আলবদর ১৯৭১ by মুনতাসীর মামুন

(পূর্ব প্রকাশের পর)আলবদরদের এসব ‘বীরত্বগাঁথা‘ অনেক গালগল্প আছে। এর উদ্দেশ্য হলো, পাকিস্তানের তরুণদের মধ্যে আলবদরীয় ভাবাদর্শ তৈরি করা। নতুন এক জঙ্গী তরুণ সমাজ গড়ে তোলা যারা হবে জামায়াতের অনুসারী।
আলবদররা এত খুন খারাবী করেছে, মনসুর খালেদের বর্ণনায় তার কোন বর্ণনা নেই।


সেটি স্বাভাবিক। আলবদররা যে নিরীহ পেশাজীবী, তাদের লিংক, বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে জবাই করত তার কোন বর্ণনা নেই। অথচ এগুলোই ছিল তাদের মূল অপারেশন। এখানে সে রকম একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করছি। এ বর্ণনায় আপনারা জানতে পারবেন আলবদর কী। কিভাবে তারা কাজ করত। তারা কী ধরনের মনোবিকারের রোগী। এ বর্ণনাটি তৎকালীন গ্রীনল্যান্ড মার্কেন্টাইল কোম্পানির চিফ এ্যাকাউনটেন্ট মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনের। তাঁকে ধরে নিয়ে রাখা হয়েছিল ঢাকার মোহাম্মদপুরে আলবদরদের সদর দফতর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে। সেখান থেকে তিনি পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। বর্ণনাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ২১ ডিসেম্বরের দৈনিক বাংলায়। এই বর্ণনাটি হয়ত অনেকে পড়েছেন। কিন্তু, আমার মনে হয়, নতুন প্রজন্মের অনেকেই তা পড়েনি। এ বর্ণনা থেকে সামান্য হলেও আলবদরদের (বা নিজামী, মুজাহিদ, কামারুজ্জামান বা কাদের মোল্লার) মনের গড়ন জানা যাবে।
‘১৪ ডিসেম্বর সকাল নয়টা। শান্তিবাগে আমার বাসায় আমি শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ বাইরে ভারি পায়ের শব্দ পেলাম। বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে দেখি কয়েকজন রাইফেলধারী লোক আসছে। রাস্তার দরজায় এসে তারা জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগল। কর্কশ স্বরে তারা বলছিল ‘ঘরে কে আছে, দরজা খোল।’
‘তারপর নানা কথাবার্তার পর তারা আমাকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেল। বাসার পাশের মেসের একটি ছেলেকেও তারা ধরে নিয়ে এল। আমাদের তারা মালিবাগের মোড়ে দাঁড় করানো একটি বাসে নিয়ে তুলল। বাসে তুলেই তারা আমার গায়ের জামা খুলে ফেলল, এবং একটি কাপড় দিয়ে কষে চোখ বেঁধে ফেলল। এছাড়া হাত দু’টো নিয়েও পেছনের দিকে শক্ত করে বেঁধে ফেলল। তারপর বাস ছেড়ে দিল। পথে আরও কয়েক জায়গায়ও তারা বাসটি থামাল। মনে হলো আরও কিছু লোককে বাসে ওঠানো হচ্ছে। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না যে, আমরা কোথায় যাচ্ছি। অনুমানে মনে হলো, বাসটি মোহাম্মদপুর, দ্বিতীয় রাজধানী বা ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাচ্ছে।
এমনিভাবে ঘণ্টাখানেক চলার পর বাস এক জায়গায় এসে থামল। তারপর আমাদের হাত ধরে একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। ততক্ষণে কাথাবার্তায় আমি টের পেয়েছি যে, আমি বদর বাহিনীর হাতে পড়েছি। খানিকক্ষণ পর আমাকে ও অপর আরেকজনকে সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে এলো উপর তলায়। দরজা খুলে একটি রুমের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। হুমড়ি খেয়ে পড়লাম মেঝের ওপর। ঠিক পাকা মেঝের ওপর নয়। গিয়ে পড়লাম কিছু লোকের ওপর। অনেক কষ্টে সোজা হয়ে বসলাম। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, কক্ষের আর সব লোকেরও আমার মতো হাত ও চোখ বাঁধা কিনা, শুধু বুঝতে পারছিলাম ঘরে আমার মতো আরও বেশ কয়েকজন রয়েছে। এদিকে কষে বাঁধার দরুন আমার চোখ ও কানে দারুণ যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কাঁদতে শুরু করেছি। মাথায় শুধু একটি চিন্তা কী করে এই বর্বর পশুদের হাত থেকে আমি বাঁচতে পারি। আমি কি সত্যি বাঁচতে পারব?
