নোবেল প্রাপ্তির শতবর্ষ পূর্তি ॥ যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে- শিলাইদহে বর্ণাঢ্য রবীন্দ্র উৎসব

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’তে নোবেল প্রাপ্তির শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে শুক্রবার উৎসবমুখর পরিবেশে কবির স্মৃতিবিজড়িত কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ‘কুঠিবাড়ী’ চত্বরে অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ ও ভারতীয় শিল্পীদের সমন্বয়ে দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য ‘রবীন্দ্র উৎসব’।
এতে অংশ নেন দুই দেশের সব প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, শিল্পী, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক আর ভিআইপি অতিথি। এ উপলক্ষে শিলাইদহে আয়োজন করা হয় আলোচনাসভা, কবিতা আবৃত্তি ও জমকালো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বসে বইমেলা ও পিঠা উৎসব। আয়োজনকে ঘিরে সকাল থেকেই শিলাইদহে ছিল সাজ সাজ রব। বিকেলে মূল অনুষ্ঠানেও ছিল রবীন্দ্রপ্রেমী দর্শক-শ্রোতাদের উপচেপড়া ভিড়। এপার বাংলার সংগঠন ‘অতন্দ্র একাত্তর’ ও ওপার বাংলার ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’-এর যৌথ আয়োজনে এশিয়ার প্রথম এই নোবেল জয়ীকে সম্মানিত করতে দুই বাংলার সংস্কৃতির ওই মিলনমেলার আয়োজন করা হয় শিলাইদহের কুঠিবাড়ী প্রাঙ্গণে। অতন্দ্র একাত্তরের আহ্বায়ক কবি বেলাল চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিকেল সাড়ে ৪টায় নোবেল প্রাপ্তির শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানটির উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।
পদ্মার তীরবর্তী সবুজ বন-বনানী ঘেরা শিলাইদহ এ গ্রামটি বিশ্বকবির হৃদয়ে কাব্যভাবের স্পন্দন জাগিয়ে ছিল। শিলাইদহে বসেই তিনি রচনা করেন ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’, কিংবা ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’, প্রভৃতি সঙ্গীত ও কবিতাসহ অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ। ‘গীতাঞ্জলি’র কাব্যরসও যে তিনি এখান থেকেই পেয়েছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর গ্রন্থ সেই গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১০ সালে। সেটা ছিল ১৩১৭ বঙ্গাব্দ। বাংলা ও ইংরেজী বর্ষ অনুযায়ী পূর্ণ হয়েছে গীতাঞ্জলি প্রকাশের শততম বার্ষিকী এবং চলতি বছর পূর্ণ হলো গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য রবীন্দ্রনাথের নোবেল জয়ের শতবর্ষও। ফলে এ উৎসবে ছিল গীতাঞ্জলি থেকে বিশেষ পরিবেশনা ‘গীতাঞ্জলি ১০০’।
অনুষ্ঠানের উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, বিশ্ববাসীর কাছে কবি সত্যিকার অর্থেই ছিলেন বিশ্বকবি। নোবেল বিজয়ের শতবর্ষের এ অনুষ্ঠান বাংলাভাষা ভাষী ও সংস্কৃতিমনা দুই বাংলার জনগণের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন আরও সুদৃঢ় করবে। তাঁর এই মূলমন্ত্র আমাদের জাতীয় জীবনে দারুণভাবে প্রভাব ফেলেছে। যার দিকনির্দেশনা থেকেই বাঙালীর পথ চলা। তাঁর লেখনী বাঙ্গালীকে যুগিয়েছে সংগ্রামের সাহস। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ শুধুই বাঙালীর কবি নন, তিনি ছিলেন বিশ্বকবি। রবীন্দ্রনাথ আধুনিক ও স্বদেশী হওয়ার যে প্রেরণ পেয়েছিলেন, তা এই শিলাইদহের পদ্মা পাড় থেকে। অর্থমন্ত্রী বলেন, কুষ্টিয়ার শিলাইদহে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি সকল বাংলাভাষী এবং সংস্কৃতিমনা ব্যক্তির। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ সরকারের রয়েছে তবে এ সংক্রান্ত এখনও কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।
বিশেষ অতিথি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক বলেন, এ অঞ্চলের মানুষের অনেক দাবির মধ্যে প্রধানত দাবি হিসেবে শিলাইদহে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যলয়ের স্থাপনের দাবির বিষয়টি উঠে এসেছে। প্রধান অতিথিকে দাবির দায়ভার দিয়ে ভারাক্রান্ত করতে চাচ্ছি না। তবে শুধু এই টুকু দাবি করব এ এলাকার গণদাবি বাস্তবায়নে তিনি উদ্যোগী হবেন। রবীন্দ্রনাথ এখান থেকেই সৃষ্টি করেছিলেন গীতাঞ্জলির মতো নোবেল জয়ী বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। তিনি ছিলেন আন্দোলন সংগ্রামের অনুপ্রেরণার কবি। কবির এই আন্দোলন-সংগ্রামের অনুপ্রেরণা থেকেই আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়। এ বাংলা থেকে যুদ্ধাপরাধী জঙ্গীবাদকে চির বিদায় জানায়।
