বার্ড ফ্লু-দুই সপ্তাহে ৩৮ হাজার মুরগি নিধন by ইফতেখার মাহমুদ

শীতের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার (বার্ড ফ্লু) প্রকোপ বাড়ছে। সরকারি হিসাবে, গত ১৫ দিনে বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত প্রায় ৩৮ হাজার মুরগি নিধন করা হয়েছে। তবে বেসরকারি হিসাবে নিধন করা মুরগির সংখ্যা লক্ষাধিক। সরকারি হিসাবে, গত বছর (২০১১ সাল) বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত প্রায় ৫৮ লাখ মুরগি নিধন এবং ৫৭ লাখ মুরগির ডিম ধ্বংস করা হয়। বেসরকারি হিসাবে এমন মুরগির সংখ্যা প্রায় এক কোটি।


খামারিদের সূত্র জানায়, চলতি জানুয়ারি মাসে বগুড়া, জয়পুরহাট, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও ঢাকার আশপাশের ১৭২টি বড় খামার ও কয়েক হাজার ক্ষুদ্র খামারের মুরগি বার্ড ফ্লু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। সরকারি হিসাবে, ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত চলতি বছরে ৩৮ হাজার ৩৭০টি মুরগি নিধন এবং ১০ হাজার ৫২০টি ডিম ধ্বংস করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের হিসাবে, ডিসেম্বর মাসে বগুড়ার গাবতলীর সেতু পোলট্রির বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত ৩৫০টি মুরগি নিধন করা হয়। ওই মাসেই একই এলাকার প্রকৌশলী রোকনের খামারের সাড়ে ১৩ হাজার, টাঙ্গাইলের কালিহাতীর আলাউদ্দিনের খামারের পাঁচ হাজার, গাজীপুরের শ্রীপুরের বরমীতে হাসান পোলট্রির ২৯ হাজার, শ্রীপুর সদরের হ্যাপীর খামারে ১৭ হাজার, নওগাঁর আজিজুলের খামারের সাড়ে তিন হাজার মুরগি এ রোগে আক্রান্ত হয়।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আশরাফ আলী এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে আমরা খোঁজখবর করছি। পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন খামারি জানান, নিধন করা মুরগির জন্য সরকারি ক্ষতিপূরণ প্রায় বন্ধ থাকায় মুরগি আক্রান্ত হওয়ার তথ্য কোনো কোনো খামারি গোপন করছেন।
২০০৮, ২০০৯ ও ২০১০ সাল পর্যন্ত বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত মুরগি মাটিতে পুঁতে ফেলা, ছত্রাক ও জীবাণুনাশক ব্যবহারের জন্য সরকারিভাবে গণমাধ্যমে প্রচার চালানো হয়। মুরগির বাজারগুলোতে এ নিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নানা কার্যক্রমও ছিল। বর্তমানে এসব কার্যক্রম প্রায় বন্ধ।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রস্তুতি প্রকল্প’ রয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের ২০১১-১২ অর্থবছরে দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া হয়। তবে তহবিলের অভাবে আরও পাঁচ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণের দাবি এখনো পরিশোধ করা হয়নি।
ওই প্রকল্পের পরিচালক নজরুল ইসলাম এ ব্যাপারে গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষতিপূরণের দাবির টাকা মন্ত্রণালয়ের কাছে চাওয়া হয়েছে। টাকা এলেই খামারিদের দেওয়া হবে।
বাংলাদেশ পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের মহাসচিব খোন্দকার মহসিন বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত সব খামারিকে সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত করা হয় না। ফলে অনেক খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে জানাচ্ছেন না।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বাংলাদেশে প্রথম এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস ধরা পড়ে সাভারে বাংলাদেশ বিমানের হ্যাচারিতে ২০০৭ সালের ২২ মার্চ। সরকার আক্রান্ত মুরগি নিধনের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ওজন ও জাতভেদে প্রতি কেজি মুরগির জন্য ৮০ থেকে ১৬০ টাকা দেওয়া শুরু করে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০০৯ সালের জুনে দেশে খামারের সংখ্যা ছিল এক লাখ ১৪ হাজার ৭৬৩টি। ২০১০ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৯৮ হাজার ৩২২টিতে। ২০১১ সালের ২০ মার্চ পর্যন্ত খামারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭২ হাজার ১৬৫টি। চলতি জানুয়ারিতে খামারের সংখ্যা ৬৫ হাজারে নেমে এসেছে। এর কারণ মূলত বার্ড ফ্লু।
দেশের বৃহত্তম মুরগির খামার কাজী ফার্মসের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি কাজী জাহিদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় ২০১১ সালে বার্ড ফ্লুর কারণে পোলট্রিশিল্প বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ রোগ থেকে রক্ষা করতে জৈব নিরাপত্তার জন্য নেওয়া প্রায় সব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রতিষেধক আমদানির অনুমতিও দেওয়া হচ্ছে না।
ডিম ও মুরগির বাজারে প্রভাব: মুরগির খামারের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাওয়ায় মুরগির মাংস ও ডিমের জোগান কমছে। এতে এগুলোর দাম বাড়ছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত এক মাসে মুরগির দাম ১৮ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকা হয়েছে। ডিমের দামও ১৪ শতাংশ বেড়ে ২৮ থেকে ৩০ টাকা হালি দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে বনভোজন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক অনুষ্ঠান ও অন্যান্য উৎসবের কারণে মুরগি ও ডিমের চাহিদা বেশি থাকে। চলতি সপ্তাহে ২৪ লাখ কেজি মুরগির মাংসের চাহিদা থাকলেও উৎপাদিত হয়েছে ১২ লাখ কেজি। স্বাভাবিক সময়ে সপ্তাহে মুরগির মাংসের চাহিদা ১৯ লাখ কেজি।
দেশে প্রতিদিন ডিমের চাহিদা দুই কোটি ৬০ লাখ। এর মধ্যে ঢাকার চাহিদা এক কোটি ৩০ লাখ। চলতি সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে ডিম উৎপাদিত হয়েছে এক কোটি ১০ লাখ।

No comments

Powered by Blogger.