আইজি প্রিজনসের সাফাইয়ের চেষ্টা by ওমর ফারুক

সিলেট কারাগারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ার এক দিন পরই আইজি প্রিজনস নিজের পক্ষে সাফাই বাড়ানো এবং নিজের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের উদ্যোগ নেন। তিনি দেশের ৬৭টি কারাগারের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন, তাঁকে বন্দিরা আইজি প্রিজনস হিসেবে দেখতে চায় কি না তা মৌখিকভাবে জানাতে। এ ছাড়া একটি বেসরকারি টিভিতে 'জাতীয় মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকতে দেওয়া হয়নি_আপনি কি কারা কর্তৃপক্ষের এ আচরণ সমর্থন করেন?' এমন প্রশ্ন দিয়ে চালানো জরিপে 'হ্যাঁ' অর্থাৎ 'সমর্থন করি'তে মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে ভোট করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

কারা অধিদপ্তর থেকে দেশের ৬৭টি কারাগারের কর্মকর্তা ও কারারক্ষীদের এ নির্দেশ দেওয়া হয় বলে একাধিক কারা কর্মকর্তা ও কারারক্ষী কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন। জানা গেছে, যদি কেউ মোবাইল ফোনে ভোট দিতে না চান, তাঁর নাম যেন অনুগতরা লিখে রাখেন_এমন নির্দেশও দেওয়া হয়। শুধু নির্দেশই নয়, বৃহস্পতিবার গভীর রাত পর্যন্ত এই ভোট দেওয়ার কথা লিখে কারাগারে লিফলেটও ছাড়া হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেই কারারক্ষীদের মধ্যে দুই হাজার লিফলেট বিলি করা হয় বলে কয়েকজন কারারক্ষী কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন।
জানা গেছে, গত রাতে ওই টেলিভিশনে ভোটের ফলাফলও প্রচারিত হয়েছে। তাতে 'হ্যাঁ' অর্থাৎ কারা কর্তৃপক্ষের আচরণের পক্ষে ভোট পড়েছে ৮৭ শতাংশ। আর 'না'তে ভোট পড়েছে ১৩ শতাংশ।
কারাগারের একটি সূত্র দাবি করেছে, তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে 'হ্যাঁ' ভোটগুলো কারাগার-সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোনগুলো থেকেই এসেছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আইজি প্রিজনস ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আশরাফুল ইসলাম খান গত সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এসব মিথ্যা কথা। আমি নিজের জনপ্রিয়তা নিজে কেন যাচাই করতে যাব?' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাউকে ভোট করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়নি। আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, 'কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও কারাগারে ঢুকতে দেওয়া হয় না। কারাগার একটি স্পর্শকাতর জায়গা। যদি মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানকে ঢোকার অনুমতি দিতাম, তাহলে তিনি যাওয়ার পর যদি কোনো সন্ত্রাসী তাঁকে আক্রমণ করে বসত, তার দায় কে নিত?'
