চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেল রানা ॥ পরিবারের স্বপ্ন চুরমার

 অসচেতন দোকানির কারণে পা হারিয়ে চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেল মেধাবী ছাত্র মেহেদী হাসান রানা। ভেঙ্গে গেল পিতামাতা আর পরিবারের স্বপ্ন। যে রানার পরিবারের সবার নির্ভরতার প্রতীক হওয়ার কথা ছিল, সেই রানা নিজেই এখন পরিবারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল।
রানার পরিবারে চলছে শোকের মাতম। রানা যেন জীবিত থেকেও মৃত। পঙ্গু রানার চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে পরিবার।
রানার চাচা বাবুল হালদার জনকণ্ঠকে জানান, তাদের বাড়ি খুলনার বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ থানাধীন দৈবঘ্যহাটি এলাকার খালখিলা গ্রামে। রানার পিতা আব্দুল কুদ্দুস হালদার (৫০)। স্থানীয় দৈবঘ্যহাটি আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মা নুরুন্নাহার রিনা (৪০)। রানারা দুই ভাই। মেহেদী হাসান রানা (২২) বড়। ছোট রিফাত হালদার দৈবঘ্যহাটি আর্দশ বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র। রানা দৈবঘ্যহাটি আদর্শ বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি আর দৈবঘ্যহাটি এলাকার সেলিমাবাদ মহাবিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে। পরিবারটি গ্রামেই বসবাস করে।
পিতামাতার স্বপ্ন ছেলে ভাল পড়াশুনা করে মানুষের মতো মানুষ হবে। তাই রানাকে পাঠায় রাজধানীতে। রানা ঢাকায় বাড্ডা থানাধীন মধ্যবাড্ডার পোস্ট অফিস গলির ৯৬০ নম্বর কুমিল্লা ভিলার টিনশেড বাসায় ভাড়ায় বসবাস শুরু করে। অনেকটা অর্থাভাবেই মাত্র সাড়ে ৪ হাজার টাকায় ভাড়ায় তারা সেখানে বসবাস করছে। রানা ভর্তি হয় মহাখালী বেসরকারী ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে বিবিএ দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র।
গত ৯ জানুয়ারি ব্যক্তিগত কাজ সেরে রানা বাসায় ফিরছিল। রানা প্রায়ই টাকা বাঁচাতে হেঁটেই বাসায় ফিরত। তখন দুপুর আনুমানিক দেড়টা। বাড্ডা থানাধীন মধ্যবাড্ডার মোল্যাপাড়ার বীরউত্তম রফিকুল ইসলাম সরণির ফুটপাথ দিয়ে হেঁটেই বাসায় ফিরছিল। ফুটপাথের পাশেই ই-৮/৩ নম্বর হৃদয় স্টিল কিং নামের একটি দোকানের সামনে দিয়ে আসার সময় ঘটে যায় রানার জীবনের বড় দুর্ঘটনা। দোকান মালিক ও কর্মচারীরা দোকানের সামনে ফুটপাথ ঘেঁষে একটি কেমিক্যালের ড্রাম কাটছিল। হঠাৎ ড্রামটি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণে ড্রামটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। লোহার তৈরি ড্রামের তপ্ত লোহা বিদ্যুতবেগে ছুটে রানার বাঁ হাঁটুর ওপরে প্রচ- জোরে আঘাত করে। সঙ্গে সঙ্গে রানার বাঁ হাঁটুর নিচ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চিৎকার দিয়ে রানা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। জ্ঞান হারার সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তেই রানার পা দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। মানুষজন দৌড়ে সেখানে জটলা করে। এ সময় খানিক দূরেই দায়িত্ব ছিলেন বাড্ডার থানার উপ-পরিদর্শক সুমেন বড়ুয়া। তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। রানাকে তাৎক্ষণিক উদ্ধার করে নিজ খরচায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে চিকিৎসকরা রানাকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) শেরেবাংলানগরে স্থানান্তর করে। হাসপাতালের পি-৫৮ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন রয়েছে রানা।
এ ঘটনায় রানার চাচা বাবুল হালদার গত ১০ জানুয়ারি বাদী হয়ে রাজধানীর বাড্ডা থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা বাড্ডা থানার উপ-পরিদর্শক সুমেন বড়ুয়া জনকণ্ঠকে জানান, মামলা দায়ের পর দোকান মালিক নজরুল ইসলাম (৪৪) ও কর্মচারী আব্দুস সামাদকে (৩০) গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে স্কুল শিক্ষকের পরিবার রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। রানার মতো এমন ঘটনা আর যেন কারও জীবনে না ঘটে। এজন্য শক্ত আইন করে রাস্তার পাশের এ ধরনের দোকান গড়ে না তোলার দাবি করেছে। বড় সন্তানের এমন অবস্থায় চোখেমুখে রীতিমতো অন্ধকার দেখছেন। কৃত্রিম পা লাগাতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজনে সে অর্থ যোগাড় করার চিন্তা করে রীতিমতো আঁতকে উঠছেন।

No comments

Powered by Blogger.