অপরাধী আর কেউ নয়, আমি by মুস্তাফা জামান আব্বাসী

বড় জালিম নিজে, সবচেয়ে অপরাধী। মাছের পেটে আশ্রয় নেওয়ার পর ইউনুস নবী যে দোয়া পাঠ করেছিলেন, তা স্মরণ করতে পারি। ‘আমার চেয়ে জালিম পৃথিবীতে আর কেউ নয়।’ যে অন্যায় করে চলি তার হিসাব তো একদিন হবেই। এ অপরাধের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী প্রতিদিন আল্লাহর কাছে, মানুষের কাছে, সবার কাছে।
ব্রিটিশ যখন মোগলদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়, সে লড়াইয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল লাখো মানুষ, নারীরা বিসর্জন দিয়েছেন সম্মান। সে কথা আর কে মনে রেখেছে? শত সমরাঙ্গনের ইতিহাস সাক্ষী দেয়, যেখানে ব্রিটিশরা নিষ্ঠুর বর্বরতায় স্বাধীনতাকামীদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়েছে। বালাকোটের যুদ্ধে আমাদের সমরাঙ্গন সিলেটে প্রাণ দিয়েছেন আমার নিজ আত্মীয়। তাঁর নাম ইব্রাহিম আলী তোশনা [১৮৭২—১৯৩৩]। প্রাণ দিয়েছেন: মৌলবী আবদুল সালাম (বায়মপুর), মুহাম্মদ মুসা মিয়া (দুর্লভপুর), আবদুুল আজিজ (বাউরভাগ), হাজি আজিজুর রহমান (সরদারিপাড়া), ইয়াসিন মিয়া (চট্টগ্রাম)। কানাইঘাটে এই শাহাদতের কথা সবাই ভুলে যেতে পারে, কিন্তু আমি আমার মৃত্যুদিন পর্যন্ত এই শাহাদতকে স্মরণ করব।
শহীদদের ভুলে গেলে স্বাধীনতা হয় নিরর্থক। ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে লাখো মানুষের শাহাদত দেশের লোক আজ ভুলে গেছে। ওরা ভারতীয়দের নির্বাসন দিয়েছে, অন্ধকূপ হত্যায় অংশ নিয়েছে। নির্যাতিত ছিল হিন্দু-মুসলমান-নির্বিশেষে। তাদের ক্ষমতা, সম্পদ ও ধর্মাচরণের ওপর নেমে আসে অত্যাচারীর খড়্গকৃপাণ। জালিয়ানওয়ালাবাগের কথাও ভুলতে বসেছি। রবীন্দ্রনাথ ‘নাইট’ উপাধি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
ভারত স্বাধীন হলে ভারতের স্বাধীনতা দিবসে লর্ড মাউন্ট ব্যাটন প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসেবে শপথ নেন। এত যে মানবতার বিপর্যয় হলো উপমহাদেশে, তার জন্য দায়ী কে? ব্রিটিশরা সহজেই নিষ্কৃতি পেয়ে গেল। যারা দেড় শ বছর আমাদের ওপর জুলুম করেছে, তাদের সঙ্গে ডিনার খাই, তাদের দেওয়া উপাধি গ্রহণ করি। রাজনীতিতে নেই চিরকালীন শত্রুতা।
‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান, আসি অলক্ষে দাঁড়ায়েছে তারা দিবে কোন বলি দান।’ যাঁরা জীবন দিয়েছিলেন সেদিন, তাঁদের কথা মনে রেখেছেন তাঁরাই, যাঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই স্বাধীনতার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ক্ষুদিরাম, বিনয় বাদল দীনেশ, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও এর সঙ্গে জড়িত হাজার ব্যক্তি নির্যাতন ভোগ করেছিলেন। স্বাধীনতাকামীদের পেছনে ছিল গোয়েন্দা ও পুলিশ, এঁদের জীবনকে করেছিল যারা দুর্বিষহ। এসব ভারতীয় সহচরের বিচারের কথা কেউ বলেননি। যাঁরা আগের অফিসার ছিলেন, পরে বড় পোস্ট অধিকার করেছেন ভারত ও পাকিস্তানে।
