আরেকটি নর্দাম্পটনের অপেক্ষায় by উৎপল শুভ্র

ক্র পূরণ হয়েছে, আবার হয়ওনি। গত বছরের ১০ জুলাই না হলো! টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে অবধ্য হয়ে ছিল শুধু ইংল্যান্ড। ব্রিস্টলে চূর্ণ হলো ইংলিশ দর্পও। তাহলে চক্র পূরণ হয়নি বলছি কেন! তা হয়েছে। তবে একটু অন্যভাবে দেখলে যে হয়ওনি। যাদের হারিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের আগমনী ঘোষণা, সেই পাকিস্তানকে যে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর আর হারানো যায়নি!

১৯৯৯ সালের ৩১ মের সেই নর্দাম্পটন এখন ধূসর ছবি। অথচ পাকিস্তানকে হারানোর স্মৃতি রোমন্থন করতে হলে ফিরে যেতে হয় এক যুগেরও বেশি পেছনে। এর পর পাকিস্তানের সঙ্গে দেখা হয়েছে আরও ১৯টি ওয়ানডেতে। টি-টোয়েন্টিতে চারবার। টেস্ট ম্যাচও খেলা হয়েছে ৬টি। পাকিস্তান অবধ্যই থেকেছে।
১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওই জয়ের পর টানা ৪৭টি ওয়ানডে জয়হীন থেকেছে বাংলাদেশ। ২০০৪ সালের এপ্রিলে হারারেতে জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে ওই জয়-খরার অবসান। এরপর কিন্তু মাঝেমধ্যেই ধরা দিয়েছে ‘বড় জয়’। ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে দুবার, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে চারবার, নিউজিল্যান্ডকে পাঁচবার হারিয়েছে বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকাকেও একবার করে মানতে হয়েছে পরাভব। যে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে সম্পন্ন চক্রপূরণের শেষ অংশটুকু, সেই ইংল্যান্ড মাঝখানে এক ম্যাচ পরই হার মেনেছে আবারও। কিন্তু বাংলাদেশের এই দলের খেলোয়াড়দের কারোরই ব্যক্তিগত সুখানুভূতির তালিকায় পাকিস্তানের বিপক্ষে জয় নেই। সবার কাছেই সেটি হয়ে আছে সেই কৈশোরের আনন্দস্মৃতি।
আঙিনায় পাকিস্তান বলেই ফিরে ফিরে আসছে এই আক্ষেপ। আক্ষেপটা আরও বড় হয়ে উঠছে, একটু এদিক-ওদিক হলেই ইতিহাসটা অন্যভাবে লেখা হতো বলে। মুলতানে ধরা দিতে দিতেও মিলিয়ে যাওয়া জয়টা বাংলাদেশের ক্রিকেটে চিরন্তন দুঃখগাথা হয়ে আছে। টেস্ট-পূর্ব বাংলাদেশের স্মরণীয়তম স্মৃতি পাকিস্তান-বধ। টেস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশেরও তা হয়েই গিয়েছিল প্রায়।
আট বছর আগের ওই পাকিস্তান সিরিজটার দিকে ফিরে তাকালে এখন মনে গুনগুন করে ওঠেন রবিঠাকুর, ‘বড়ো বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে...।’ ১১ বছর পরও টেস্ট ক্রিকেটে ‘শিশু’ হয়ে থাকা বাংলাদেশ সত্যিকার শৈশবে কীভাবে এমন ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানের! পেশোয়ারে দ্বিতীয় টেস্টে প্রথমবারের মতো লিড নিয়েছিল বাংলাদেশ। প্রথম ইনিংসে একটা সময় স্কোর ছিল ২ উইকেটে ৩১০। সেখান থেকে ৮ উইকেটে ৩২০! ৩৬১ রানে অলআউট! দ্বিতীয় দিন লাঞ্চের আগ পর্যন্ত নির্বিষ ঢোঁড়া সাপ হয়ে থাকা শোয়েব আখতার বিরতির পর কোন জাদুমন্ত্রবলে বিষধর গোখরা হয়ে গেলেন, সেটি ছিল এক বিস্ময়। যদিও বল নিয়ে পাকিস্তানিদের কারিকুরির দক্ষতার কথাটা ঠিকই মনে করিয়ে দিয়েছিল তা। মুলতানে শেষ দিনের উইকেট অমন ব্যাটিংবান্ধব হয়ে যাওয়া, আম্পায়ারিং—এমন আরও অনেক প্রশ্নই ছিল সেই সিরিজে।