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯-এর ১২ (গ) ধারায় বলা হয়েছে, যেসব স্থানে সাধারণ মানুষকে আটকে রাখা হয়, যেমন- কারাগার, সেসব স্থানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পরিদর্শন করতে পারবে। সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন ঠেকাতে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে মানবাধিকার কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠাবে।
কারা সূত্র জানায়, সিলেটের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান আইজি প্রিজনসের পদত্যাগ দাবি করার পর থেকে তিনি বেশ উদ্বিগ্ন রয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাত ৩টা পর্যন্ত তিনি কারা অধিদপ্তরে অফিস করেছেন। গতকাল শুক্রবারও তিনি অফিসে ছিলেন।
একটি জেলা কারাগারের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে গতকাল টেলিফোনে বলেন, "বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে কারা সদর দপ্তর থেকে ফোন করে বলা হয়, 'একটি টিভিতে এসএমএসে ভোট চাওয়া হয়েছে। আপনার জেলের প্রত্যেক কারারক্ষীকে বলুন মিনিমাম ১০০টি করে এসএমএস করার জন্য।'" সদর দপ্তরের নির্দেশ পেয়ে ওই কর্মকর্তা কারারক্ষীদের জানালে অনেকে এতে নাখোশ হন। তাঁরা ওই কর্মকর্তাকে বলেন, 'আমরা গরিব মানুষ। এত এসএমএস কিভাবে করব?' বিষয়টি পরে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তাকে জানানো হলে তিনি ওই কর্মকর্তাকে ধমক দিয়ে বলেন, 'যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাই করতে বলুন। তা না হলে চাকরি থাকবে না।'
বৃহস্পতিবার সকালে সিলেট কারাগারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যানকে ঢুকতে দেওয়া না হলে এ বিষয়টি মিডিয়ায় বেশ আলোচিত হয়। রাত ১১টার দিক থেকে বেসরকারি একটি টেলিভিশনে ভোট চাওয়া হয় এই বলে যে, 'জাতীয় মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আপনি কি কারা কর্তৃপক্ষের এ আচরণ সমর্থন করেন? (এ) হ্যাঁ (বি) না (সি) মন্তব্য নাই। যেকোনো মোবাইল ফোনে ৯৯৩৪ নম্বরে মতামত পাঠানো যাবে।'
এর পরই 'এ' তে ভোট দেওয়ার জন্য আইজি প্রিজনসের পক্ষ থেকে কারা কর্মকর্তা ও রক্ষীদের বাধ্য করা হয় বলে জানা গেছে। কারাগারের সিকিউরিটি সেলের একজন ডেপুটি জেলারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, বেশি বেশি এসএমএস করার জন্য আইজি প্রিজনসের অনুগত জেলার পর্যায়ের কারা কর্মকর্তাদের টাকা পাঠানোর জন্য। পরে রাতেই বিভিন্ন কারাগারে এসএমএস করার জন্য টাকা পাঠানো হয়। জানা গেছে, খুলনা কারাগারে এসএমএস করার জন্য কারারক্ষীদের মাঝে দুটো করে সাবানও বিতরণ করা হয়।
তবে এসব বিষয় অস্বীকার করেছেন আইজি প্রিজনস। তিনি এ প্রতিবেদককে 'কারা তাঁর বিরুদ্ধে বলছে' তাদের নাম বলে দেওয়ার আহ্বান জানান। আইজি প্রিজনস বলেন, 'যাদের বিভিন্ন সময় অপরাধের জন্য শাস্তি দেওয়া হয়েছে, তারাই আজ আমার বিরোধিতা করছে।'
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমিও শুনেছি, আইজি প্রিজনস তাঁদের পক্ষে ভোট করার জন্য কারা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন।'
সিলেট কারাগার পরিদর্শনের আগে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রাজশাহী, যশোর, গাইবান্ধা, জয়দেবপুরসহ কয়েকটি কারাগার পরিদর্শন করে এসেছেন। সে সময় তাঁকে কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি। কিন্তু সিলেট কারাগারে প্রবেশ করতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয় তাঁকে। বিষয়টির অনুসন্ধান করতে গিয়ে পাওয়া গেছে দুর্নীতির চিত্র। সিলেট করাগারে বর্তমানে প্রায় তিন হাজার বন্দি রয়েছে। তাদের প্রায়ই দুপুরে ভাত না দিয়ে সকালের রুটি দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হয় বলে কারা সূত্রে জানা যায়। এ ছাড়া যে পরিমাণ ডাল দেওয়ার কথা, তার অর্ধেক দেওয়া হয়। ফলে দিন দিন ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে বন্দিদের মাঝে। এ ছাড়া কারাবিধি ভেঙে আসামিদের স্বজনদের দেখা করিয়ে দিয়ে টাকা কামাই করা হয়। এর বড় একটি অংশ যায় ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে। বন্দির কোনো স্বজন ৫০০ টাকা করে দিলেই তাঁকে কারাগারের ভেতরে দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়। মাসে তিন হাজার করে টাকা দিলে বাইরে থেকে বন্দিদের জন্য ভেতরে খাবার পাঠানোর সুযোগ দেওয়া হয়।
