বুড়িগঙ্গার ঘাটে ঘাটে চলছে চাঁদাবাজি by আপেল মাহমুদ

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস পদ্মা নদীর মাঝির অন্যতম চরিত্র কুবের মাঝি। মৎস্যজীবী এ চরিত্রটি লেখক সৃষ্টি করেছিলেন বিক্রমপুরের পদ্মা নদীর তীর থেকে। চরিত্রটির ওপর মহাজনের যে বঞ্চনার চিত্র পাওয়া যায়, সেটা পুরো জেলে সমাজের প্রতীক হয়ে ওঠে। কুবের মাঝি পদ্মা থেকে ইলিশ ধরে বিক্রি করতে গিয়ে মহাজনের কাছ থেকে ন্যায্য দাম পাননি। তেমনি বুড়িগঙ্গার মাঝিরা সারা দিন যে আয় করেন, তার সিকিভাগও ভোগ করতে পারেন না। আয়ের বেশির ভাগ টাকাই চলে যায় মহাজনরূপী চাঁদাবাজদের পকেটে। সরকার আসে সরকার যায়। ক্ষমতার পালাবদল শেষ হলেও, বুড়িগঙ্গার মাঝিদের বঞ্চনার দিন যেন শেষ হতে চায় না।

৭৫ বছর বয়সী হেলিমউদ্দিন ছৈয়াল ৬০ বছর ধরে বুড়িগঙ্গায় যাত্রী পারাপারের কাজ করছেন। মাদারীপুরের মাতবরেরচর থেকে ভাগ্যান্বেষণে ঢাকায় এসে নৌকার বৈঠা হাতে তুলে নিয়েছিলেন। তা আর ছাড়তে পারেননি। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রথম জীবনে তিনি বুড়িগঙ্গার টলটলে পানিতে নৌকা চালিয়েছেন। বর্তমানে এর রং হয়ে গেছে বিষাক্ত ও কালো কুচকুচে। তাঁর জীবনটাও বর্তমান বুড়িগঙ্গার পানির মতো হয়ে গেছে। সারা দিন রোদে পুড়ে এবং কখনো বৃষ্টিতে ভিজে যে রোজগার করেন, এর বেশির ভাগই চলে যায় বিভিন্ন চাঁদার খাতে। পাঁচ বছর আগে স্ত্রী জোহরা খাতুন মারা গেছেন। হেলিমউদ্দিন বলেন, মরার সময় তাঁর মুখে পানি দেওয়ারও কেউ নেই।
পুরান ঢাকার চাঁদনীঘাট, সোয়ারীঘাট, চম্পাতলীঘাট, রাজারঘাট, বাদামতলীঘাট, নওয়াববাড়িঘাট, ওয়াইজঘাট, সদরঘাট, লালকুঠিঘাট, শ্যামবাজারঘাট ঘুরে জানা গেছে, সব মিলে প্রায় পাঁচ হাজার মাঝি যাত্রী পারাপার করেন। প্রতিদিন কাকডাক ভোরে বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ তীরের জিঞ্জিরা, কালীগঞ্জ, শুভাঢ্যা, আগানগর, হাসনাবাদ, চুনকুটিয়া, খোলামোড়া, রসুলপুর, ইমামবাড়ী, কদমতলা, চরকুতুব, ঝাউবাড়ী, কাঠুরিয়া, কালিন্দী, ঢাকপাড়া প্রভৃতি এলাকার কমপক্ষে তিন লাখ লোক এসব ঘাট দিয়ে নদী পার হন। অপরদিকে কেরানীগঞ্জ থানাধীন বিভিন্ন মার্কেট, দোকানপাট ও কারখানার উদ্দেশ্যে ঢাকা শহর থেকে প্রতিদিন প্রায় এক লাখ লোক আসা-যাওয়া করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সোয়ারীঘাট থেকে পোস্তগোলা পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরে ছোট-বড় মিলিয়ে ৪০টি খেয়াঘাট রয়েছে। এসব খেয়াঘাটে কমপক্ষে তিন হাজার ডিঙ্গি নৌকা যাত্রী পারাপার হয়ে থাকে। এ নৌকা পালাক্রমে ছয় হাজার মাঝি চালিয়ে থাকেন বলে সরেজমিন নদীর তীরে গিয়ে জানা যায়। এর মধ্যে সদরঘাটের পূর্ব-পশ্চিম পাশে তেলঘাট (সদরঘাট), সিমসনঘাট, ওয়াইজঘাট, বাদামতলীঘাট, সোয়ারীঘাট ও শ্যামবাজারঘাট দিয়ে সবচেয়ে বেশি যাত্রী নদী পারাপার হয়ে থাকেন। তা ছাড়া সোয়ারীঘাট, বাদামতলীঘাট এবং শ্যামবাজার ঘাটে খেয়ানৌকা ছাড়াও বড় বড় নৌকা দিয়ে বিভিন্ন মালামাল দেশের বিভিন্ন স্থানে নেওয়ার দৃশ্যও দেখা যায়।
বিভিন্ন ঘাটে যাত্রী পারাপাররত মাঝিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ টাকা রোজগার হলেও তা থেকে সিংহভাগ চাঁদা হিসেবে দিয়ে দিতে হয়। এই চাঁদা দিতে হয় বলেই বছরের পর বছর যাত্রী পারাপার করেও তাঁরা ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেন না। অনেকের তো খুপরি ঘরেও থাকার সামর্থ্য থাকে না। নৌকার মাঝেই রাতের ঘুম সারতে হয়। গোসল করতে হয় বুড়িগঙ্গার বিষাক্ত পানিতে।
