পুরাতন ব্যান্ডরোল, হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি আকিজ বিড়ির by সেরাজুল ইসলাম সিরাজ

ব্যবহৃত ব্যন্ডরোল খোলা বাজার থেকে সংগ্রহ করে হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে শীর্ষ বিড়ি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আকিজ বিড়ি ফ্যাক্টরি লিমিটেড। সরকারের রাজস্ব ও শুল্ক বিভাগ (কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট এক্সেসরিজ) বিষয়টি অবগত।
তাদের চোখের সামনেই নির্বিঘ্নে এই ব্যবসা চালিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া আকিজের বিরুদ্ধে নকল ব্যান্ডরোল তৈরিরও অভিযোগ রয়েছে।

রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার আবীরের পাড়ায় অবস্থিত আকিজ বিড়ির কারখানা এলাকায় ঘুরে দেখা গেলো এ অপরাধের ভয়াবহ চিত্র। এই অনৈতিক ব্যবসার তত্ত্বাবধানে রয়েছেন আকিজ গ্রুপের আস্থাভাজন ও আকিজ বিড়ি ফ্যাক্টরি লিমিটেড’র ব্যবস্থাপক খান মজলিস।

খান মজলিসের ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল (আবীরের পাড়া গ্রামের বাসিন্দা)- “সরাসরি ফ্যাক্টরিতে ব্যান্ডরোল নেওয়া হয় না। বাজার থেকে সংগৃহীত পুরাতন ব্যান্ডরোল চলে যায় রংপুর জেলা সদরের গোডাউনে। সেখান থেকে ট্রাকযোগে কোম্পানিতে ঢুকানো হয়।”

খান মজলিসের ঘনিষ্ঠ ওই সূত্র বাংলানিউজকে জানান, “মাস কয়েক আগে একজন শ্রমিকের মাধ্যমে ব্যান্ডরোল জালিয়াতির কথা তিনি জানতে পারেন। তখন ব্যবস্থাপক খান মজলিসের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মজলিস তা অকপটে স্বীকারও করেন।”

মালিক পক্ষ বিষয়টি জানেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “খান মজলিস মালিকের খুব কাছের লোক। তিনি যেহেতু সরাসরি জড়িত তাই মালিক পক্ষ জানেন না এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন।”

খান মজলিসের তত্ত্বাবধানে ব্যবহৃত ব্যান্ডরোল সংগ্রহের জন্য বাজারে কিছু চোরা কারবারীকে নিয়োগ করা হয়েছে। তারাই এগুলো বাজারের খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন।

আকিজ বিড়ি ফ্যাক্টরি থেকে ৯ কিলোমিটার পূর্ব দিকে রসুলপুর গ্রামে প্রকাশ্যেই দোকানদারদের কাছ থেকে পুরনো ব্যান্ডরোল সংগ্রহ করে পুনঃব্যবহারোপযোগী করা হয়।

খুচরা বিড়ি বিক্রেতাদের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে এসব চোরাকারবারিদের। তারা প্যাকেটটি খোলার আগে ব্যান্ডরোলটি অক্ষত অবস্থায় বিশেষ কায়দায় খুলে ফেলেন। পরে সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে বাজার থেকে তা সংগ্রহ করা হয়। মাসে একেকজন চোরাকারবারী কোটি পিস পর্যন্ত ব্যান্ডরোল সরবরাহ করে থাকে। কেবল রংপুরেই নয় অন্যান্য কারখানাতেও একই কায়দায় এই ব্যান্ডরোল সংগ্রহের কাজ করে থাকে আকিজ বিড়ি।

প্রতিটি পুরাতন ব্যান্ডরোল ১০ পয়সা দরে বাজার থেকে সংগ্রহ করে চোরাকারবারীরা। আর  আকিজ কোম্পানি চোরাকারবারীদের থেকে প্রতি পিস ব্যান্ডরোল সংগ্রহ করে ১৫ থেকে ২০ পয়সা দরে। যার প্রতিটি রাজস্ব বিভাগ থেকে তুলতে হলে ১ দশমিক ২০ টাকা পরিশোধ করতে হয়। সে হিসেবে প্রতিটি ব্যান্ডরোলে ১ টাকা ৫ পয়সা করে হাতাচ্ছে এ বিড়ি কোম্পানিটি।

শুকুরের হাট বাজারের হামিদ মিয়া নামের এক পান-সিগারেটের দোকানির কাছে জানা গেল, তারা ১০ টাকা হাজারে লেবেল (ব্যান্ডরোল) দিচ্ছেন। এ থেকে বাড়তি আয় হয় মাসে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। এটুকু বাড়তি আয়ের জন্যই দীর্ঘদিন এ কাজ করছেন তিনি।

রসুলপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, বাজার থেকে পুরাতন বিড়ির প্যাকেট সংগ্রহের পর সামান্য পানি দিয়ে আলতো করে খুলে রোদে শুকানো হয়। যাতে সহজে অক্ষত অবস্থায় ব্যন্ডরোলটি তোলা যায় এ জন্য বিড়ি কোম্পানিগুলো প্যাকেটে আলতো করে লাগাচ্ছে ব্যান্ড রোল। পানির স্পর্শ ছাড়াই সহজেই তোলা যায় এসব ব্যান্ডরোল।