‘আল্লাহ্ আল্লাহ্’ বলে, আমি উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলাম। ভাবছিলাম বদর বাহিনীর লোকরা তো শুনেছি মাদ্রাসা ও ইসলামী শিক্ষা লাইনের ছেলে। আমার আহাজারিতে যদি বদর বাহিনীর লোকদের কিছু দয়া হয়। যদি দয়া পরবশ হয়ে চোখের ও হাতের বাঁধন একটু খুলে দেয়, নিদেনপক্ষে একটু ঢিলে করে দেয়। অনেক্ষণ কাঁদার পর কে যেন আমার হাতের বাঁধন খুলে দিল। ফিসফিস করে সে বলল ‘সাবধান। হাত খোলা দেখলে কিন্তু আপনাকে পিটিয়েই মেরে ফেলবে।’ কচি কণ্ঠ। বুঝলাম অল্প বয়সী কোন ছেলে এবং সে বদর বাহিনীর কেউ নয়। আমি তাড়াতাড়ি চোখের বাঁধন ঢিলে করে দিলাম। বাঁধন এমনিভাবে রাখলাম, যাতে আবছা আবছা দেখা যায়। এর মধ্যেই দেখে নিয়েছি যে, আমার হাতের বাঁধন খুলে দিল আট-নয় বছর বয়সী একটি ছেলে। তার দু’হাতের চামড়া কাটা। হাত ফোলা। সারা কক্ষে শুধু রক্ত আর রক্ত। এখন সেখানে ইতস্ততভাবে ছড়িয়ে রয়েছে রক্তে রঞ্জিত জামা ও গেঞ্জি। আমার মতো প্রত্যেকের গায়েই গেঞ্জি। তাদের দেহের বিভিন্ন অংশে কাটাছেঁড়ার দাগ। হাতের বা পায়ের আঙ্গুল কাটা, কারও দেহে দীর্ঘ ও গভীর ক্ষত, কারও হাত-পায়ের নখ উপড়ে ফেলা হয়েছে।
‘ছেলেটিই আমার হাতে আবার কাপড় জড়িয়ে বাঁধনের মতো করে দিল। আমি ভাবছিলাম, কি করে এই জল্লাদদের হাত থেকে বাঁচব। কক্ষটিতে শুধু একটি কাচের জানালা, তবে মনে হলো বেশ মজবুত। এল টাইপের ত্রিতল অথবা চারতলা বাড়ি। বিরাট এলাকা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। বাড়িটি সম্ভবত মোহাম্মদপুরের নিকটবর্তী এলাকার কোথাও হবে।
‘এমনিভাবে সারা দিন কেটে গেল। সন্ধ্যার দিকে বদর বাহিনী বা রাজাকারের দলের লোকজন আরও কিছু লোককে ধরে নিয়ে এল। সন্ধ্যার পর তিন চারজন আমাদের কক্ষে এল জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য। এক এক করে সবাইকে তারা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল। শুনলাম, কেউ বলছে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কেউ বললÑআমি ডাক্তার, আমি সাংবাদিক, আমি চিফ এ্যাকাউনট্যান্ট, আমি কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালের সার্জনের ছেলে। লোকগুলোর একজন বলে উঠল, ‘শালারা সব ইন্ডিয়ান স্পাই আর ইন্টারন্যাশনাল স্পাই।’ একজন আবার বলল, ‘শালা, তুমি ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হয়ে এদ্দিন মন্ত্র পড়িয়েছ, আজ আমি তোমাকে পড়াব। তুমি তো গবর্নমেন্ট অফিসার, সরকারের টাকা খেয়েছ আর গাদ্দারি করেছ। এবার টের পাবে।’