রবীন্দ্র গবেষকদের মতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারিত্বের ভারপ্রাপ্ত হয়ে শিলাইদহে আসেন ১৮৯২ সালে। এ সময় পদ্মার বুকে পাল তোলা নৌকা, বকুলতলার শান বাঁধানো ঘাট, একটু দূরে গড়াই নদী ছাড়াও গ্রাম-বাংলার সবুজের সমারোহ ভরা শিলাইদহ তাঁকে করেছিল বিশেষভাবে আকৃষ্ট। যে কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বদরবারে পরিচিত হন; নোবেল পুরস্কার পান, সেই গীতাঞ্জলির কাব্যরসের স্থানটিও ছিল এই শিলাইদহ। এছাড়া শিলাইদহে বসে রবীন্দ্রনাথ যেসব গান ও কবিতা লিখেছেন, তার অন্যতম কুঠিবাড়ির পাশে বকুলতলার ঘাটে বসে লেখা ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’, গড়াই নদীতে বোটে বসে লেখা ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর’, শিলাইদহে বসে লেখা ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ’, ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’, প্রভৃতি। কবিগুরু শিলাইদহে ছিলেন ১৯২২ সাল পর্যন্ত।
সুদীর্ঘ এই সময় এখানে অবস্থানকালে তিনি সৃষ্টি করেছেন সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তাঁর শিলাইদহে রচিত কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে; সোনারতরী, চৈতালী, ক্ষণিকা, চিত্রা, গীতাঞ্জলি, কথা ও কাহিনী, গীতিমালা, বলাকা, চিরকুমার সভা, চিত্রাঙ্গদা, গল্পগুচ্ছ, পঞ্চভূতের ডায়েরী, জীবন স্মৃতি ও কল্পনা ইত্যাদি। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে অবস্থানকালে গীতাঞ্জলি লিখে ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। রবীন্দ্র গবেষকরা মনে করেন, গীতাঞ্জলিতে সুরেরই আধিক্য বেশি। সুর ও বাণীর অপূর্ব মূর্ছনা নিয়েই গীতাঞ্জলি। গানগুলো প্রায় ক্ষেত্রেই আধ্যাত্মিক। আপাত মনে হয়, কবি মানব-মানবীর প্রেম-বিরহ-মিলনের কথা বলছেন। তবে শেষপর্যন্ত তা আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার, মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের প্রেম-বিরহ-মিলনের কথা।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন কুষ্টিয়া-৪ আসনের এমপি বেগম সুলতানা তরুণ। এ সময় বক্তব্য রাখেন, বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক, ভারতীয় উপ-হাই কমিশনার সন্দ্বীপ চক্রবর্তী, অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহা, বিশিষ্ট চিত্রকর শুভ প্রসন্ন ভট্টাচার্য, কবি বিথী চট্টোপাধ্যায়, রঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, ত্রিদিপ চট্টোপাধ্যায় এবং কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন ও পুলিশ সুপার মফিজ উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। এতে সভাপতিত্ব করেন কবি বেলাল চৌধুরী। এছাড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গহর রিজভী, এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, বিশিষ্ট সাংবাদিক আবেদ খান, বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, ভারতের ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশের কার্যকরী সভাপতি রাধাতমাল গোস্বামী, সহ-সভাপতি সত্যম রায় চৌধুরী, বিদ্যুত দেবনাথ প্রমুখ।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে সন্ধ্যায় বিশিষ্ট সাংবাদিক আবেদ খানের পরিচালনায় এবং রামাদিত্য রায়, মল্লিকা মজুমদার ও শারমিন লাকীর উপস্থাপনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রখ্যাত শিল্পীরা। এদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের ফাহিম হোসেন চৌধুরী, মহিউজ্জামান চৌধুরী ময়না, লিলি ইসলাম, বুলবুল ইসলাম, তানিয়া মান্নান, সুস্মিতা আহমেদ বর্না, ও শারমিন সাথী ময়না প্রমুখ এবং ভারতের ইন্দ্রনীল সেন, শান্তুনু রায় চৌধুরী, প্রমীতা মল্লিক, মৌসুমী রায় চৌধুরী, শুভ্রনীল চট্টোপাধ্যায়, ইমন চক্রবর্তী ও লকেট চ্যাটার্জী। এছাড়া দুই বাংলার আবৃত্তি ও যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের লায়লা আফরোজ, ডালিয়া আহমেদ, শিমুল মুস্তফা ও ঝর্ণা সরকার এবং ভারতের সত্যম রায় চৌধুরী ও মল্লিকা মজুমদার। যন্ত্রসঙ্গীতে বাংলাদেশের এনামুল হক ওমর, সুনীল সরকার, ইউসুফ খান ও অসিত বিশ্বাস এবং ভরতের অনুপম মল্লিক, কুনাল চক্রবর্তী, নির্মল কুমার মজুমদার, শক্তিপদ দাস ও বিশ্বরূপ নাথ। এ উপলক্ষে কুঠিবাড়ি চত্বরে বসে দিনব্যাপী পিঠা উৎসব ও বইমেলা। পিঠা উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সহধর্মিণী আফরোজা হক রিনা। নোবেল প্রাপ্তির শতবর্ষ উদ্যাপনের দ্বিতীয় দিনের রবীন্দ্র উৎসব অনুষ্ঠিত হবে শনিবার ঢাকা বাংলা একাডেমী চত্বরে।

No comments

Powered by Blogger.