ইতিউতি-পররাষ্ট্রীয় সম্পর্ক জাতীয়ভাবে বিবেচনার বিষয় by আতাউস সামাদ

পররাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বিষয়টি কি শুধুই কূটনীতি না তার চেয়ে বড় কিছু? অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আসলেই অনেক গভীর আর ব্যাপক বিষয়। কূটনীতি স্বাভাবিক সময়ে পররাষ্ট্রীয় সম্পর্ক পরিচালনার জন্য প্রধান হাতিয়ার ঠিকই, কিন্তু সময়টা যদি হয় অস্বাভাবিক বা উত্তেজনাপূর্ণ আর সম্পর্কের বিবেচ্য ক্ষেত্র অথবা বিষয় হয় একাধিক, তাহলে কূটনীতি ছাড়াও অন্যান্য মাধ্যম ও কার্যক্রম ব্যবহার করা জরুরি হয়ে পড়ে।


এ জন্য জানতে হয় অনেক কিছু, করতে হয় নানান কিছু। ইংরেজিতে ঝযরভঃরহম ংবহফং বা স্থান পরিবর্তনকারী বালুকারাশির কথা আছে। বাতাসে বালুকণা উড়ে একখান থেকে অন্যখানে চলে যায়। আজকে যেখানে বালুর উঁচু ঢিবি আছে রাতে এক ঝড় এলে পরদিন সকালে হয়তো দেখা যাবে সেখানটা সমতল হয়ে গেছে। তাই এই 'শিফটিং স্যান্ডস' কথাটা ইংরেজিতে ভাগ্যের পরিবর্তন বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। শব্দ দুটি পররাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করতে দেখেছি সে রকম ক্ষেত্রে যখন বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে দুটি দেশের মধ্যে বা দুটি অঞ্চলের মধ্যে সম্পর্কে মস্ত বড় পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখানে আমার দুটো অভিজ্ঞতার কথা বলি। দুটোই হয়েছে মার্চ, ১৯৭২ থেকে আগস্ট, ১৯৭৬ পর্যন্ত নয়াদিলি্লতে কাজ করার সময়।
প্রথমটি হলো, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের হাতে পরাজিত ও বন্দি পাকিস্তানি সৈন্যদের নিয়ে। ওই যুদ্ধের শেষের দিকে এসে বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী মিলে মিত্রবাহিনী তৈরি হয়। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ও তারপর কয়েক দিন যে পাকিস্তানি হানাদাররা আত্মসমর্পণ করল তাদের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভারতে নিয়ে গিয়ে বন্দি শিবিরে আটকে রাখা হয়। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালের প্রথমার্ধে ভারত খুব জোর দিয়ে বলত যে এদের মুক্তি দেওয়াটা নির্ভর করছে বাংলাদেশের অনুমতির ওপর, আর সে জন্য পাকিস্তানের উচিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা। কিন্তু পাকিস্তান তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল না। এদিকে ১৯৭৩ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে লক্ষ্য করলাম, ভারতে বিভিন্ন মাধ্যমে বলা হচ্ছে যে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের আটকে রাখতে, তাদের খাওয়াতে-দাওয়াতে ভারত সরকারের অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। তারপর শুনলাম যে খরার দরুন ভারতে শস্য উৎপাদন কম হওয়ায় মূল্যস্ফীতি হচ্ছে, ওই সময় এক লাখ পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দির পেছনে ভারত সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ করতে থাকাটা যুক্তিসংগত হচ্ছে না। তাই যুদ্ধবন্দি সমস্যাটি এখন মিটিয়ে ফেলা উচিত। এ ক্ষেত্রে আকার-ইঙ্গিতে বাংলাদেশকেই নমনীয় হতে বলা হলো। এর কদিন পর দিলি্লর একটি ইংরেজি পত্রিকায় একটি নিবন্ধ পড়লাম, যাতে পরিষ্কার লেখা ছিল, উত্তর ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সংস্কৃতির অনেক মিল আছে, যে জন্য ভারতের একটা বড় জনগোষ্ঠী পাকিস্তানের সঙ্গে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান চায়। তা ছাড়া উত্তর ভারতে বসবাসকারী অনেক পরিবার পাকিস্তান থেকে ভারতে এসেছে, আর উত্তর ভারত থেকে অনেকে পাকিস্তানে চলে গেছে এবং এই দুই অভিবাসী গোষ্ঠীই তাদের আদি বাসস্থানের মানুষদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে চায়। তাই এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের প্রশ্নটির আশু সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। অতএব বাংলাদেশও যেন উপমহাদেশের বৃহত্তর স্বার্থে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করে। সোজা কথা, বাংলাদেশ যেন ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নতি করার পথে কাটা হয়ে না দাঁড়ায়। ১৯৭১-এর ডিসেম্বর বা পুরো ১৯৭২ এর বাংলাদেশ-ভারত হরিহরাত্মা যে সম্পর্ক ছিল ১৯৭৩-এর দ্বিতীয়ার্ধে তা স্পষ্টই বদলে যাচ্ছিল এবং এ কথাও ঠিক যে ভারত সরকারকে তখন উত্তর ভারতীয়দের মনোভাব হিসাবে নিতে হচ্ছিল। ১৯৭৩-এর শেষার্ধে আমরা পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের তাদের দেশে আর পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালিদের বাংলাদেশে ফেরত আসতে দেখলাম। এ বিষয়ে চুক্তি হয়েছিল ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে নয়াদিলি্লতে। অতঃপর ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ একে অপরকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান গেলেন এবং পাকিস্তানের সরকার প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ সফর করলেন। যেসব পাকিস্তানি বন্দির বাংলাদেশে যুদ্ধ করার জন্য বিচার করার কথা ছিল তারাও ক্ষমা পেয়ে দেশে ফিরে গেল, বিচার আর হলো না। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের জন্য চিহ্নিত পাকিস্তানিদের মাফ করে দেওয়ার চুক্তিও দিলি্লতে সম্পাদিত হয়েছিল বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। '৭২ থেকে '৭৪ এই অল্প সময়ের মধ্যে এই তিন দেশের সম্পর্কের কত বড় পরিবর্তন হয়ে গেল।
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতাটি ভারতের ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করার বিষয়ে। ১৯৭২ সালের লোকসভার বাজেট অধিবেশনের শেষ দিকে ভারতের পানি সম্পদমন্ত্রী ড. কে এন রাও এক বিবৃতিতে বলেন, গঙ্গা থেকে ২২০০০ কিউসেক পানি নিলেই ভারতের চলবে। সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার আনন্দবাজার গোষ্ঠীর হৈচৈ শুরু হয়ে যায় তাঁর বিবৃতির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। সেই বছরই লোকসভার পরবর্তী অধিবেশনে ড. কে এল রাও তাঁর আগের বিবৃতি প্রত্যাহার করে নিলেন। ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে ভারত যথেষ্ট চাপ দিয়ে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের অনুমতি আদায় করে অন্তত এক মৌসুমের জন্য ফারাক্কা বাঁধ চালু করতে। সেই চলা আজও চলছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আজকাল জানতেই পাচ্ছে না যে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার কতটুকু পানি এ দেশে আসে। তারা দেখে ধু-ধু বালুচর। এ বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষ পশ্চিমবাংলার বাঙালিদেরকেও পাশে পায়নি। এখানে আমাদের পররাষ্ট্রীয় সম্পর্ক কোনো কাজ করেনি। এভাবেই সম্পর্ক মোড় নেয়।
আসলে যেকোনো দেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কের মূল বিবেচ্য হলো নিজের স্বার্থরক্ষা। আর তা রক্ষা করতে হবে আজ, কাল ও সুদূর ভবিষ্যতে। সাম্প্রতিক সময়ে এ বিষয়ে সবচেয়ে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে চীন। তাদেরকে এখন আর্জেন্টিনার সয়াবিন খামার থেকে শুরু করে আফ্রিকার মরুভূমিতে তেলের খনিতে দেখা যায়। তারা বহু বছর ধরে বিশ্লেষণ করে বের করেছে যে তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য কোন কোন দেশে উৎপাদন হয়। তাদের উৎপাদিত পণ্য কোন দেশ নেবে। তারা গবেষণা করে বের করেছে, তাদের নতুন বাণিজ্য পথগুলো কী হবে এবং তার ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য কোথায় প্রভাব বলয় সৃষ্টি করতে হবে। আর তাই তারা এখন মার্কিন সরকারি বন্ডের সবচেয়ে বড় ক্রেতা।
গত কয়েক মাস বা এমনকি গত কয়েক দিন ধরে বিশ্বে যা ঘটছে সেসবের দিকে একটু ভালো করে তাকালেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের কত রকম পররাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে এবং এ দেশকে সে জন্য এখনো সুদূর ভবিষ্যতে কত কাজ করতে হবে। বাংলাদেশকে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করতে হবে, এ দেশের মানুষের বিদেশে কর্মসংস্থান হতে হবে, বিদেশে বড় বেতনের ও প্রভাবশালী পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য উচ্চমানের শিক্ষিত যুবসমাজ সৃষ্টি করতে হবে। বিদেশে বেশি লাভে রপ্তানি করার মতো পণ্য উৎপাদন করতে হবে, বিদেশ থেকে মূলধন সংগ্রহ করতে হবে, আবার নিজেদের শিল্পখাত সুদৃঢ় করতে হবে প্রতিবেশি দেশগুলোকে ট্রানজিট সুবিধা দেবার সময় নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশে রাজনীতির ও ক্ষমতানিয়ন্ত্রক পরিবর্তনের গতিবিধি বিশ্লেষণ করে সব পরিস্থিতির জন্য কাজে লাগার মতো বন্ধু তৈরি করতে হবে সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে। আমার মনে হয়, এ জন্য বাংলাদেশে পররাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক পাঠ, গবেষণা এবং আলোচনার ক্ষেত্র ও পরিবেশ তৈরি করা দরকার।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.