‘জিজ্ঞাসাবাদের পর শুরু হলো প্রহার, এমনি ধুমধাম মার দেয়া শুরু হলো যেন নিশ্বাস ফেলারও জো নেই। সবাই চিৎকার করে কাঁদছে। কেউ জোরে জোরে দোয়া-দরুদ পড়ছে, আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছে, কিন্তু পশুগুলোর সেদিকে ভ্রক্ষেপও নেই। মারধর করে প্রায় আধ ঘণ্টা পরে লোকগুলো চলে গেল। মার খেয়ে অনেকেই অচেতন হয়ে পড়েছে। রাত তখন অনুমান ১০টা। এক অধ্যাপক সাহেব আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন ভাই, আপনার হাত কি খোলা? আমার হাতের বাঁধনটা একটু ঢিলে করে দেন, লুঙ্গিটা হাঁটু থেকে নিচে নামিয়ে দেন। খানিক পরে কোনক্রমে দেয়াল ঘেঁষে বসে তিনি আচ্ছন্ন অচৈতন্য হয়ে পড়লেন।’
‘রাত ১০টা থেকে অনুমান ১টা পর্যন্ত বেশ কয়েকবার বদর বাহিনীর জল্লাদরা এসে আমাদের খানিক পরপর দেখে গেল। রাত প্রায় সাড়ে ১২টায় আমাদের উপরতলা থেকে কয়েকজন মহিলার আর্তনাদ ভেসে এল। সেই আর্তনাদের বর্ণনা দেয়া আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। মাঝে মাঝে রাস্তায় গাড়ির শব্দ শুনতে পেলাম। মারের চোটে প্রায় সবাই অচেতন হয়ে পড়ে রয়েছি। আমি জ্ঞান হারাইনি। আমি আল্লাহ্কে ডেকে যাচ্ছি শেষবারের মতো আল্লাহ্র কাছে আমার যদি কোনো গুনাহ হয়ে থাকে তার জন্য পানাহ চাইছি।
‘রাত প্রায় ১টার সময় পাশের ঘরে রাইফেলের গুলি লোড করার শব্দ এবং লোকজনের ফিসফিস করে আলাপের শব্দ শুনতে পেলাম। সারা শরীরে আমার ভয়ের হিম স্রোত চকিতে ভরে উঠল। খানিক পর একটা লোক এসে আবার আমাদের দেখে গেল। তারও খানিক পর কয়েকজন আমাদের ঘরে ঢুকল। তারাই আমাদের ঘরের বাইরে নিয়ে এল।
‘এরপর বদর বাহিনীর একেকটি পশু আমাদের দু’জন দু’জন করে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামিয়ে আনল। তিনটি বাসে তারা আমাদের সবাইকে নিয়ে তুলল। তাদের হাবভাব, ফিসফিস করে কথাবার্তা শুনে মনে হলোÑআর রক্ষা নেই। বাস ছেড়ে দিল, বাসের সব ক’টি জানালা ওঠানো। বুঝতে পারলাম, আমাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর বাস এসে থামল কতকগুলো ঘরের পাশে। ঘরের দরজা বেশ বড় বড় এবং কোনাকুনি লাঠি দিয়ে আটকানো। কিন্তু তারা আমাদেরকে ঘরে না ঢুকিয়ে ধরে নিয়ে চলল। কৌশলে চোখের বাঁধন আলগা রাখার সুযোগ হলো বলে দেখতে পেলাম সামনে বিরাট এক বটগাছ, তার সম্মুখে একটা বিরাট বিল, মাঝে মাঝে কোথাও পুকুরের মতো রয়েছে। বটগাছের আরও কাছে গিয়ে দেখতে পেলাম ১৩০ থেকে ১৪০ জনকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এর মাঝে এক ফাঁকে সুযোগ বুঝে আমি আমার পরনের লুঙ্গি হাঁটুর ওপর উঠিয়ে রেখেছি। চোখ বাঁধা অবস্থায়ও যে আমি দেখতে পাচ্ছি তা বদর বাহিনীর লোকেরা বুঝতে পারেনি। বদর বাহিনীর লোকজনের হাবভাবে নিশ্চিত হলাম, আমাদের হত্যা করার জন্য এখানে নিয়ে এসেছে। আমি এখন আমার সমগ্র চেতনা কেন্দ্রীভূত করে ভাবছিÑকি করে বাঁচা যায়।
