টনক নড়েছে পুলিশে: আরএমপিতে ব্যাপক রদবদলের আভাস by শরীফ সুমন

পর পর দুই কর্মকর্তা ছাত্রশিবিরের হামলার শিকার হওয়ার পর অবশেষে টনক নড়েছে রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি)। গত দুই দিন থেকে র‌্যাবের সহায়তায় শিবির ক্যাডারদের গ্রেফতারে কোমর কষে মাঠে নেমেছে পুলিশ।
সারাদিন তো বটেই, রাতেও চষে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন এলাকার মূল সড়ক থেকে অলি-গলিতে। সারাদিন হরতালসহ নানা কর্তব্য পালনের পর গভীর রাতের অভিযানের স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে মহানগরের চার গুরুত্বপূর্ণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি)।

এর উপর রাজশাহীতে একের পর এক পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যকে রাস্তায় ফেলে শিবিরের পেটানোর ঘটনায় ঢাকা সদর দপ্তর নাখোশ হওয়ায় কিছুটা চাপের মুখে পড়েছেন রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার। মহানগর পুলিশের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছেন।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সাম্প্রতিক খবর, সংঘর্ষের ঘটনা মোকাবেলা, বিভিন্ন এলাকা থেকে শিবির সন্দেহে আটক, আটকের পর থানা থেকে মুচলেকা নিয়ে ছাড়, প্রকৃত শিবির কর্মীদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়া এবং হামলার মুখে পড়া কর্মকর্তা-সদস্যদের প্রটেকশনে এগিয়ে না গিয়ে অন্যদের পালিয়ে যাওয়া, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ভূমিকা নিয়েও নানা বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।

গুঞ্জন উঠেছে এসব কারণে যে কোনো সময় ঢাকা সদর দপ্তর থেকে রাজশাহী মহানগর পুলিশে বড় ধরনের রদবদলের নির্দেশ আসতে পারে। এরই মধ্যে পুলিশ পরিদর্শক থেকে সদ্য সহকারী কমিশনার পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত পাঁচজনকে রাজশাহী মহানগর পুলিশে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে।

তারা যে কোন সময় কাজে যোগ দিলে এমনিতেই মহানগর পুলিশের বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে থাকা কর্মকর্তাদের দায়িত্বে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। এর মধ্যে যে পাঁচজনের নাম শোনা গেছে তারা হলেন- সদ্য পুলিশ পরিদর্শক থেকে সহকারী কমিশনার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত মো. সাজ্জাদ হোসেন, অহিদুল ইসলাম, আবদুল নূর, মতিয়ার রহমান ও মো. শহিদ সরওয়ার্দি।     

এদিকে, গত দুই দিন থেকে মহানগর পুলিশের চার থানার ওসির রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। নাশকতা ঠেকাতে র‌্যাবের সহায়তায় মঙ্গলবার রাতভর অভিযান চালিয়ে মহানগরীর সপুরা এলাকার একটি ছাত্রবাস থেকে ককটেল, ১১টি চাইনিজ কুড়াল, শিবিরের গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু কাগজপত্র উদ্ধার করেছে। সেখান থেকে ছাত্রাবাস মালিক শাহাবুদ্দিন বাপ্পীসহ আটক করা হয়েছে ৩০ জনকে।

এর মধ্যে আটক বাপ্পী গত সোমবার মহানগরীর শালবাগান এলাকায় পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছেন মহানগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউর রহমান জিয়া।

পুলিশের দাবি, ছাত্রাবাসটি শিবিরের আস্তানা ছিল। এখান থেকে শিবির গোপন কর্মকা- পরিচালনা করতো। পরে ওই এলাকার আরও কয়েকটি ছাত্রাবাসে অভিযান চালায় র‌্যাব ও পুলিশ। এসময় শিবির সন্দেহে আরও ২৯ জনকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

এর আগে গত সোমবার রাজশাহীতে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে মহানগর জামায়াতের প্রচার সম্পাদক শাহাদৎ হোসেনকে আটক করে র‌্যাব সদস্যরা। মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটার দিকে র‌্যাব-৫ এর রাজশাহীর রেলওয়ে কলোনি ক্যাম্পের একটি অপারেশন দল মহানগরীর আলুুপট্টি এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করে।

তিনি মহানগরীর সাগরপাড়া এলাকার মাইন উদ্দিন শেখের ছেলে। এছাড়া মহানগরীর বহরমপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে একই ঘটনায় জড়িত থাকায় বহরমপুর এলাকার জামায়াত কর্মী আজাহার আলীকে (৪৫) গ্রেফতার করা হয়। পরে আটককৃতদের বোয়ালিয়া থানায় সোপর্দ করা হয়।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলন করে রাজশাহীতে জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসী তৎপরতা রুখে দিতে নাগরিকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন, রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার এস.এম মনির-উজ-জামান। বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় আরএমপি সদর দফতরে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

মহানগর পুলিশ কমিশনার বলেন, এসআই জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলায় জড়িত ২৬ জনকে তারা এরই মধ্যে শনাক্ত করতে পেরেছেন। বর্তমানে তাদের গ্রেফতারে মাঠে রয়েছেন পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। এছাড়া শাহাদৎ হোসেন নামে একজনকে মঙ্গলবার রাতে গ্রেফতার করা হয়েছে। হামলায় কারা অংশ নিয়েছিল সে সম্পর্কে শাহাদৎ তথ্য দিয়েছে বলে জানান পুলিশ কমিশনার। এছাড়া সার্বিক বিষয়গুলি মনিটরিং করে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

প্রসঙ্গত, রাজশাহী মহানগরীতে গত তিন মাসে পুলিশের ওপর ৪০ বার হামলা করেছে জামায়াত-শিবির। এতে পুলিশের প্রায় ৫০ জন সদস্য আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে মতিহার জোনের প্রফেশনাল উপ-পরিদর্শক (পিএসআই) মকবুল হোসেন ও সর্বশেষ এসআই জাহাঙ্গীর আলমের নাম উল্লেখযোগ্য।

বোমার আঘাতে পিএসআই মকবুল হোসেনের দুই হাতের কব্জি উড়ে গেছে। এছাড়া জাহাঙ্গীর আলম মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। তাদের দুই জনকেই প্রথমে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমানে করে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) স্থানান্তর করা হয়। তারা বর্তমানে সেখানে চিকিৎসাধীন।

কিন্তু এসব হামলা মোকাবেলায় পুলিশের কার্যকর ভূমিকা ছিল না। মুঠোফোনে খুদে বার্তায় কর্মীদের সংগঠিত করছে জামায়াত-শিবির। বিভিন্ন সময় আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে এমন সব চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু পুলিশ সেই পরিকল্পনার কথা আগাম জানতে না পারায় বারবার মার খাচ্ছে।

এর আগে গত ৬ নভেম্বর সাহেব বাজারে প্রথম অস্ত্র কেড়ে নিয়ে পুলিশ সদস্যকে পিটিয়েছিলো শিবির কর্মীরা। অস্ত্র কেড়ে নেওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সেই নেতার নাম শরীফুল ইসলাম ওরফে তুহিন। তার বাড়ি নাটোরের লালপুরে। পুলিশ এতদিনেও তাঁকে গ্রেফতার করতে পারেনি।

No comments

Powered by Blogger.