তবে এসব বিষয় অস্বীকার করেছেন সিলেট কারাগারের জেলার নেছার আলম মুকুল। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কোনোভাবেই কারাগার থেকে দুর্নীতি করে টাকা কামানো সম্ভব নয়। ওপরে দেওয়া তো পরের কথা। '
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান সিলেট কারাগারে যাওয়ার পর সেখানকার জেল সুপারের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শহীদুল ইসলাম তাঁকে কারাগারে ঢোকার অনুমতি দেন। কিন্তু আটকে দেন জেলার নেছার আলম মুকুল। গতকাল সন্ধ্যায় টেলিফোনে নেছার আলম মুকুলের সঙ্গে কথা বললে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, 'আমার ওপরের কর্মকর্তা নির্দেশ দিলে আমি কেন যেতে দেব না?'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. মিজানুর রহমান বলেন, জেল সুপার ঢোকার অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু জেলার আইজি প্রিজনসের সঙ্গে কথা বলে আটকে দেন। জেলার বলেন, 'আইজি প্রিজনসের অনুমতি ছাড়া কোনোভাবেই তাঁকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।' জেলার আইজি প্রিজনসের বরাত দিয়ে ড. মিজানুর রহমানকে বলেন, 'আপনি যদি কোনো একদিন সময় দিয়ে কারাগারে আসেন তাহলে আপনাকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হবে।' ড. মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আগে থেকে শিডিউল করে কেন কারাগারে যেতে হবে? এর মানে কে না বোঝে? আমি তো সাজানো নাটক দেখতে কারাগারে যাব না। ঝটিকা সফরে না গেলে আসল চিত্র পাব কোথা থেকে?'
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন কারাগারের দুর্নীতি-অনিয়মের ব্যাপারে মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ আসছে। তারা জানতে পারছে, দেশের ৬৭টি কারাগার থেকে প্রতি মাসে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে গ্রহণ করে তা ঊর্ধ্বতন কারা কর্মকর্তারা ভাগাভাগি করে নেন। সূত্র মতে, শুধু সিলেট কারাগার থেকেই প্রতি মাসে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা কারা সদর দপ্তরে পেঁৗছে।
ড. মিজানুর রহমান বলেন, 'কারাগারের ভেতরে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য কারাগারে যাই। সেখানে গিয়ে আমরা দেখছি বন্দিদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা হচ্ছে, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী খাবার দেওয়া হচ্ছে কি না, হাসপাতালে আসল রোগী রাখা হচ্ছে, নাকি টাকার বিনিময়ে সুস্থ মানুষকে সেখানে রাখা হচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য আমরা কারাগারে যাই।'
কারাগারের একাধিক সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবসের দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। এই অপরাধে তৎকালীন আইজি প্রিজনস জাকির হাসান ও ডিআইজি প্রিজনস মেজর (অব.) শামসুল হায়দার ছিদ্দিকীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু ওই সময় আশরাফুল ইসলাম ছিলেন কারা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত আইজি প্রিজনস। সেই বিতর্কিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তিনিও যোগ দিয়েছিলেন এবং পুরো অনুষ্ঠানে তাঁকে হাস্যোজ্জ্বল দেখা যায়। কিন্তু ওই ঘটনায় আশরাফুল ইসলামের কোনো শাস্তি হয়নি। বরং তিনি পদোন্নতি পেয়ে আইজি প্রিজনস হয়েছেন_যে ঘটনাটি অবাক হওয়ার মতো বিষয় বলেই মনে করেন অনেক কারা কর্মকর্তা।

No comments

Powered by Blogger.