‘দেখতে পেলাম বদর বাহিনীর পশুরা আমার সামনের লোকদের হাত দড়ি দিয়ে বাঁধছে। আমাদের মতো বন্দি একজন চিৎকার করে বলে উঠলেন ‘আপনারা বাঙালি হয়ে আমাদের মারছেন। কোন পাঞ্জাবী যদি মারত তাহলেও না হয় বুঝতাম, কেন আমাদেরকে হত্যা করতে যাচ্ছেন? আমরা কি অন্যায় করেছি?’ ভদ্রলোকের গায়ে রাইফেলের এক ঘা দিয়ে বদর বাহিনীর এক জল্লাদ গর্জে উঠল ‘চুপ কর শালা।’ কে যেন একজন বলে উঠলÑ‘আমাকে ছেড়ে দিন, দশ হাজার টাকা দেব।’ কোন একজন মহিলা চিৎকার করেব বলে উঠলেনÑ‘আপনারা আমার বাপ, ভাই। আমাকে মারবেন না।’ চারদিকে মাতম, আহাজারি, তার বর্ণনার ভাষা আমার নেই। সামনের লোকদের দলে দলে ভাগ করে তারা সামনের ফাঁকা মাঠে নিয়ে যাওয়া শুরু করল। আমার সারা শরীর যেন ভয়ে জমে যাচ্ছে। কিন্তু এরই মধ্যে আমি বাঁচার আশায় পালাবার সম্ভাব্য সব উপায় ভাবতে শুরু করে দিয়েছি। মনে হচ্ছেÑকোন উপায় আর নেই।
‘আবার মনে হচ্ছে বাঁচার কী কোনো উপায় নেই! জল্লাদদের একজন আমার কাছে এসে দাঁড়াল। আমার পেছনের লোকের গেঞ্জির সঙ্গে আমার গেঞ্জি সে ভালো করে বেঁধে দিল। হঠাৎ সে সময় পেছনের লোকটি বলে উঠলÑ‘আজিজ ভাই, তুমি! তুমি আমাকে মারতে নিয়ে এসেছ! তুমি থাকতে আমাকে মেরে ফেলবে! আপসোস!’ রাইফেলধারী লোকটি কোন কথা না বলে চলে গেল।
‘বেয়নেট দিয়ে জল্লাদের দল তাদের হত্যালীলা শুরু করে দিয়েছে, ছুড়ছে গুলি। চারদিকে আর্তচিৎকার, মাঝেমাঝে জল্লাদের দলের কেউ কেউ চিৎকার করে বলে উঠছে শালাদের খতম করে ফেল। সব ব্যাটাদের খতম কর ফেলব। মাঝে মাঝে ভেসে আসছে আর্তচিৎকারের সঙ্গে পৈশাচিক হাসি। এমন নারকীয় তা-বলীলার মধ্যে আমি জীবনপণ করে আমার হাতের বাঁধন খুলে ফেললাম। আমার সম্মুখের প্রায় তিরিশজনকে ততক্ষণে সামনের ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে খতম করে ফেলেছে বদর বাহিনীর পশুরা। ত্রস্ত হাতে আমি গেঞ্জির গিট খুলে ফেললাম। বাম হাতের দড়ির বাঁধন খুলে দড়িটা হাতের নিচে চাপা দিয়ে রাখলাম। হাত আবার পেছনে দিয়ে রাখলাম। বদরবাহিনীর এক দস্যু আমার সামনের কয়েকজনকে নিয়ে তখন ব্যস্ত। কে যেন বলে উঠলেন আল্লার কাছে তোরা দায়ী থাকবি। লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। মাগো...! আমি চোখের বাঁধনের কাপড়টি সরিয়ে ফেলে খুব জোরে দৌড় দিলাম। প্রায় হাত কুড়ি যাবার পর ‘এই’ ‘এই’ বলে হাঁকডাক শুনতে পেলাম। আমার তখন কোন দিকে খেয়াল নেই। শুনতে পেলাম গুড়ুম গুড়ুম করে দু’টি আওয়াজ। অন্ধকারে প্রায় ৪০ গজ যাওয়ার পর সামনে পড়ল কাদা। কর্দমাক্ত জায়গাটি পার হওয়ার সময় আবার দুটি গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম। কিন্তু অন্ধকারে তাদের লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। আমি