জীবন অমীমাংসিত থাকতে চায় by আল মাহমুদ

যেটা লেখার কাজ সেটা লিখেই শেষ করতে হয়। অন্য কোনো পন্থায় লেখার কাজ শেষ করা যায় না। আমি এ নিয়ে অনেক ফাঁকি-জুকি করে থাকি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লেখার কাজটা বাধ্য হয়ে লিখেই শেষ করতে হয়। সবচেয়ে ভালো হতো যদি না শেষ করে প্রসঙ্গটা ভাসিয়ে রেখে পারা যেত। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় যে প্রসঙ্গের অবতারণা করা হয় সেটা এতই ভারি যে, ডোবে না।

তার চেয়ে বরং এমন কিছু লেখার জন্য বিবেচনা করা, যা আমি চাইলেই ভাসবে, হাসবে এবং একই সঙ্গে আনন্দের সৃষ্টি করবে। অবশ্য আনন্দ যে সবসময় আমার কাম্য সেটা আমি ভাবি না। জীবনের অনেক সময় তো নিরানন্দে কেটেছে। কই তাতে তো আমার তেমন ক্ষতি বৃদ্ধি হয়নি। এখন ভাবি জীবনটাই এরকম। চালালে চলে, না চালালে ছটফট করে। আমি অবশ্য সবসময় জীবনের পক্ষে দাঁড়াতে পারি না। মনে হয় আমার পক্ষপাত আমার জীবনকে সাহায্য করবে না। আমি জীবনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। জীবন হাসেও না কাঁদেও না। তবে আমার জন্য রাঁধে।
জীবন চায় না আমি অভুক্ত থাকি। সবসময়ই জীবনের বাসনা হলো আমাকে কিছু খেতে দেয়া। আমি খাই এবং পর মুহূর্তেই ভুলে যাই। আমার বেঈমানিতে জীবন মুচকি হাসে। আমি এ হাসিটা ফিরিয়ে দিয়ে বলি এতে হাসার কী আছে। জবাবে জানানো হয় হাসি না হলে জীবনের দুঃখ-কষ্ট আড়াল করা যায় না। হেসে বলতে হয় ভালোবাসি।
আমি বহু ভেবে দেখেছি মানুষের খুশি থাকার একমাত্র উপায় হলো ভুলে যাওয়া। ভুলতে পারলেই সব দরজা খুলতে পারা যায়। কিন্তু অসুবিধা হলো যাদের ভুলার কথা বলছি তারা ঈষত্ হিংস্র প্রকৃতির। ভুলতে দেয় না। বরং অতীত হয়ে যাওয়া অনেক বিষয়কে নতুন করে তুলে। পেছন দিকটা সামনে এসে যায়। অথচ সামনের দিকটা পেছনে যেতে চায় না।
দুটোই সমানে সামনে বিরাজ করে। কাকে ঠেলে ফেলে দেব? কোনো অতীত নেই। সবই আগামীকাল। সবই যা ঘটবে তার একটা প্রতিচ্ছবি। অথচ ঘটনার আগে চলে এসেছে দুর্ঘটনা। আমরা দুর্ঘটনা ছাড়া একদিনও কি পা ফেলতে পারি? তবু আমাদের তো শুধু বর্তমান আর ভবিষ্যত্ হলে চলে না। অতীতেরও দরকার হয়। অতীত না হলে ইতিহাস হয় না।
এভাবেই আমরা অতীতকে বাদ দিয়ে কিছু সৃষ্টি করতে গিয়ে অতীতকেই বর্তমান করে তুলি। অতীত আড়ালে মুখ লুকিয়ে হাসে।
সুযোগ পেলেই জানিয়ে দেয় সে কোথায় যাবে। তার তো বসবাসের কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। সে আগেও আছে, পেছনেও আছে।
তবে প্রশ্ন উঠেছে, তাকে একসঙ্গে চলতে দিলে সে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলবে। তার কথা হলো সে প্রকৃতপক্ষে অতীত নয়। আবার বর্তমান বা ভবিষ্যত্ও নয়। সে শুধু আছে। যেমন জগতে অনেক জিনিস আছে। আমরা বিশ্বাস করি আছে। আমরা বিশ্বাস না করলে ‘আছেটা তো’ আর নাই হয়ে যায় না। আগে-পিছে এজন্যই কি এত ‘আছে আছে’ শব্দ।
সবকিছু পেছনে ফেলে কেবল সামনে এগুবার মন্ত্র অনেক দিন আমি চর্চা করেছি। কিন্তু তাতে জীবনের কোনো হেরেফের হয় না। জীবন কেবল আছে আছে করে। অথচ কি আছে, কোথায় আছে, কেন আছে—এর ব্যাখ্যা দিতে চায় না। তবু জীবনের সঙ্গে পাল্লা দেয়াই যেহেতু সব ‘আছে’র উদ্দেশ্য সেজন্য কেবল আছে আছে এই ধ্বনির তরঙ্গ বইছে। আমি নিজে এত আছে আছের মধ্যে বিরক্ত বোধ করি না।
আছে তো আছেই। পাছে ফিরে দেখার দরকার কী? চলার জন্য আছেটা দরকার। বাঁচার জন্যও আছেটা দরকার। এটাই হলো জীবনের মূলমন্ত্র। লেখার জন্যও শক্তি দরকার হয়। কিন্তু কিছু দেখার জন্য, ভালো করে খুঁটিয়ে দেখার জন্য ধৈর্যের দরকার। যদি এমন হতো আমি কোনো কিছুই ফিরে দেখব না, শুধু চলতে থাকব তাহলে হয়তো একটা মীমাংসায় আসা যেত। কিন্তু জীবন সবসময় যতটা হেঁটে এসেছে ততটাই মনে রাখতে চায়। ফিরে দেখে ফিরে লেখে। এভাবেই একটা মীমাংসায় পৌঁছার নাম হলো বেঁচে থাকা। অথচ মানুষের জীবন কোনো মীমাংসা চায় না। সে অমীমাংসিত থাকতে চায়। সে তর্কপরায়ন অবস্থাটি বাঁচিয়ে রেখে হেসে খেলে জীবন কাটিয়ে দিতে চায়। অথচ জীবন তো কারও মুখাপেক্ষী নয়। সে মীমাংসাও সহসা ডেকে আনতে চায় না। সে থাকুক অমীমাংসিত, জটিল এবং কলহপ্রবণ।
লেখক : কবি

No comments

Powered by Blogger.