চাঁপাই নবাবগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জে পুলিশের গুলিতে নিহত ৫

সিরাজগঞ্জের বেলকুচি ও চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে জামায়াত-পুলিশ সংঘর্ষে গুলিতে ৫ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে চাঁপাই নবাবগঞ্জে ৩ জন ও সিরাজগঞ্জে ২ জন। এ নিয়ে সেখানে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে।
বেলকুচির সংঘর্ষে পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা। জামায়াতের সঙ্গে যোগ দেয় বিএনপি কর্মীরা। অন্যদিকে শিবগঞ্জে ঘুমন্ত গ্রামবাসীর ওপর পুলিশ গুলি চালায়। প্রতিবাদে রোববার চাঁপাই নবাবগঞ্জ  ও সিরাজগঞ্জে হরতাল আহ্বান করেছে ১৮ দলীয় জোট। মো. তারেক রহমান, শিবগঞ্জ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) থেকে জানান, সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার গভীর রাতে শিবগঞ্জ পুলিশ শ্যামপুর ইউনিয়ন এলাকায় পল্লী বিদ্যুতে অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আসামি গ্রেপ্তার করতে ওই এলাকায় অভিযান চালানোর সময় গ্রামবাসী জানতে পেরে হৈচৈ চিৎকার শুরু করে। এ সময় পুলিশ গ্রামবাসীর উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা ছিল বলে গ্রামবাসী জানায়। এলাকাবাসী জানান, খুব ভোরে পুলিশ, র‌্যাব এবং বিজিবি। আসামি ধরার নাম করে আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ঘুমন্ত গ্রামবাসীর ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় উমরপুর গ্রামের হাকিমুদ্দীনের ছেলে শরৎনগর দাখিল মাদরাসার দশম শ্রেণীর ছাত্র অলিউল (১৬), শ্যামপুর গোপালনগর গ্রামের জিল্লুর রহমানের ছেলে মতিউর রহমান (৪৫) ও বাবুপুর গ্রামের ভাদু মণ্ডলের ছেলে রবিউল (২৫)। নিহতরা বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক। পুলিশের নির্বিচার গুলিতে ওই এলাকার শতাধিক মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছে। শ্যামপুর গোপালনগর গ্রামের আবদুল মালেক সাংবাদিকদের জানান, রাত আড়াইটায় বিনোদপুরের দিক থেকে প্রায় ৩০-৩৫টি পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবের গাড়ির বহর শ্যামপুর ইউনিয়নে প্রবেশ করে। পুলিশদের সঙ্গে সশস্ত্র আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীও ছিল। এ সময় আওয়ামী লীগ কর্মীরা পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে নিজেরাই মানুষের ওপর গুলি ছুঁড়তে থাকে বলে গ্রামবাসী জানান। অন্যদিকে গস্খামবাসী  গুলির খোসা দেখিয়ে ওই এলাকায় উপস্থিত হওয়া সাংবাদিকদের জানান, নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করেছে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ কর্মীরা। গ্রামবাসী আরও জানায়, পুলিশের গুলির শব্দ শুনে ঘুমন্ত গ্রামের মানুষেরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে গিয়ে শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। অপরদিকে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, পুলিশ আসামি ধরতে গেলে গ্রামবাসী  পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এলাকায় অভিযান চালানোর সময় পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাবের নেতৃত্বে ছিলেন ৮ জন ম্যাজিস্ট্রেট। অন্যদিকে পুলিশের অপারেশনের আরেকটি দল কানসাট হয়ে শ্যামপুরের দিকে প্রবেশের চেষ্টা করলে কানসাট ব্রিজের কাছে রাস্তা কেটে ব্যারিকেড থাকায় ও জনরোষের কারণে প্রবেশ করতে পারেনি শ্যামপুর এলাকায়। ওই দলটি কানসাট ব্রিজের পূর্বপাশে অবরুদ্ধ হয়ে যায়। সকালে তারা ওই খাল ভর্তি করে এগুতে থাকে শ্যামপুর ইউনিয়নের চামাহাট এলাকার দিকে। এ সময় ওই টহল দলটি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ১৩ জনকে আটক করে বেধড়ক মারপিট শুরু করে। যাদের আটক করা হয়েছে- নাজির, আসাদুল, বাদশা, নেতাউর, মফিজ, সবুর, রবিউল, শামীম, বাবু, আতাউর ও