১৪-১৫ আগস্ট, ১৯৪৭। উপমহাদেশে ক্ষমতা বদল হলো আপাত রক্তপাতবিহীন। দেড় শ বছরে যাঁরা রক্ত দিয়েছেন, ভারতবাসীকে যারা ভূলুণ্ঠিত করেছিল, তারাই কমনওয়েলথের নতুন বন্ধু। কেউ ভেবে দেখেছেন, যাঁরা ভারতীয়দের অন্যায়ভাবে সেদিন অত্যাচারে অংশ নিয়েছিলেন, সেই সব সামরিক-অসামরিক রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক ব্যক্তি কি কোনোভাবে কারও কাছে কৈফিয়ত দিয়েছেন? তাঁদের আইসিএস অফিসাররাও আমাদের ‘খানবাহাদুর’, ‘রায়বাহাদুর’রা প্রমোশন পেয়ে মন্ত্রী হয়েছেন। সহজেই ভুলে যাই কে ছিল শত্রু, কে ছিল মিত্র। এটাই জগতের নিয়ম!
১৯৭১ সালের দীর্ঘ নয় মাস বাঙালিদের ওপর যে নির্মম অত্যাচার হয়েছে, তার কথাও যেন মনে হয় সুদূর অতীত। যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, তাঁরাই জানেন কত মর্মান্তিক এই স্মৃতি। ১৪ অথবা ১৬ ডিসেম্বর শহীদদের ছেলেমেয়েরা ও আত্মীয়স্বজন যখন টেলিভিশনের সামনে এসে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে থাকেন, তখন অনুভূতি হয় প্রখর। যাঁদের গেছে তাঁরাই শুধু জানেন, তাঁরাই শুধু বোঝেন এই গণহত্যার মর্ম। সময় সব ভুলিয়ে দেয়। এর জন্য যারা প্রত্যক্ষভাবে দায়ী, তারা নিষ্কৃতি পেল কত অনায়াসে। ভারত, পাকিস্তান ও তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে যখন বিচার না করার কথা বলে, তখনো ‘বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে’। যারা পাকিস্তানিদের সঙ্গে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল, তারা ওই সুবিধাপ্রাপ্তদের দলে। এর হয়তো কারণও ছিল। তা হলো, যারা বুলেটের স্টিম রোলার চালিয়েছিল, তারাই যখন দেশে ফিরে গেল, তখন এদের বিচার করার যৌক্তিক ভিত্তি বঙ্গবন্ধুর কাছে ছিল না। তাঁর ওপর চাপ ছিল সর্বাধিক। আমেরিকার, পাকিস্তানের, সৌদি আরবের, ভারতের ও তাঁর পূর্বতন রাজনৈতিক সহযোগীদের। ক্ষমাপ্রাপ্তরা পরবর্তী সরকারগুলোতে পুনর্বাসিত, যা ছিল অগ্রহণযোগ্য ও অভাবিত। ক্ষমা করা আর প্রধানমন্ত্রীত্বে বসানো, দুটোর মধ্যে অনেক তফাত।
ভারতে ১৫ থেকে ২০ কোটি মুসলমান, এদের তো দল থাকবেই। বাংলাদেশেও আছে ১৩ কোটি মুসলমান। এদেরও আলাদা দল থাকতেই পারে। যদি বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে এই বিরোধ কেয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে এবং লস্কর-তস্করের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় বলে, বারুদ চাপা দিয়ে রাখা যায় না। ইসলামি দলগুলোর সংখ্যা বেশ কয়েকটি, এদের মধ্যে মিল নেই, কারও সঙ্গে কারও বনে না। পীড়ন হলেই নতুন শক্তিতে জেগে উঠবে তারা। সে শক্তি সামলানো কঠিন হবে। সালমান রুশদি নবীর বিরুদ্ধে লিখলে সারা দেশ গর্জে ওঠে, অথচ নবীর জন্য তারা তেমন কিছুই করে না। অভিজ্ঞানটির সঙ্গে সবার পরিচয় আছে—এটা বাস্তবতা।