খুচরা বিক্রেতা থেকে সংগ্রহকারী পর্যন্ত পুরো ব্যবস্থাই নিয়ন্ত্রণ করছেন রসুলপুর গ্রামের মৃত কেরু মিয়ার ছেলে মান্নান ও সাহাব উদ্দিনের ছেলে আফজাল। এরা ছাড়াও আরও অনেকেই জড়িত এই ব্যান্ডরোলের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে। আর এসব করে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন তারা। এ ব্যবসা করেই আফজাল হোসেন এখন বড় একটি ধানের আড়তের মালিক।

রসুলপুর গ্রামের আকবর আলী নামের এক ব্যক্তি বাংলানিউজকে জানান, তিনি আগে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বেশ কয়েক বছর হলো ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন।

তিনি জানান, দিনে কয়েক লাখ পিস ব্যান্ডরোল সংগ্রহ করা কোন বিষয় নয়। মাসে এক কোটি ব্যান্ডরোল সংগ্রহ করাও কঠিন বিষয় নয়।

তিনি জানান, বাজার থেকে সংগৃহীত ব্যান্ডরোল পৌঁছে দেওয়া হয় কোম্পানির নির্দিষ্ট লোকের হাতে। মাঝ পথে পুলিশ বা কাস্টমস আটকালে কোম্পানির নাম বললেই ছেড়ে দেয়।

সম্প্রতি রংপুরে ৩০ লাখ পিস ব্যান্ডরোলসহ রসুলপুরের এক ব্যবসায়ী ধরা পড়ে কাস্টমস কর্মকর্তার হাতে। তখন কোম্পানির নাম বলা হলে কাস্টমস কর্মকর্তা ফোন দিয়ে কোম্পানির এক কর্মকর্তা ডেকে এনে এর রফা করেন।

ব্যান্ডরোল জালিয়াতি থেকে রক্ষা পেতে, অভিনব কৌশল নিয়েছে আকিজ গ্রুপ। তারা প্রকৃত উৎপাদন কম দেখাচ্ছে। যাতে রাজস্ব বিভাগ কাগজে কলমে ধরতে না পারে।

রংপুরের কারখানটিতে তাদের কাজ করছে প্রায় চার হাজারের মতো শ্রমিক। কিন্তু কাগজে কলমে দেখানো হচ্ছে মাত্র ৮২৪ জন। তাদের একেকজনকে একটি করে আইডি নম্বর দেওয়া হয়েছে।

একজনের আইডি নম্বর দিয়ে ৪ থেকে ৭ জন পর্যন্ত কাজ করছে। তারা প্রতিহাজার বিড়ি তৈরি করে ২২ টাকা দরে। এছাড়া বাইরে থেকেও কাগজ মুড়িয়ে নেওয়া হয় প্রতি হাজার ৯ টাকা দরে।

প্রত্যেক শ্রমিক দিনে ৮ থেকে ১১ হাজার বিড়ি তৈরি করতে সক্ষম। সে হিসেবে ৪ হাজার শ্রমিক দিনে ১৬ লাখ প্যাকেট (২৫ শলাকা) বিড়ি তৈরি করছে। যার বিপরীতে ১৯ লাখ ২০ হাজার টাকা রাজস্ব পরিশোধ করার কথা। কিন্তু কাগজে কলমে দেখানো হচ্ছে অনেক কম। এ জন্য দু’টি রেজিস্টার খাতা ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

কারখানাটি সপ্তাহে ছয় দিন চালু থাকে। ৫২ সাপ্তাহিক ছুটি ও সরকারি ছুটি বাদ দিলে বছরে প্রায় ৩০০ দিন চালু থাকে কারখানাটি। আর দৈনিক উৎপাদনের হিসেব ধরলে বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ব্যন্ডরোল ব্যবহার করার কথা। এই হিসেব ধরে তাদের ব্যান্ডরোল ক্রয়ের হিসেব কষা হলেই জালিয়াতি ধরা পড়বে বলে দাবি করেছে শ্রমিকরা।

এছাড়া আকিজ গ্রুপের যশোর শহরের চাঁচড়া মোড়ে আকিজ বিড়ির একটি ছাপাখানা রয়েছে। নাভারণ প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজেস লিমিটেড নামে এ ছাপাখানায় আকিজ বিড়ির প্যাকেট ও মোড়ক তৈরি হয়। এই কারখানা থেকেই আকিজ বিড়ির ব্যান্ডরোলও ছাপা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ২৬ মার্চ আবীরের পাড়া ফ্যাক্টরিতে গেলে খান মজলিসকে পাওয়া যায়নি। নিরাপত্তা প্রহরী জানায় তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন। তাদের কাছে ফোন নম্বর চাইলে ফোন নম্বর দেওয়া নিষেধ রয়েছে বলে জানায় তিনি।

পরে আকিজ গ্রুপের মেইল আইডি info@akijgroup.com- এ কথা বলার জন্য মেইল করা হলেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।

No comments

Powered by Blogger.