দেশীয় বাস্তবতায় সংস্কারের বিকল্প নেই -রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর দুরবস্থা

অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ নির্দেশিত এ সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য ছিল, ব্যাংকগুলোকে এক পর্যায়ে ব্যক্তিখাতে ছেড়ে দেওয়া হবে। সে কারণে কোটি কোটি ডলার খরচ করে ভাড়া করা হলো পরামর্শক। কোনোটিতে আনা হলো বেসরকারি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। একপর্যায়ে ব্যাংকগুলোকে রূপান্তর করা হলো কোম্পানিতে। কিন্তু কয়েক বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসেনি; আসতে পারেনি। ব্যাংকগুলো চলছে নানা ধরনের অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে। প্রথম আলোয় সম্প্রতি প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সেই অব্যবস্থাপনা ও দুরবস্থারই চিত্র।
বস্তুত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে লোকসানের বোঝা থেকে মুক্ত করতে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থার মধ্যে পরিচালনা করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে সরকারগুলো এসব ব্যাংককে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। ফলে ব্যাংকগুলোয় বেড়েছে খেলাপি ঋণ ও লোকসানের বোঝা। ব্যাংকিং-সেবা বলতে কিছু নেই। সিবিএর দৌরাত্ম্যে ভেঙে পড়েছে নিয়মকানুন। সুতরাং, এসব ব্যাংকের অর্থবহ সংস্কার করতে হলে প্রথমে প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা। রাজনৈতিক সদিচ্ছা যদি জোরালো হয়, তাহলে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট অনিয়ম দূর করা সহজ হয়। সে ক্ষেত্রে বাকি কাজগুলো খুব কঠিন হয় না। অথচ, রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি রেখে বিদেশি পরামর্শক দিয়ে সংস্কার করতে গিয়ে ব্যাংকগুলোতে বিশৃঙ্খলা বেড়েছে বই কমেনি। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবেরও পালাবদল হয়, যার প্রভাব পড়ে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমে।
আবার, সংস্কারের ক্ষেত্রে দেশের ব্যাংকগুলোর প্রকৃত নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্তৃত্ব খর্ব করা হয়েছে। সরকারের ব্যাংক হওয়ায় তা পরিচালনায় অর্থ মন্ত্রণালয় বিভিন্নভাবে হস্তক্ষেপ করে বিশৃঙ্খলা বাড়িয়েছে। তাই, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর তদারকির দায়িত্ব পুরোপুরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দেওয়া জরুরি। পাশাপাশি দেশে অনেক ব্যাংকার ও বিশেষজ্ঞ আছেন, তাঁদের পরামর্শ নেওয়াও প্রয়োজন। প্রয়োজন দেশীয় বাস্তবতার আলোকে ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম ঢেলে সাজানো। এখন পর্যন্ত এ ব্যাংকগুলোরই সবচেয়ে বেশি শাখা সারা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। সুতরাং, শাখাগুলোকে সক্রিয়ভাবে কাজে লাগিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মকাণ্ড গতিশীল করার সুযোগ রয়েছে; সুযোগ রয়েছে কৃষিঋণ বিতরণ জোরদার করারও।
সবচেয়ে বড় কথা, শক্তিশালী ব্যাংকব্যবস্থা একটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। সেই ভিত্তিকে পরিপূর্ণতা দিতে হলে বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি প্রয়োজন প্রতিযোগিতায় সক্ষম রাষ্ট্রীয় ব্যাংক। দেশীয় বিশেষজ্ঞ দিয়ে, দেশীয় আঙ্গিকে সংস্কার করে এসব ব্যাংককে সব ধরনের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে ব্যবসা পরিচালনা করতে দিতে হবে; তাহলে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনায় পেশাদারিত্ব আসবে, ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত হতে পারবে, পারবে লাভের মুখ দেখতে। নীতিনির্ধারকেরা এ বিষয়ে যত দ্রুত মনোযোগ দেবে, তত মঙ্গল।

No comments

Powered by Blogger.