কাদার মধ্যে পড়ে গেলাম। প্রায় ৩ ফুট গভীর পানি। সমস্ত শক্তি নিয়োগ করে আমি পানি ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলাম। খানিকক্ষণ চেষ্টার পর শুকনো জায়গা পেলাম। উঠে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলাম। দূর থেকে আমার দিকে টর্চের এক ঝলক আলো ভেসে এল। আবার দু’টি গুলির শব্দ। সাথে সাথে আমি কাত হয়ে পড়ে গেলাম। গড়াতে গড়াতে পড়ে গেলাম আবার পানির মধ্যে। প্রাণপণে সাঁতার কেটে এগিয়ে চললাম। এরপর শুকনো বিল আর নদী পেরিয়ে এগিয়ে চললাম। গায়ে শক্তি নেই, কিন্তু আমি তখন দিকভ্রান্ত। নিরাপত্তার জন্য নদীর পাড়ে না উঠে উজানে এগিয়ে চললাম। রাতের তখন বেশি দেরি নেই। খানিক পর উঠে পড়লাম নদী থেকে। বাকি রাত কাটিয়ে দিলাম নদীর তীরে এক ঝুপড়ির মধ্যে। সকালে রোদ ওঠার পর চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম। বুঝতে পারলাম না কোথায় এসেছি। গ্রামের আভাস যেদিকে পেলাম সেদিক পানে চললাম এগিয়ে। খানিক চলার পর শুনতে পেলাম এরা গ্রামবাসী। তাদের কাছে সব কথা বললাম। বটগাছের বিবরণ দিতে তারা বললÑওটা হলো রায়ের বাজারের ঘাটের বটগাছ। সেখান থেকে পরে আমি আটির বাজারে মুক্তিফৌজের কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। দু’দিন পর ফিরে এলাম স্বাধীন বাংলার রাজধানীতে। তখনও বুঝিনি, এখনও বুঝতে কষ্ট হচ্ছে যে, নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে সত্যি কি বেঁচে গেছি, আল্লাহ শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়েছেন।’

৮. পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণ
শের নিয়াজীর বিল্লি নিয়াজীতে রূপান্তর

যতই বীরত্বের কথা বলুক না কেন, অক্টোবর-নবেম্বর থেকেই নেতৃস্থানীয় আলবদররা বুঝেছিল, অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। এক আলবদর বলছিলেন, তারা চারদিকে ঘেরাও হয়ে আছেন। এ এক ‘গোলযোগপূর্ণ বছর’, এককথায় ‘ঘূর্ণাবর্ত’। কাদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছেন তারা
১. ভারতীয় দুষ্কৃতকারী
২. বাঙালী জাতীয়তাবাদী [প্রধানত আওয়ামী লীগ]
৩. কমিউনিস্ট
৪. হিন্দু
৫. কয়েক স্থানে নিজস্ব বাহিনী [এর অর্থ পরিষ্কার নয়]
৬. অবাঙালী। অবাঙালীদের সঙ্গে বাঙালীদের দ্বন্দ্ব ছিল। আলবদররা বাঙালী। সুতরাং বিহারীদের কাছে আলবদররাও বিশ্বাসযোগ্য ছিল না।
এসব কারণে বিচলিত হলেও তারা বিপর্যস্ত হয়নি। কারণ, তারা বিশ্বাস করত, ‘আলবদর ইসলামের নামে অর্জিত পাকিস্তান ও দেশের জনগণকে বাঁচানোর জন্য লড়াই করছে। পরকালে তারা প্রতিদান পাবে।’
