সহিংসতার কবলে অর্থনীতি

দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা-সংঘাত বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সহিংসতা। জ্বালাও-পোড়াও আর ভাঙচুর প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে উঠেছে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যেও বড় ধরনের আঘাত নেমে এসেছে। সাম্প্রতিক সহিংসতার প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক স্থাপনাগুলো। এমনভাবে সহিংসতা করা হচ্ছে যেন ব্যবসা-বাণিজ্য বাধাপ্রাপ্ত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ধ্বংস হয়, ব্যাহত হয় যোগাযোগব্যবস্থা। এর মধ্য দিয়ে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও আক্রান্ত হচ্ছে। বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। সর্বশেষ গত রোববার রাজধানীতে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে যেভাবে ছোট-বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট ও ব্যাংক-বিমায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে অনেকটা পরিকল্পিতভাবেই অর্থনীতিকে পঙ্গু করার পথ বেছে নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।  বস্তুত কয়েক মাস ধরে হরতাল-অবরোধসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি যেভাবে বিস্তার লাভ করেছে, তাতে ভবিষ্যতে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কাই জোরদার হয়েছে। এর জন্য অনেক বেশি মাশুল গুনতে হবে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিকে। এমনিতেই সরকারের ক্ষমতার শেষ ভাগে এসে মূলত অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাজনিত অদক্ষতা-দুর্বলতার প্রভাবে অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। একের পর এক কেলেঙ্কারি আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা নষ্ট করে দিয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার নিম্নমুখী হয়ে গেছে। চলতি অর্থবছর শেষে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা তো অর্জিত হবেই না, বরং তা সাড়ে ৬ শতাংশের নিচেও নেমে আসতে পারে। দেশি-বিদেশি একাধিক প্রতিষ্ঠান এ রকম পূর্বাভাসই দিয়েছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি, বিশেষত খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। এটা নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। রপ্তানি আয়ও অর্থবছরের ১০ মাস ধরে লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারছে না। এই অবস্থায় এক হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের রেকর্ডে তুষ্টি খোঁজা অর্থহীন।  গতি-মন্থর অর্থনীতিতে সহিংসতার আগুন আগামী দিনে নতুন বিনিয়োগ তো আনবেই না, বরং বিদ্যমান বিনিয়োগ ধরে রাখাকেই ঝুঁকির মুখে ফেলবে। অন্যদিকে ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কার্যত পথে বসে গেছেন। এই বিপর্যয় তাদের নিম্ন জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলবে। আবার হামলা-ভাঙচুর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে বাড়তি ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। এটা ব্যবসার ব্যয় বাড়িয়ে দেবে।  এই বাস্তবতায় সরকারের প্রথম করণীয় হবে, মতিঝিলের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক-বাণিজ্য এলাকায় কোনো ধরনের সমাবেশ করতে না দেওয়া। ব্যবসায়ীদের তরফেও অনুরূপ অনুরোধ ছিল। তাতে কর্ণপাত না করে প্রথমে বিএনপি, পরে হেফাজতে ইসলামকে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া মারাত্মক ভুল বলেই আমাদের ধারণা। অন্য জায়গায় সমাবেশ করলে যে সহিংসতা হতো না, তা জোর দিয়ে বলা যায় না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারের আগাম সতর্কতা ও প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ প্রয়োজন হয়। দ্বিতীয়ত, সব রাজনৈতিক দলের উচিত হবে এমনভাবে কর্মসূচি পরিচালনা করা, যেন ব্যবসা-বাণিজ্যে, মানুষের জীবিকা নির্বাহে আঘাত না আসে। এ জন্য দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.