‘এক রক্ত, এক বংশ তবু কেন আমরা আলাদা’ by জুলফিকার আলী কানন

ভারত সীমান্তে দাদা আফসার শেখ আর বাংলাদেশ সীমান্তে নাতনি মারুফা কান্নাজড়িত কণ্ঠে দু’জন দু’জনের সঙ্গে কথা বলছেন, একে অপরকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে থাকলেও পারছেন না, বাধা হয়ে দাড়িয়েছে মাঝের কাঁটাতারের বেড়াটি।

‘‘ইচ্ছে হচ্ছিল, দাদাকে ছুঁয়ে দেখি। কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে অনেক চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ছুঁতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, দাদাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কান্না করি। তাহলে হয়তো দীর্ঘদিনের জমে থাকা কষ্টগুলো থেকে রেহাই পেতাম। এক রক্ত, এক বংশ তবু কেন আমরা আলাদা? নিজের মানুষকে দেখবো, কেন এতো জটিলতা? এটা কেন সহজ করা হয় না? এভাবে কথা বলে যে আমি শান্তি পেলাম না।’’ ওপারের সীমান্তে আসা দাদাকে দেখতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন নাতনি মারুফা।
ভারতের নদীয়া জেলার মুরুঠিয়া থানার রশিকপুর থেকে বাংলাদেশি নাতনী মারুফাকে দেখতে ছুটে আসেন আসেন দাদা আফসার শেখ। আর নাতনি মারুফা বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলা থেকে স্কুলশিক্ষক বাবাকে নিয়ে ছুটে যান দাদাকে দেখতে।
শুধু দাদা আফসার আর নাতনি মারুফিই নন। রোববার তাদের মতো হাজার হাজার মানুষ তাদের স্বজনদের এক পলক দেখতে ছুটে যান ওই সীমান্তে।

ঢাকা থেকে আসা উজ্জল হোসেন স্ত্রী নিয়ে মেহেরপুর সীমান্তে এসেছিলেন ভারতে থাকা বাবা-মাকে দেখতে।

উজ্জল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘পূর্ব আত্মীয়তার কারণে বাংলাদেশে বিয়ে করেছি। এখন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে বাংলাদেশেই বসবাস করছি। আমার বাবা-মা থাকেন নদীয়া জেলার করিমপুরে। প্রায় ৭ বছর পর বাবা আবুল হোসেনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। অনেকক্ষণ পর বাবা এসেছেন। তার সঙ্গে অনেক কথা হয়েছে। আমার অনূভূতির কথা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারবো না। তবে বলবো, খুবই ভালো লেগেছে আমার।’’

তার বাবা আবুল হোসেন তারকাঁটার ওপার থেকে বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘ঈদের দিন ছেলের জন্য মন খারাপ ছিল। তার সঙ্গে দেখা হওয়ায় আজকে আমি তৃপ্তি পেয়েছি।’’

মেহেরপুর সদর উপজেলার খোকসা গ্রামের কাজল রেখা (৪০) বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘মামা ফজলু শেক, লালু শেখ, মামাতো ভাই টোকন থাকেন নদীয়া জেলার দীগলকান্দি গ্রামে। তাদের সঙ্গে প্রায় ১১ বছর পর দেখা হবে। এটা ভাবতেই আজ আমার মন পুলকিত হয়ে ওঠছে। সকাল থেকে বসে আছি তাদের অপেক্ষায়। মোবাইলে কথা হয়েছে। দুপুরের পর তারা এখানে পৌঁছাবেন।’’

কাজল রেখার সঙ্গে ছোট বোন তাসলিমা খাতুনও এসেছেন মামাদের সঙ্গে দেখা করতে। তাসলিমা বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘আল্লাহতো একটাই পৃথিবী তৈরি করেছেন। তাহলে মানুষ তার কাঁটার বেড়া দেবে কেন?’’

গাংনী উপজেলার মহম্মদপুর গ্রামের মনজুরা খাতুন বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘আমার ননদ রাবেয়া খাতুনের সঙ্গে ভারতের নদীয়া জেলার মুরুঠিয়া থানার রশিকপুর গ্রামের খোকনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। তাদের সঙ্গে প্রায় ১৩ বছর দেখা হয়নি। আজকে দেখা হয়েছে। সাংসারিক অনেক কথা হয়েছে। তাদের সুখ-দুঃখের অনেক কথা শুনেছি। আমাদের কথাও বলেছি।’’

পবিত্র ঈদ-উল আযহা উপলক্ষে রোববার সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তের গাংনী উপজেলার আন্তর্জাতিক সীমান্ত পিলার ১৩৫ খাঁশমহল, ১৩৬ পাকশী , ১৩৭ রংমহল এলাকা ও ১৩৮ সীমান্ত পিলারের কাছে সীমান্ত উভয় দেশের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

এ ঘোষণা অনেক আগেই এলাকার লোকজন জানতে পারেন। দু’দেশের স্বজনরা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের মোবাইল ফোনে দেখা করার জন্য আগাম জানিয়ে দিয়েছিলেন।

এরপর রোববার সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দু’দেশের সীমান্তে জড়ো হতে থাকেন স্বজনরা। এ সময় নিজ নিজ স্বজনদের জন্য আনা বিভিন্ন খাবার, পোশাকসহ উপহার সামগ্রী তারকাঁটার বেড়ার ওপর দিয়ে পারাপার করেন তারা।

এ সময় তাদের কান্নায় সীমান্ত এলাকার আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।

গাংনী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম শফিকুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘ভারতে আমার কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই। হঠাৎ শুনলাম, আজকে সীমান্ত উম্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। তাই এলাম।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘এখানে এসে একটা বিষয় বুঝলাম, তারকাঁটার বেড়া দিয়ে দেশকে দু’ভাগ করতে পারলেও মানুষের মনের যে ভালোবাসা রয়েছে সেটা রোধ করতে পারবে না কেউই। এক ভাষা, এক কৃষ্টি-কালচার। তবে কেন এ তারকাঁটার বেড়া? আমাদের নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।’’

এটা দু’দেশের সরকারকে ভাবার জন্যও আহ্বান জানান তিনি। 

No comments

Powered by Blogger.