আবদুর রশীদ নামে একজন মাঝি জানান, গভীর রাতে বুড়িগঙ্গা নদীতে এলে দেখা যাবে শত শত মাঝি নৌকার মধ্যেই ঘুমিয়ে আছেন। তাঁর মতে, মাঝিদের ২৫ শতাংশেরই ঘর ভাড়া দেওয়ার সাধ্য নেই বলে নদীতে রাত কাটান। এখানে এমন মাঝিও পাওয়া যাবে, তাঁরা ২০-২৫ বছর ধরে যাত্রী পারাপার করলেও বুড়িগঙ্গার নৌকার মাঝে রাত কাটিয়ে দিচ্ছেন।
মাঝিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নদী পারাপারে হাজার হাজার নৌকা দেখা গেলেও তার একটি নৌকার মালিকানা তাদের নেই। মাঝিদের শোষণ করার জন্য বুড়িগঙ্গায় বেশ কিছু মহাজন শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে। একেকজন মহাজনের ৩০-৪০টি করে নৌকা রয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে প্রতিদিন ৫০ টাকা ভাড়ায় নৌকা নিতে হয়। এমনকি নৌকার মালিকানা মহাজনদের হলেও এর পাহারাবাবদ প্রতিদিন ১০ টাকা হারে চাঁদা আদায় করা হয় মাঝিদের কাছ থেকেই। বাংলাদেশ নৌকা মাঝি লীগের সভাপতি দাবিদার জাবেদ হোসেন মিঠু কালের কণ্ঠকে বলেন, এ নিয়ম দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। নৌকা মহাজনদের হলেও তা চোরের হাত থেকে রক্ষার দায়িত্ব মাঝিদেরই, যার কারণে রাতেরবেলার নিরাপত্তার জন্য পাহারাদারদের খচর হিসেবে টাকাটা দিতে হয়।
অভিযোগ উঠেছে, বুড়িগঙ্গা নদীর বিভিন্ন ঘাটে বাংলাদেশ নৌকা মাঝি লীগের ব্যানারে প্রতিদিন মাঝিদের কাছ থেকে ২০ টাকা হারে চাঁদা আদায় এবং জোরপূর্বক তাঁদেরকে সে সমিতিতে সদস্য করা হচ্ছে। কেউ এ চাঁদা না দিলে এবং সমিতির সদস্য না হলে বুড়িগঙ্গায় যাত্রী পারাপার করতে পারেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মাঝি বলেন, আগে স্বাধীন মতো যাত্রী পারাপার করতে পারলেও বর্তমানে সবাই তাদের কাছে জিম্মি। এভাবে লক্ষাধিক টাকা দৈনিক আদায় হচ্ছে বলে কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা যায়। তবে বাংলাদেশ নৌকা মাঝি লীগের সভাপতি জাবেদ হোসেন মিঠু ওই সংগঠনটিকে জাতীয় শ্রমিক লীগের অঙ্গসংগঠন দাবি করে বলেন, নৌকার মাঝিদের কাছ থেকে কোনো চাঁদা আদায় করা হয় না, সঞ্চয় আদায় করা হয়। সে সঞ্চয় থেকে মাঝিদের উন্নয়ন করা হয়।
সদরঘাটের দুই পাশে তেলঘাট, সিমসনঘাট ও ওয়াইজঘাটের ইজারাদারের দায়িত্বও পালন করছেন জাবেদ হোসেন মিঠু। তিনি খেয়াঘাট তিনটি এক কোটি ৬২ লাখ টাকায় বিআইডাবি্লউটিএর কাছ থেকে ইজারা নিয়েছেন বলে জানান। ইজারার শর্ত হলো_নির্ধারিত ভাড়ার বিনিময়ে ইজারাদার নিজস্ব নৌযান দিয়ে যাত্রী পারাপার করে দেবেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ইজাদার নির্ধারিত টোল নেওয়ার পর যাত্রীদের ভাগ্য তুলে দিচ্ছেন খেয়ামাঝিদের হাতে, যার কারণে একজন যাত্রীকে ইজাদারের টোল দেওয়ার পরও অতিরিক্ত হিসেবে নৌকার ভাড়া দিতে হচ্ছে।
বিআইডাবি্লউটিএ সূত্রে জানা গেছে, এ শর্ত ভঙ্গের কারণে ঘাট ইজারা বাতিল করা যায়। কিন্তু রাজনৈতিক চাপের কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। ইজারাদার মিঠু বলেন, এক বছরের জন্য ঘাট ইজারা নিয়ে শত শত নৌকা নির্মাণ করা হলে, পরে সে নৌকাগুলোর ভাগ্যে কী ঘটবে? যার কারণে তিনি নিজস্ব নৌকা দিয়ে যাত্রী পারাপার করছেন না। দীর্ঘমেয়াদি ঘাট ইজারা দিলে তিনি নিজস্ব নৌকা দিয়ে যাত্রী পারাপার করবেন বলে জানান।

No comments

Powered by Blogger.