহমান, তার বয়ফ্রেন্ড মিজানুর রহমান রনি ও বাসার কাজের মেয়ে সুমিকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ৫ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। গতকাল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতে তাদের হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। রিমান্ডের বিরোধিতা করেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। পরে উভয় পক্ষের শুনানি শেষে মহানগর হাকিম মিজানুর রহমান ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পল্টন থানার এসআই শহীদুল্লাহ প্রধান রিমান্ড আবেদনে বলেন, ঐশী মাদকাসক্ত ছিল। মাদকাসক্ত বন্ধুবাবন্ধরা মিলেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। তাদের সবার পরিচয় জানতে ও হত্যার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের জন্য এই তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। অন্যদিকে ঐশীর পক্ষে তার আইনজীবী মাহাবুব হাসান রানা, চৌধুরী মোহাম্মদ গালিব রাকিব ও রেজাউর রহমান টিংকু রিমান্ডের বিরোধিতা করে জামিন আবেদন করেন। রনির পক্ষে শুনানি করেন এডভোকেট মন্টু রঞ্জন দাস। মাহাবুব হাসান রানা বলেন, অপ্রাপ্তবয়স্ক ঐশীকে রিমান্ডে নেয়ার প্রশ্নই আসে না। এই শুনানি স্থগিত রেখে তাকে কিশোর আদালতে নেয়া হোক। আর জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হলে তা কারাফটকেই করা উচিত। রানা বলেন, যে পরিবার ও যে সমাজ ঐশীদের তৈরি করে তাদের বিচার হওয়া দরকার। শুনানি শুরুর আগে কালো বোরকা ও মেরুন চাদর পরা ঐশী এজলাসে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের বলেন, মা-বাবার জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে। আমার হাঁপানি আছে। এ সময় তার হাতে একটি ইনহেলারও দেখা যায়। এদিকে হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ঐশীর আরও তিন বয়ফ্রেন্ডকে খুঁজছে গোয়েন্দা পুলিশ। এ বিষয়ে ডিএমপির জয়েন্ট কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেন, পুলিশের অনুসন্ধান ও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পুলিশ দম্পতি হত্যাকাণ্ডে ঐশী, সুমি ও রনির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এই তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে নিশ্চিত হওয়া গেছে- এই হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত। এখন রিমান্ডে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে হত্যার মোটিভ সম্পর্কে পরিষ্কার হওয়া যাবে। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরও কেউ জড়িত কিনা তা জানা যাবে। মনিরুল ইসলাম আরও বলেন, নিহত দম্পতির বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া ছুরি ও বঁটির মধ্যে ছুরিটিই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়েছে। আর ঐশীর মায়ের কোমরে থাকা আলমারির চাবির গোছা কাটার জন্য রান্না ঘর থেকে বঁটি আনা হয়েছিল। তিনি বলেন, আসলে মেয়েটির বন্ধুসংখ্যা অনেক। তাদের সঙ্গদোষে বখাটে হয়ে গিয়েছিল। এই বখাটেপনা থেকে ফিরিয়ে আনতে তাকে বাসা থেকে বের হতে দিতেন না তার মা-বাবা। এ কারণেই মায়ের প্রতি বেশি ক্ষোভ ছিল ঐশীর। তদন্ত সূত্রমতে, ঐশীর শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে। সেখানকার ধর্মীয় রীতিনীতি ও নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন তার ভাল লাগেনি। ছেলেদের