দেশটিতে ৯০ ভাগ মুসলমান। গ্রামে বাস করে তারা এবং পরিপূর্ণভাবে সমর্পিত আল্লাহ এবং রাসুলে। স্বাধীনতার সুফল তাদের কাছে পৌঁছেছে বলে মনে হয় না। যাঁরা সরকারে আজ আছেন অথবা কাল, তাঁরা ভোটের সময় ইসলামি লেবাস পরে ভোট চাইতে যান। কাজ ফুরোলে অন্য রূপ। ভোটাররা এই চালাকি অনুভব করেন। যুদ্ধকালে যাঁরা পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন, তাঁরা মানবতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে থাকলে তার বিচার সবাই কামনা করেন। যারা অপরাধ করেছে, তাদের অপরাধ ক্ষমা করা হবে না—এটাই জনগণের রায় বলে মনে হয়। এ নিয়ে খানিকটা সংশয় যে নেই, তাও নয়।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পালিত হবে ২০২১ সালে। স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তান, ভারত, মস্কো, চীনপন্থীদের রাজনীতি। কারও বা অঘোষিত রাজনীতি, ইসলামের পরাজয়। ‘ইসলামি’ না ‘সেক্যুলার’, তা বলবে দেশের জনগণ। কিছুসংখ্যক ভ্রান্ত ‘মুজাহিদ’ একসঙ্গে কয়েকটি পটকা ফুটিয়ে দেশে ইসলামি শাসন আনতে চায়, যা সফলতার মুখ দেখবে না। যত দিন দেশের মানুষ ইসলামের মূল দৃষ্টিভঙ্গিতে সমর্পিত হবে না, তত দিন এটি হওয়ার নয়। ইরান অপেক্ষা করেছে ২৫০০ বছর।
যদি বলি আমি নিজে অপরাধী, কেউ কিছু বলবে না। যে মুহূর্তে বলব সবাই অপরাধী, তাহলে ভ্রূকুঞ্চন। উত্তমকুমার অভিনীত থানা থেকে বলছি চলচ্চিত্রের প্রতিটি চরিত্রের কথা স্মরণ করা যেতে পারে, যেখানে এক মহিলার করুণ মৃত্যুর পর দেখা গেল তার মৃত্যুর জন্য সংশ্লিষ্ট চরিত্রগুলোর সম্পৃক্ততা। দেশ ভাগ হলো, লাখ লাখ লোক শহীদ হলো, লাখ লাখ লোক নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে নতুন ঘরে এসে আশ্রয় নিল। কে দায়ী? শুধু ব্রিটিশ? আমাদের রাজনীতি, আমাদের পরমত অসহিষ্ণুতা, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি, সম্পত্তি দখলের অভীপ্সা, এগুলোর কোনোটাই দায়ী নয়?
১৯৭১ সালেও লাখ লাখ লোক শহীদ হলো, ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেল কোটি লোক। দেশটি হলো সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত। উঠে দাঁড়াতে পারেনি। একে ওকে দোষ দিয়ে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় আছে কি? আমি নিজে কতটুকু দায়ী, তার দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হবে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমরা অনেকেই থাকব না। সব দোষ কয়েকজনের ওপর না চাপিয়ে বরং ভালো হয়, প্রকৃত অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি দিয়ে সত্যের পতাকার উড্ডয়ন, মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বের উদ্বোধন।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সংগীতব্যক্তিত্ব।
mabbasi@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.