হেফাজতে ইসলামের লং মার্চে সমর্থন- প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাওয়ের ঘোষণা ইসলামী আন্দোলনের

নাস্তিক ব্লগারদের গ্রেপ্তার ও সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে আল্লামা শফীর নেতৃত্বাধীন হেফাজতে ইসলামের ডাকা লং মার্চের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে ইসলামী আন্দোলন। এছাড়া ব্লগারদের শাস্তিসহ ৫ দফা দাবিতে আগামী ২৫শে এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করার কর্মসূচি দিয়েছে সংগঠনটি।
গতকাল রাজধানীর মতিঝিলে লাখো মানুষের এক সমাবেশে দলের আমীর ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম এ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ৫ই এপ্রিলের মধ্যে নাস্তিক ব্লগারদের গ্রেপ্তার করা না হলে ৬ই এপ্রিল আল্লামা শফী আহূত ঢাকা আভিমুখী লংমার্চে অংশ নেবে তার দলের নেতাকর্মীরা। এছাড়া মায়ানমারে মুসলিম নিধন বন্ধের দাবিতে ৪ঠা এপ্রিল ঢাকাস্থ জাতিসংঘের কার্যালয়ে স্মারকলিপি পেশ, ৮ ও ৯ই মে মায়ানমার অভিমুখে লংমার্চের কর্মসূচি ঘোষণা করেন চরমোনাই পীর। তিনি বলেন, দেশের টুপি-দাড়িওয়ালা সবাই জামায়াত-শিবির নয়। জামায়াত-শিবিরের নামে টুপি-দাড়ির অসম্মান করা চলবে না। ইসলামী আন্দোলনের আমীর বলেন, তথাকথিত জিহাদি বইয়ের নাম করে নিরপরাধ মানুষকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। নাস্তিক ব্লগারদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়ে চরমোনাই পীর বলেন, জাতীয় সংসদে ইসলাম সম্পর্কে কটূক্তিকারীদের প্রতিহতের আইন করতে হবে। অন্যথায় তৌহিদী জনতা ইসলামের প্রতি কটূক্তিকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করবে বলেও তিনি সরকারকে হুঁশিয়ার করেন। জুমার নামাজের পর আনুষ্ঠানিকভাবে এ মহাসমাবেশ শুরু হয়। তবে সকাল ৯টা থেকেই সমাবেশস্থল লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। সারা দেশ থেকে হাজার হাজার লোক এ সমাবেশে যোগ দেন। এতে শাপলা চত্বর থেকে দক্ষিণে ইত্তেফাক মোড়, উত্তরে নটর ডেম কলেজ, পশ্চিমে দৈনিক বাংলা মোড়, ফকিরেরপুল পানির ট্যাংকি হয়ে পুরানা পল্টন মোড় পর্যন্ত কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। এসব এলাকায় সকাল থেকেই যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন, আল্লাহ ও রাসুল (সা.) এর দুশমন নাস্তিক মুরতাদদের শাস্তির আইনি ব্যবস্থা, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন, সুশাসন-ন্যায়বিচার ও সন্ত্রাস-দুর্নীতির মূলোৎপাটনসহ দেশে স্থায়ী শান্তি ও মানবতার সার্বিক মূল্য সমৃদ্ধশালী কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন এবং ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে এ মহাসমাবেশের আয়োজন করে ইসলামী আন্দোলন। দলের আমীর মাওলানা মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঈমান ও দেশ বাঁচাতে এ মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছিলেন। দলীয় ফোরামে পল্টন মোড়ে মহাসমাবেশ করার সিদ্ধান্ত হলেও পল্টন থানা সমাবেশের অনুমতি দেয়নি। তবে শেষ মুহূর্তে মতিঝিল শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার অনুমতি দেয় পুলিশ। এ ব্যাপারে মতিঝিল থানার ওসি হায়াতুজ্জামান বলেন, সমাবেশকারীরা আমাদের কথা দিয়েছেন তারা কোন অনাকাঙিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টি করবেন না। তাই তাদের সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। নিরাপত্তার  বিষয়টি মাথায় রেখেই কিছু রাস্তা বন্ধ রাখা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। চরমোনাই পীর বলেন, স্বাধীনতার পর বিগত সরকারগুলো দেশকে তলাবিহীন রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। দেশের সকল সেক্টরকে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য বানানো হয়েছে। দেশের অবস্থা আজ বড়ই নাজুক। জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও অসৎ উদ্দেশে  রাজনৈতিক হীনস্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। মানবসেবার