মুলতানের ওই টেস্ট বাংলাদেশের যেকোনো ক্রিকেটাড্ডায় সম্ভবত এখনো সবচেয়ে বেশি আলোচিত। আর বাংলাদেশ-পাকিস্তান টেস্ট লড়াইয়ের কথা উঠলে এমনিতেই মুলতানে ফিরে যেতে হয়। বিস্ময়করভাবে সেটিই যে হয়ে আছে দুই দলের সর্বশেষ টেস্ট!
মুলতান যদি আক্ষেপের অন্য নাম হয়, আনন্দের অন্য নাম নর্দাম্পটন। বিশ্বকাপের ওই ম্যাচ নিয়ে এখনো বাজারে অনেক কথা ওড়ে। তা উড়ুক। মাঠের খেলা দেখার সময় কিন্তু কখনোই কোনো ঝামেলা আছে বলে মনে হয়নি। মনে আছে, বাংলাদেশ ২২৩ রান করার পর নর্দাম্পটনের প্রেসবক্সে এসে দক্ষিণ আফ্রিকান গ্রেট ব্যারি রিচার্ডস বলে গিয়েছিলেন, শুরুতে উইকেট নিতে পারলে ‘বাংলাদেশ হ্যাভ গুড চান্স।’ যত দূর মনে পড়ে, ইমরান খানও এ রকমই কিছু বলেছিলেন।
যে ম্যাচটিতে এমন স্মরণীয় জয়, সেটি বাংলাদেশের ক্রিকেটে অপেশাদারির একটা বড় উদাহরণও হয়ে আছে। সেই ম্যাচের আগের রাতেই টেস্ট স্ট্যাটাসের জন্য বাংলাদেশের আবেদনকে কটাক্ষ করার ‘অপরাধে’ কোচ গর্ডন গ্রিনিজকে বরখাস্ত করা হয়। কর্মকর্তারা একাদশ নির্বাচন করেন এই বিবেচনায়—‘শেষ ম্যাচ, যারা খেলেনি তাদের খেলিয়ে দাও।’ নিয়ামুর রশিদ এতেই নাতিনাতনিদের সঙ্গে গল্প করার রসদ পেয়ে যান।
কত দিন আগে ওই ম্যাচ! অথচ সেই ম্যাচের একজন আছেন এই সিরিজেও—শহীদ আফ্রিদি। বাংলাদেশের দুই খেলোয়াড়ও আছেন, তবে মাঠের বাইরে অন্য ভূমিকায়। আকরাম খান ও মিনহাজুল আবেদীন এখন নির্বাচক। বাংলাদেশের ওই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে একমাত্র আকরাম খানই ওই জয়ের স্বপ্ন দেখেছিলেন বলে দাবি করতে পারেন। ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জিতে বিশ্বকাপে খেলা নিশ্চিত হওয়ার পর এই প্রতিবেদককে দেওয়া অধিনায়কের সাক্ষাৎকারের শিরোনাম ছিল—‘বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর স্বপ্ন দেখি।’
নর্দাম্পটনের প্রতিশোধ কিন্তু পাকিস্তান নির্মমভাবেই নিয়েছিল। ২০০০ সালের এশিয়া কাপে এই ঢাকাতেই দুই দলের পরবর্তী দেখা। তাতে বাংলাদেশকে ৮৭ রানে অলআউট করে দিয়ে পাকিস্তান জিতেছিল ২৩৩ রানে। যা ছিল তখন ওয়ানডেতে সবচেয়ে বড় জয়ের রেকর্ড। ওই ম্যাচের একটা মজার গল্প এখনো খেলোয়াড়দের মুখে ফেরে। গতি আর শর্ট বলে ঝড় তোলা ওয়াসিম আকরাম নর্দাম্পটনের ম্যান অব দ্য ম্যাচ খালেদ মাহমুদের অপেক্ষায় ছিলেন। নাম মনে করতে না পেরে শারীরিক আকৃতির বর্ণনা দিয়ে বাংলাদেশের এক ব্যাটসম্যানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ও নামছে না কেন?’ ‘ও’ মানে খালেদ মাহমুদ যে ততক্ষণে আউট হয়ে ফিরে গেছেন, আকরাম তা বুঝতেই পারেননি!
পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের গল্পে আর কত দিন একক অধ্যায় হয়ে থাকবে নর্দাম্পটন? টি-টোয়েন্টিটি বাদ দিলে এবার পুরো সিরিজটিই বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে। পাকিস্তানের বিপক্ষে আরেকটি বিজয়ের গল্প কি লেখা হবে এবার!

No comments

Powered by Blogger.