মুরাদ। পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওই দলটি শ্যামপুরের চামাহাট হয়ে বিনোদপুর খাসেরহাট দিয়ে মনাকষা-শিবগঞ্জ ফিরে আসে। শিবগঞ্জ থেকে ওই অপারেশন দলটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ যাওয়ার পথে কোন কারণ ছাড়াই রানিহাটি বাজার ও কলেজের কাছে এলোপাতাড়ি ফাঁকা গুলি ছুড়ে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। এ ঘটনার পর সমগ্র শিবগঞ্জ উপজেলাসহ আশপাশের উপজেলা গুলোতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন স্থানে এ ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ লোকজন জমায়েত হয়ে ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে থাকে। এ ঘটনার পর থেকে সমগ্র জেলায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি টহল দিচ্ছে। ঘটনার প্রতিবাদে ১৮দলীয় জোট আজ শনিবার দোয়াদিবস ও কাল রোববার জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে। শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার ফরহাদ আহমেদ বলেন, তাকে এ সম্পর্কে অবহিত করা হয়নি।
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির জেলা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক শাহজাহান মিঞা ও ১৮ দলের নেতাকর্মীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে লাশ ময়না তদন্তের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। অধ্যাপক শাহজাহান মিঞা ও জামায়াতের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ শিবগঞ্জের শ্যামপুর গ্রামে আসামি ধরার নামে নির্বিচারে গুলি করে হত্যার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করার জন্য দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে ঘটনার সময় যেসব আওয়ামী ক্যাডার পুলিশের সঙ্গে থেকে গুলি করেছে তাদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান। অন্যদিকে অধ্যাপক শাহজাহান মিঞা শ্যামপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত মতিউর, অলিউল ও রবিউলের বাসায় গিয়ে তাদের পরিবারকে সান্ত্বনা দেন এবং যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার হবে বলেও তিনি আশ্বস্ত করেন।
ইসরাইল হোসেন বাবু, গোলাম মোহাম্মদ রুবেল, বেলকুচি (সিরাজগঞ্জ) থেকে জানান, বেলকুচিতে আসামি ধরতে গিয়ে পুলিশ, জামায়াত-বিএনপি ও আওয়ামী লীগের চর্তুমুখী সংঘর্ষে ২ জন নিহত, ২০ জন গুলিবিদ্ধ ও দু’সাংবাদিকসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। গতকাল সকাল ৯টার দিকে উপজেলার ধুকুরিয়া বেড়া ইউনিয়নের  মৌপুর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলো- ধুকুরিয়া বেড়া ইউনিয়নের সর্বতুলশী গ্রামের মৃত আবদুল মজিদের ছেলে শ্রমিকদল কর্মী তাঁত শ্রমিক ফরিদুল ইসলাম (১৮) এবং একই ইউনিয়নের কল্যাণপুর গ্রামের আবদুল হামিদের ছেলে ছাত্রদলকর্মী ইউনুছ আলী (১৭) নিহত হয়।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হরতালে নাশকতার অভিযোগে দায়ের করা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি মৌপুর গ্রামের জামায়াত কর্মী হাবিবুর রহমানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এ সময় বেশকিছু জামায়াত সমর্থক নেতাকর্মীর সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে পুলিশ হাবিবুরকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। এ ঘটনার পর মসজিদে মাইকিং করে মৌপুর, কল্যাণপুর, কান্দাপাড়া, সর্বতুলশী ও ধুলদিয়ারসহ আশপাশের গ্রামের শ’ শ’ জামায়াত-বিএনপি সমর্থক ঐক্যবদ্ধ হয়ে মিছিল বের করার চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশ বাধা দিলে জামায়াত-বিএনপি’র সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংবাদ পেয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা সেখানে গিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে বিটিভি’র সাংবাদিক ও কামারখন্দ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার গাজী এসএইচ ফিরোজী এবং মাইটিভি’র জেলা প্রতিনিধি রহমত আলী গুরুতর আহত হন এবং তাদের  মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়।  