এর মধ্যে ঈদ এলো। তার মধ্যেও আলবদররা দুশমনদের ছায়া দেখছিল। কিন্তু দুশমনদের কল্পিত ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার জন্য তারা ব্যবস্থা নিয়েছিল। এর বর্ণনা দিয়েছেন আলবদর বাহিনীর প্রধান একজিকিউশনার বা প্রধান জল্লাদ বা প্রধান খুনী তার ভাষায়
‘পূর্ব পাকিস্তানে ঈদের আনন্দের ওপর জয়ের ছায়া প্রবল। দুশমন আনন্দের দিনটিকে কান্নার দিনে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করছিল। দুশমন গোটা পূর্ব পাকিস্তানে ঈদের জামায়াতগুলোতে ধ্বংসকারী হাতিয়ার দিয়ে হামলা করার পরিকল্পনা করেছিল। ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পারার পর ইসলাম পছন্দ জনতা এই অমানবিক হামলা প্রতিহত করা ও তাদের সাহায্যের জন্য ইসলামী চেতনায় উদ্দীপিত আলবদর তরুণদের আহ্বান করেছে। আলবদর জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে সকল রাজাকারকে ক্যাম্পে ডেকে পাঠিয়েছে। তারা এই প্রতিজ্ঞা নেয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের সব এলাকায় ঈদের নামায আদায় শুরু হবে, এবং ঈদের আনন্দ উদযাপন করা হবে। নিজেদের আরাম বিশ্রাম ত্যাগ করে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকার কেন্দ্রীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, পল্টন ময়দান এবং অন্যান্য ঈদের জামায়াতের চারদিকে সশস্ত্র আলবদর যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য দ-ায়মান ছিল। এটি বিস্ময়কর প্রাণউদ্দীপক দৃশ্য ছিল! লোকেরা ঈদের নামাযে শরিক হয় এবং হাসি-খুশিভাবে নিজ নিজ ঘরে ফিরে যায়। যখন সব লোক বাড়িঘরে চলে গেছে, তখন আলবদরের মুজাহিদরা নিজেদের অস্ত্র জমা রেখে দু’রাকাত নামায আদায়ের জন্য কেবলামুখী দ-ায়মান হয়। নামায শেষ করে এই লোকরা আল্লাহর দরবারে দোয়া করছিল যে, ইয়া আল্লাহ!
পাকিস্তানের হেফাজত কর। এরপরে অশ্রুসিক্ত নয়নে একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করল। এই দৃশ্য ছিল অত্যন্ত আবেগ-আপ্লুত দৃশ্য। তাদের কাছে নতুন কাপড় ছিল না। আর ছিল না নতুন জুতা। তারা নিজের ঘর, বাপ-মা, ভাই-বোন পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন সবার কাছ থেকে দূরে ছিল। কিন্তু তাদের কোন আপসোস ছিল না। বেদনার অনুভূতিও ছিল না। আমার এখনও চোখে ভাসছে সে প্রিয় চেহারাগুলো নুরুল আমীন, আবদুল্লাহ ইউসুফ, বশীর ও অন্যান্য। এই প্রাণউদ্দীপক আবেগভরা দৃশ্য এখনও আমি আমার দিলের আয়নায় দেখে নিই। পুনরায় এই চিন্তার জগতে হারিয়ে যাই যে, আমার সেই সাথী, সেই প্রিয়জনরা আজ কোথায়! যারা নিজের সবকিছু কুরবান করে দিয়েছিল। ঐদিন জি হ্যাঁ সেই ঈদের দিন, আলবদরের বাহিনী দুশমনের গোপন আখড়াগুলোর ওপরে কহর হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.