খাতগুলোতে দুর্নীতি মহামারী আকার ধারণ করেছে। দুদক চেয়ারম্যান বলেছেন, দুর্নীতি ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে। অস্থায়ী  প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় সংসদের স্পিকার বলেছেন, দেশে প্রতিবছরে যে দুর্নীতি হয়, তাতে একটি করে পদ্মা সেতু হয়। তিনি বলেন, দুর্নীতির এ ধারা ৩০-৩৫ বছর ধরে চলে আসছে। টিআইবি রিপোর্টে এসেছে শতকরা ৯৭ ভাগ এমপি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। শেয়ার বাজার, হলমার্ক, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। বিদেশীরা বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা তাদের বিনিয়োগ গুটিয়ে নিচ্ছে। এছাড়াও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এবং দেশব্যাপী চরম নৈরাজ্য প্রমাণ করে দেশে গণতন্ত্রের নামে প্রচলিত রাজনীতি কলুষিত, নোংরা এবং বিষাক্ত। এই কলুষিত এবং নোংরা রাজনীতির মূলোৎপাটন করতে না পারলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। বিশ্বের দরবারে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। এ ভয়াবহ দুরবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য দলমত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য বিরোধী জিহাদে অংশগ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, এদেশে হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান মিলেমিশে আমরা স্থাপন করেছি সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির এক অনন্য নজির। দেশের অধিকাংশ মানুষই সহজ-সরল, ধর্মপ্রাণ, অল্পে তুষ্ট ও সহিষ্ণু। এতকিছুর পরও বিশ্বে আজ আমরা একটি দরিদ্র, দুর্নীতিগ্রস্ত, মিসকিন ও প্রাণ-স্পন্দনহীন পশ্চাৎপদ জাতি হিসেবে পরিচিত। আমরা আজ দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও ন্যায়বিচারের মতো মৌলিক অধিকার থেকে দেশের অধিকাংশ নাগরিকই বঞ্চিত। এখনও রাজধানী ঢাকায় অগণিত মানুষ ফুটপাতে ও বস্তিতে ঘুমায়। অথচ ক্ষমতাসীন দলগুলো দেশ-বিদেশ থেকে চার লাখ কোটি টাকা ঋণ আনল। প্রতিটি মানুষ গড়ে ২৮ হাজার টাকা ঋণে আবদ্ধ হলো। ক্ষমতাসীনরা দেশটাকে একটি দায়বদ্ধ দেশে পরিণত করল। এসব ঋণের টাকা কোথায় গেল? দেশের উন্নয়ন কতটুকু হলো আর ক্ষমতাসীনদের ভাগ্যের উন্নয়ন কতটুকু হলো দেশবাসী তা জানতে চায়। তিনি বলেন, এ কথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট, ক্ষমতাসীন দলগুলো শুধু ক্ষমতার জন্যই রাজনীতি করে। দেশ ও জনগণের জন্য রাজনীতি করে না। তারা যদি দেশ ও জনগণের জন্য রাজনীতি করত; তাহলে এত দুর্নীতি, সন্ত্রাস, খুন-হত্যা, নৈরাজ্য, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট করত না। তারা তাদের দলে দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিত না। দুর্নীতিবাজ, খুনি ও সন্ত্রাসীদেরকে রাজনৈতিক মামলা দেখিয়ে মুক্তি দিত না।
 চরমোনাই পীর উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, আপনাদের প্রতি আমার বিনীত আরজ, ভোট একটি পবিত্র আমানত। এই আমানতের খেয়ানত করলে কাল কেয়ামতে আল্লাহর কাছে জবাব দিতে হবে। অতএব, খারাপ মানুষকে ভোট দিবেন না। সৎ ও ভাল মানুষকে ভোট দেবেন। বিশেষ করে আমি আপনাদের কাছে ইসলামের পক্ষ্যে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীদেরকে হাতপাখা মার্কায় ভোট দিয়ে আপনাদের মূল্যবান ভোটের আমানত হেফাজত করার আহ্বান জানাচ্ছি। দেশের ভবিষ্যৎ প্রাণশক্তি ছাত্র-যুবসমাজের উদ্দেশে তিনি বলেন, কায়েমী স্বার্থবাদী শক্তিগুলো ক্ষমতার স্বার্থে অতীতে আপনাদেরকে বার বার ব্যবহার করেছে। একটি সুন্দর, সমৃদ্ধ ও আধুনিক দেশ গড়ার লক্ষ্যে এবং গণ-মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে অতীতে আপনারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-আন্দোলন, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রতিটি স্বৈরাচার ও দুঃশাসন বিরোধী আন্দোলনে আপনাদের রয়েছে এক ঐতিহাসিক বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা। তিনি বলেন, এখনও দেশের বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটায়। বেকারত্ব আজ প্রকট আকার ধারণ করেছে। জঠর জ্বালা নিবারণে অসহায় ও নিরূপায় মা তার আদরের সন্তানকে বিক্রি করার মতো ঘটনাও এদেশে ঘটছে। শুধু বেঁচে থাকার তাড়নায় এদেশের অনেক মা-বোনেরা বিপথগামী হচ্ছে। এসব মর্মস্পর্শী ঘটনা প্রায়ই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। অপর দিকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, হত্যা, ধর্ষণ, নারীনির্যাতন, অপহরণ, চাঁদাবাজী, কালোবাজারি, মুনাফাখোরি, ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি, জালিয়াতি ও প্রতারণার ঘটনাও দিন দিন বেড়েই চলছে। যানজট, বিদ্যুৎ সঙ্কট, সার সঙ্কট আজ দিন দিন প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নামে ক্যাডাররা প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে এবং মানুষ হত্যা করছে। ছাত্রাবাসগুলো মিনি ক্যান্টনমেন্টে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলগুলোই এদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এছাড়াও চলছে ভর্তি বাণিজ্য। এক কথায় শিক্ষায় সর্বত্র চলছে চরম নৈরাজ্য। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকে ইসলামকে বিকৃতিরূপে উপস্থাপন করা হচ্ছে। নৈতিক শিক্ষার নামে তাদেরকে অবাধ যৌনাচারের প্রতি উৎসাহিত করা হচ্ছে। সরকারের নীরবতার সুযোগে অনেক শিক্ষক আজ শ্রেণীকক্ষে ইসলাম, রাসুল (সা.) কে নিয়ে কটাক্ষ করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। মাওলানা আহমাদ আবদুল কাইয়ুম, মাওলানা নেছার উদ্দিন, কে এম আতিকুর রহমান ও মাওলানা লোকমান হোসাইন জাফরীর পরিচালনায় মহাসমাবেশে বক্তব্য রাখেন, ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানী, মুফতি সৈয়দ মো. ফয়জুল করীম, মাওলানা নূরুল হুদা ফয়েজী, শাইখুল হাদিস  আল্লামা মোস্তফা আল হোসাইনী, মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ, যুুগ্ম মহাসচিব অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, সহকারী মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, মাওলানা আবদুল হক মুহাদ্দিছ, মাওলানা আবদুল কাদের, অধ্যাপক মাওলানা এটিএম হেমায়েত উদ্দিন, চরমোনাই ইউপি চেয়ারম্যান সাহেবজাদা মুফতি সৈয়দ মো. আবুল খায়ের, সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক সৈয়দ বেলায়েত হোসেন, মাওলানা ইমতিয়াজ আলম, আলহাজ হারুনুর রশিদ, এডভোকেট আবদুল মতিন প্রমুখ। আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন আইম্মাহ পরিষদের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা সাদেক আহমাদ সিদ্দিকী, দারুল মাআরিফ চট্টগ্রামের সহকারী মহাপরিচালক মাওলানা জসিম উদ্দিন নদভী, হাফেজ্জী হুজুরের জামাতা মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ। মাওলানা মাদানী বলেন, রাসুল কর্তৃক অভিশপ্ত নারী নেতৃত্বের কবল থেকে মুক্ত না হলে দেশ ও জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন আসবে না। তিনি সকলকে দেশের স্বার্থে যোগ্য নেতৃত্ব বাছাই করার আহ্বান জানান। মুফতি ফয়জুল করীম বলেন, সকল আন্দোলন-সংগ্রামে ওলামায়ে কেরামের জীবন ও রক্ত ঝরলেও এর ফল ভোগ করেছে তাগুতী শক্তি। সরকার শাহবাগীদের মাধ্যমে অবাধ যৌনাচার ও লিভ টুগেদার উস্কে দিচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ইসলামের বিরুদ্ধে যে কোন চক্রান্ত বন্ধ না করলে ইসলামী জনতা রাজপথে নেমে আসলে আপনার আখের রক্ষা হবে না। সমাবেশে দলের মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, ভ্রান্ত ধারণায় বিশ্বাসী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে থাকা আর অন্যায়ের সঙ্গে থাকা একই কথা। তিনি বলেন, জামায়াত মওদুদীর মতবাদে বিশ্বাসী। আর এ মতবাদের মাধ্যমে সঠিক ইসলাম জানা সম্ভব নয়। তাই এ মতবাদে ইসলাম প্রচার করা বন্ধ করতে হবে। জামায়াত-শিবির সারা দেশে নৈরাজ্য করছে তা ইসলামের অবমাননা এবং এই দায় অন্য দলগুলোর ওপর পড়ছে। এ কারণে তাদের পরিত্যাগ করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.