সংবাদ পেয়ে র‌্যাব ও অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ১৪৩ রাউন্ড টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। এ সময় অন্তত ২০ জন গুলিবিদ্ধ হয়। এদের মধ্যে তাঁত শ্রমিক ফরিদুল ইসলাম (১৮) এবং ৯ম শ্রেণীর ছাত্র ইউনুছ আলী (১৬) নিহত হন। সংবাদ পেয়ে জেলা প্রশাসক আমিনুল ইসলাম ও পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বেলকুচিতে যান। বিকালে নিহতের লাশ সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালে আনা হয়। আহতদের সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতাল, উল্লাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বগুড়াসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে এবং সাংবাদিক ফিরোজীর অবস্থার অবনতি হওয়ায় বিকালে তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। আহতদের মধ্যে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী ফজলুর রহমানও রয়েছেন। গুলিবিদ্ধদের মধ্যে বুদ্ধু, বাবু, কোরবান আলী, আজাহার, শরীফুল, নূর আলম ও অনিকের নাম জানা গেলেও অন্যদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। এদিকে, নিহতের ঘটনার প্রতিবাদে জামায়াত-বিএনপি’র নেতাকর্মীরা বিকালে কল্যাণপুর মাঠে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে। বিক্ষোভ শেষে নেতাকর্মীরা ওই এলাকায় লাঠিসোঁটা অবস্থান করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ওই এলাকায় যেতে পারছে না। এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এদিকে, নিহত ইউনুস আলীর বড় ভাই ইয়াকুব আলী, উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি আরিফুর রহমান সোহেল ও ধুকুরিয়া ইউনিয়ন বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক নুর-এ-আলম অভিযোগ করে বলেন, মৎস্য প্রাণী সম্পদমন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাসের নেতৃত্বে হামলা চালিয়ে ও গুলি করে দলের নেতাকর্মীদের হতাহত করা হয়েছে। মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, দায়িত্ব পালনকালে জামায়াত-বিএনপি নেতাকর্মীরা পুলিশের উপর হামলা চালায়। যে কারণে আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। ওই সময় আমি উপজেলা সদরের একটি অনুষ্ঠানে ছিলাম। তিনি আরও বলেন, পুলিশ জামায়াত কর্মী হাবিবুর রহমানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করার পর তারা আওয়ামী লীগ সমর্থক মামুন ও কাইয়ুমের বসতবাড়ি ভাংচুর করেছে। অপরদিকে, কর্তব্যরত সাংবাদিকের উপর হামলার তীব্র নিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে সিরাজগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিন অবিলম্বে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। সিরাজগঞ্জ সদর সার্কেল এএসপি কাজী এহসানুল কবীর জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ঘটনার এলাকা বাঁধে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েন রয়েছে।
এদিকে, বেলকুচিতে হতাহতের ঘটনার প্রতিবাদে বিকালে শহরে যুব ও ছাত্রদল মিছিল করেছে।
এদিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে আগামীকাল রোববার সিরাজগঞ্জ জেলায় অর্ধদিবস হরতাল ডেকেছে ১৮ দল। গতকাল সন্ধ্যার পর জেলা বিএনপি কার্যালয়ে এ ঘোষণা দেয়া হয়। জেলা বিএনপি’র যুগ্ম সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু জানান, সংঘর্ষে ছাত্রদলকর্মী স্কুলছাত্র ইউনুস আলী ও শিবিরকর্মী তাঁত শ্রমিক ফরিদুল ইসলাম নিহতের প্রতিবাদে ১৮ দলের পক্ষ থেকে এ কর্মসূচি দেয়া হয়েছে।  এর আগে হতাহতের ঘটনার প্রতিবাদে শহরে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে শহরে প্রতিবাদ মিছিল বের হয়।

No comments

Powered by Blogger.