টুপি ও মেয়েদের স্কার্ফ পরা অসহ্য মনে হয়েছে তার কাছে। তখন থেকেই তার ধারণা জন্মে- ওই স্কুলে পড়াশোনা করলে পার্থিব জীবনের সকল সৌন্দর্য উপভোগের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। অদেখাই রয়ে যাবে সৃষ্টির আসল সৌন্দর্য। এ ধারণা থেকে স্কুল বদল করতে বাবা-মাকে চাপ দিতে থাকে। বায়না ধরে ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান- অক্সফোর্ড স্কুলে ভর্তির। ঐশী ছিল বাবা-মায়ের বড় মেয়ে। তাই তার সকল আবদার পূরণের চেষ্টা করতেন বাবা-মা। যা চাইতেন তা-ই দেয়ার চেষ্টা করতেন। এরই এক পর্যায়ে ২০১১ সালে ঐশীকে ধানমন্ডির অক্সফোর্ড স্কুলে ভর্তি করে দেন বাবা-মা। ভর্তির পর স্কুলের গাড়িতেই যাতায়াত করতো ঐশী। মাঝে-মধ্যে রিকশা নিয়ে যেতো। পারিবারিক সূত্র জানায়, অক্সফোর্ড স্কুলে ভর্তির পরই ঐশীর আচরণ ও জীবন-যাপনে দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। সালোয়ার কামিজ ও স্কার্ফ ছেড়ে পাশ্চাত্য ঢঙের পোশাক পরা শুরু করে। খোলামেলা পোশাকে ছেলে বন্ধু ও প্রেমিকের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতো। এ কারণে কখনও কখনও তার মা বকা-ঝকা করতেন। স্কুলের কথা বলে সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে কখনও রাত ১০টা, কখনও ১১টায় ফিরতো। স্কুল ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দিতো ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে। যোগ দিতো ইয়াবা ও গাঁজার আসরে। যেতো ডিজে ও ড্যান্স পার্টিতে। শুধু তাই নয়, পার্টিতে অংশ নেয়া বন্ধু মহলের যাকে ভাল লাগতো, তার সঙ্গেই অন্তরঙ্গ সময় কাটাতো। সূত্র জানায়, এসব পার্টি ও আড্ডার আসরেই পরিচয় হয় পুরান ঢাকার ডিজে জনির সঙ্গে। তার সঙ্গে কিছুদিন মেলামেশার পর তারই বন্ধু রনির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায়। এই রনি ও জনির মাধ্যমেই মূলত নেশার জগতে প্রবেশ করে ঐশী। মাদক গ্রহণের পাশাপাশি অনিয়ন্ত্রিত যৌনাচারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সূত্রমতে, ঐশীর ডজনখানেক বয়ফ্রেন্ড রয়েছে। তাদের সঙ্গে নিয়মিত বিভিন্ন পার্টিতে অংশ নিতো। এর বাইরে তার আরও একজন প্রেমিক আছে। তার নাম পারভেজ। মূলত এই পারভেজের নির্দেশনা মোতাবেক ঐশী পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ঐশী জানায়, গত ৩১শে জুলাই তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় মা। তারপর থেকে বন্ধু মহলের সঙ্গে যোগাযোগে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। তখন তার কাছে নিজের পিতা-মাতাকেই প্রধান শত্রু বলে মনে হয়েছে। কখনও নিজেকে শেষ করা আবার কখনও পিতা-মাতাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে। এক পর্যায়ে ঐশী ১২ পৃষ্ঠার সুইসাইডাল নোট লিখে বাসায় রেখে দেয়। লাশ উদ্ধারের পর বিভিন্ন আলামতের পাশাপাশি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ঐশীর হাতের লেখা ওই চিঠি উদ্ধার করেছে। সেখানে তার জীবনের সুখ, দুঃখ ও কষ্টের কথা প্রকাশ করেছে। নিজেকে খারাপ প্রকৃতির মেয়ে হিসাবে দাবি করার পাশাপাশি কেউ তার কষ্ট বুঝতে চায়নি বলেও দাবি করেছে। আর এ কারণেই আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজেকে ঈশ্বরের কাছে সমর্পণের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেছে। অবশ্য ঐশী আত্মহত্যা না করে পিতা-মাতাকেই হত্যা করেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিকৃত যৌনাচার ও মাদক সেবনে অভ্যস্ত হওয়ায় ঐশী মানসিকভাবে অসুস্থ হয়েছিল। ফলে পিতা-মাতার মতো সবচেয়ে কাছের মানুষজনকে এত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতে পেরেছে। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকার চামেলীবাগের একটি ফ্ল্যাট থেকে মাহফুজ ও স্বপ্নার ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। দুই সন্তান ঐশী ও ঐহী এবং গৃহকর্মী সুমিকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাটে থাকতেন তারা। ঐশী বৃহস্পতিবার সকালে তার সাত বছর বয়সী ছোট ভাই ঐহী ও গৃহকর্মী সুমিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। দুই দিন নিখোঁজ থাকার পর শনিবার নিজেই পুলিশের কাছে ধরা দেয়। এরপর তাকে নিয়ে অভিযান চালিয়ে সুমি, রনিসহ মোট পাঁচজনকে আটক করে পুলিশ। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ জানান, নিহত পুলিশ কর্মকর্তার দেহে ছুরিকাঘাতের দু’টি এবং তার স্ত্রীর দেহে ১১টি চিহ্ন পাওয়া গেছে। হত্যার আগে পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজ ও তার স্ত্রীকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিল ঐশী।
লাশ থেকে গহনা খুলে নেয় ঐশী: গোয়েন্দারা জানান, নিজের পিতা-মাতাকে খুন করেই ক্ষান্ত হয়নি ঐশী। নিথর ও রক্তাক্ত মায়ের শরীর থেকে গহনাও খুলে নিয়েছে। রান্নাঘর থেকে বঁটি এনে স্বপ্না রহমানের কোমরে থাকা বাসার চাবির গোছা কেটে নেয়। এরপর একে একে কানের দুল, গলার চেইন, হাতের বালা ও নাকফুল খুলে নেয়। আলমারিতে রক্ষিত আরও স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে ব্যাগে ভরে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। সূত্র জানায়, বুধবার দিবাগত রাত ২টার দিকে ঐশী একাই তার পিতা-মাতাকে কুপিয়ে হত্যা করে। হত্যার আগে সন্ধ্যার পর মা’র জন্য তৈরি করা কফিতে ঘুমের ট্যাবলেট মিশিয়ে দেয়। মা ঘুমিয়ে পড়লে তার সঙ্গেই শুয়ে থাকে ঐশী। রাত ১১টার পর তার পিতা বাসায় ফিরলে তাকেও ঘুমের ট্যাবলেট মিশ্রিত কফি খেতে দেয়। তিনিও ঐশীর বেডরুমে ঘুমিয়ে পড়েন। এরপর রাত ২টার দিকে ঐশী খঞ্জর টাইপের একটি ধারালো ছুরি নিয়ে ঘুমন্ত মায়ের ওপর হামলে পড়ে। প্রথম কোপেই তার মা জেগে ওঠেন। নিজ মেয়ের এমন বর্বরতা দেখে বলতে থাকেন ‘তুই আমার মেয়ে না?’ তাই বলে ঐশীর ছুরি থামেনি। এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। একপর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে যান মা। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ছোট ছেলে ঐহী মায়ের সঙ্গেই ঘুমিয়ে ছিল। হত্যাকাণ্ডের সময় সে জেগে ওঠে। তখন ঐশী তাকে ধরে নিয়ে বাথরুমে আটকে রাখে। এরপর পিতার গলায় খঞ্জর চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। পরে কাজের মেয়ে সুমির সহায়তায় তাদের লাশ কাপড়ে মুড়িয়ে টেনেহিঁচড়ে বাথরুমে নিয়ে ফেলে রাখে। দু’জনে মিলেই রক্তাক্ত ঘর ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে। এরপর নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ব্যাগে ভরে ছোট ভাই ঐহী ও কাজের মেয়েকে নিয়ে বাইরে যায়। সূত্র আরও জানায়, বৃহস্পতিবার রাতে তার বান্ধবী তৃষার বাসায় ছিল। পর দিন শুক্রবার রনির এক খালার বাসায় অবস্থান করে। পরে প্রেমিক পারভেজের নির্দেশনা মোতাবেক শনিবার পল্টন থানা পুলিশের কাছে ধরা দেয়।

No comments

Powered by Blogger.