হঠাৎ উল্টে গেল রাজনীতি by সাজেদুল হক

আপনি কি ভাবতে পেরেছেন সব কিছু এত দ্রুত বদলে যাবে। কিন্তু রাজনীতি এমনই। কখনও কখনও তা বদলায় অতিদ্রুত। শাহবাগ অভ্যুত্থানের শুরুর দিকে মনে হচ্ছিলো বাংলাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র একটাই। ’৭১-এর রেসকোর্স যেন ফিরে এসেছিল শাহবাগে।
বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতীয় মিডিয়াতেও এমনটাই বলা হচ্ছিলো। ঘোষণা দেয়া হল দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের। কেউ একবার ভাবলেন না স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয় না। মুক্তিযুদ্ধের কঠিন দিনগুলোতে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশারফ ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা যোদ্ধাদের এই বলে উদ্বুদ্ধ করতেন- স্বাধীন দেশ কোন জীবিত গেরিলা চায় না, চায় রক্তস্নাত শহীদ। যাক দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই শাহবাগে সত্য বাবু মারা গেলেন। বিভক্ত মিডিয়ায় দেখা গেলো মিথ্যার কোরাসগীত। এটা সত্য শুরুর দিকে শাহবাগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হৃদয়ে ধারণ করা লাখো লাখো মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। কিন্তু এক সময় প্রশ্ন উঠলো কার বিরুদ্ধে এ আন্দোলন? কোন ‘ঈশ্বর’ই বা যোগাচ্ছেন অর্থ, খাদ্য, পানীয়। তবে শাহবাগ সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেলো ব্লগার রাজীব ওরফে থাবা বাবার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর। দ্রুত এরজন্য দায়ী করা হলো জামায়াত-শিবিরকে। প্রধানমন্ত্রী ছুটে গেলেন তার বাসায়। জাতীয় বীরের মর্যাদা দেয়া হলো তাকে। সংসদে বলা হলো, দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ রাজীব। তবে বসে ছিল না ভিন্নমতের মিডিয়া। পত্রিকায় প্রধান শিরোনামে খবর বেরুলো নিহত রাজীব ছিলেন প্রচণ্ড ধর্মবিদ্বেষী। নিজ ব্লগে আল্লাহ এবং রাসুল (সা.) এর বিরুদ্ধে লিখতেন তিনি। এ সংবাদ প্রকাশের পর পরিস্থিতি বদলাতে থাকে অতিদ্রুত। মঞ্চে আবির্ভূত হন অশীতিপর বৃদ্ধ সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম আল্লামা আহমদ শফি। তার নেতৃত্বাধীন হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে রাস্তায় নেমে আসে ধর্মপ্রাণ মানুষ। এরইমধ্যে পর্দার আড়ালে আলোচনা চলে একটি রায়কে কেন্দ্র করে। সম্ভবত এটিই ছিল সবচেয়ে স্পর্শকাতর রায়। তখনই এ রায় নিয়ে উৎসাহি ছিলেন না ‘শীর্ষ ব্যক্তি’। আরও দেখার পক্ষে ছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে বুঝানো হলো এখনই সময়। শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ। সারাদেশ আমাদের পক্ষে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সায় দিলেন তিনি। রাজনীতির গণেশ একেবারে উল্টে গেল ২৮শে ফেব্রুয়ারি। যেদিন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সহিংস বিক্ষোভ প্রদর্শন করলো জামায়াত-শিবির। যে বিক্ষোভে বহু আমজনতাও যোগ দেয়। এবং সম্ভবত এই প্রথম জামায়াত-শিবির তৃণমূলে প্রবেশ করলো। তিন দিনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারালেন শতাধিক মানুষ। সিঙ্গাপুরে থাকা খালেদা জিয়া সিদ্ধান্ত নিলেন অতিদ্রুত। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে নেমেই তিরস্কার করলেন দলের শীর্ষ নেতাদের। পুলিশের গুলিতে নিহতের ঘটনাকে গণহত্যা আখ্যা দিয়ে ডাক দিলেন লড়াইয়ের। ক্রমেই ম্লান হতে থাকলো শাহবাগ।
তবে আপনি ভেবে অবাক হবেন এই শাহবাগকে ঘিরেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটে গেছে এক বিস্ময়কর ঘটনা। বাংলাদেশের প্রধান চারটি রাজনৈতিক দল এই একটি প্রশ্নে আজ প্রায় একই বিন্দুতে অবস্থান করছে। শুরুর দিন থেকেই জামায়াত শাহবাগের বিরুদ্ধে। যা খুবই স্বাভাবিক। প্রথমদিকে বিএনপি ছিল হতচকিত। কিন্তু মার্চের শুরুতে খালেদা জিয়া স্পষ্ট ভাষাতেই মঞ্চ বন্ধের ডাক দেন। সুচতুর এরশাদও চট্টগ্রামে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, গণজাগরণ মঞ্চ বন্ধ করে দেয়ায়। সর্বশেষ নাটকীয় আলোচনা হয়-আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি বৈঠকে। যে বৈঠকে গণজাগরণ মঞ্চ বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে মত আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন-আবেগ দিয়ে রাজনীতি হয় না।
প্রধান চারটি রাজনৈতিক দলই যখন গণজাগরণ মঞ্চ বন্ধের পক্ষে তখন কি বলছেন এ মঞ্চের উদ্যেক্তারা। মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার স্পষ্ট করেই বলেছেন, গণজাগরণ মঞ্চ কোন রক্তচক্ষুকে ভয় পায় না। কাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এ তরুণ চিকিৎসক। তবে তার ক্ষমতার উৎস কোথায়? দরজার ওপাশে?
রাজনীতির চাকা ঘুরছে অতিদ্রুত। ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে পরিস্থিতি। আপাত মনে হচ্ছে চালকের আসনে হেফাজতে ইসলাম। তবে নাটকীয়তা এখনই শেষ হবে না। সামনের দিনগুলো অনিশ্চিত এবং উদ্বেগের। শেখ হাসিনা তার এজেন্ডা বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টাই করবেন। জামায়াত-শিবিরের চেষ্টা থাকবে ইতিহাসের গতি বদলানোর। পরিস্থিতির সর্বোচ্চ সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করবেন খালেদা জিয়া। আমরা যারা বোকা জনগণ অপেক্ষা ছাড়া আমাদের আর কি ই বা করার আছে। অপেক্ষাই আমাদের নিয়তি।

No comments

Powered by Blogger.