দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ছে জার্মান শিশুরাও

পথে বেরোলেই চোখে পড়বে অসংখ্য পথশিশু নগ্ন দেহে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভিক্ষা করছে, আবর্জনা ঘাঁটছে। কেউ করছে কুলির কাজ। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশে গরিব শিশুদের এ চিত্র খুবই সাধারণ। কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বের কোনো দেশে এই চিত্র ভাবা যায়? হালে শিল্পোন্নত দেশেও শিশু-দারিদ্র্য একটি বড় ধরনের সমস্যা হয়ে উঠেছে। জার্মানির মতো উন্নত বিশ্বের অনেক দেশও এখন এই সমস্যা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
জার্মানিতে অবশ্য তৃতীয় বিশ্বের দেশের মতো রাস্তায় কোনো শিশু না খেয়ে আছে বা পরনের কাপড় নেই, ঠাণ্ডায় কষ্ট পাচ্ছে এমন দৃশ্য চোখে পড়বে না। তবে সে দেশে শিশু-দারিদ্র্য সম্পর্কে জানতে রাস্তায় নয়, যেতে হবে শহরের বাসিন্দাদের বাড়িতে, তাদের ঘরে।
থিল পরিবার এমনই একটি দরিদ্র পরিবার। রাজধানী বার্লিনের শহরতলিতে পরিবারটির বাস। ১২ বছর বয়সের জেসমিন থিল আর তার যমজ ভাই ফ্লোরিয়ানকে দেখে বোঝার উপায় নেই তারা গরিব। তাদের ডিভিডি প্লেয়ার রয়েছে, আছে রঙিন টেলিভিশনও। জেসমিন মোবাইল ফোনও ব্যবহার করে। কিন্তু জার্মানির কয়েক লাখ গরিব শিশুর মধ্যে তারাও দুজন। বার্লিনের এসব দরিদ্র পরিবারের যা কিছু সম্পদ রয়েছে, তা আসলে স্থানীয় দাতব্য সংস্থাগুলোর দান করা। পরনের কাপড় থেকে শুরু করে বাড়ির আসবাবপত্র সব কিছুরই ওই সব দাতব্য সংগঠন ব্যবস্থা করে থাকে।
জেসমিন ও ফ্লোরিয়ানের মা আন্দ্রেয়া থিল। এ মুহূর্তে তাঁর কোনো জীবনসঙ্গী নেই, নেই চাকরিও। স্থানীয় সমাজকল্যাণ সংগঠনগুলোর দেওয়া অর্থে তাঁকে সংসার চালাতে হয়। ওই সব ‘ওয়েলফেয়ার চেক’-এ যে অর্থ সহায়তা পাওয়া যায়, তা দিয়ে আন্দ্রেয়াকে বাসার গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ বিল মেটানোর পাশাপাশি সন্তানদের পড়ার খরচও মেটাতে হয়।
আন্দ্রেয়া বলেন, ‘বাসার ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিল দেওয়ার পর পুরো মাস চলার জন্য মাত্র ২০০ ইউরো অবশিষ্ট থাকে। এটা দিয়েই খাবার, বাচ্চাদের স্কুলের খরচসহ মাসের সব খরচ মেটাতে হয়।’
দুপুরের খাবার খেতে জেসমিন ও ফ্লোরিয়ান স্থানীয় একটি ‘স্যুপ কিচেন’ (লঙ্গরখানা)-এ যায়। ওই স্যুপ কিচেনটিও পরিচালনা করে ডি আর্ক নামের একটি শিশু সাহায্য কেন্দ্র। জার্মানিতে এ ধরনের খাবার ঘরের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে গরির শিশুদের রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তি করা থেকে বিরত রাখা হয়।
ডি আর্কে আন-ম্যারি (৯) নামের এক মেয়েশিশুকে দেখা গেল ব্যবহূত পোশাকের একটি ঝুড়ি ঘাঁটাঘাঁটি করছে। পায়ের জুতো জোড়া দেখিয়ে সে জানাল, এটা এখান থেকেই সংগ্রহ করেছে সে। এ ছাড়া কিছু পায়জামা ও গরম পোশাকও নিয়েছে।
বর্তমানে জার্মানিতে প্রতি ছয়টি শিশুর একটি এই ‘আপেক্ষিক দারিদ্র্যে’র মধ্যে বাস করছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, যেসব পরিবারের মাসিক আয় জাতীয় গড় মাসিক আয়ের ৬০ শতাংশের নিচে, সেসব পরিবারকে দরিদ্র পরিবার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
জার্মানিতে এই শিশু-দারিদ্র্যের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বামী ছাড়া মায়েদের সংখ্যা বৃদ্ধি, উচ্চ জন্মহার এবং কিছু সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড। অবশ্য সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দা এ জন্য তেমন দায়ী না হলেও এর কারণে দরিদ্র শিশুর সংখ্যা বাড়তে পারে—এমন আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। কারণ অর্থনৈতিক মন্দার কারণে জার্মানির অর্থনীতি চলতি বছর ছয় শতাংশ পর্যন্ত সংকুচিত হতে পারে বলে অর্থনীতিবিদেরা পূর্বাভাস দিয়েছেন।
দরিদ্র শিশুদের নিয়ে কাজ করে ‘জার্মান সোসাইটি ফর দ্য প্রোটেকশন অব চিলড্রেন’। সংগঠনটি শিশুদের দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংগঠনের কর্মকর্তাদের ধারণা, মন্দার পুরো প্রভাব অর্থনীতিতে পড়লে দারিদ্র্য অনেক বেশি মাত্রায় বেড়ে যাবে।
দাতব্য সংস্থা ডয়েচেস কিন্ডারহিলফজোয়ের্কের কর্মকর্তা মাইকেল ক্রুজ বলেন, ‘আমাদের এখানে ব্যাংকগুলোতে কোনো সমস্যা দেখা দিলে রাজনীতিকেরা দ্রুত একসঙ্গে বসে সমাধান বের করে ফেলেন। কিন্তু যখন আমরা তাঁদের জানাই, ৩০ লাখ জার্মান শিশুর কোনো ভবিষ্যৎ নেই, তাদের হাতে টাকা-পয়সা নেই, তখন ওই রাজনীতিকেরাই এ ব্যাপারে উদাসীনতা দেখান। আমার ধারণা, সমাজের সমস্যাগুলোকে সঠিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন না তাঁরা।’
শুধু জার্মানি নয়, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলোতেও শিশু-দারিদ্র্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের মন্ত্রীরা স্বীকার করেছেন, ২০১০ সালের মধ্যে সে দেশে গরিব শিশুদের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কষ্টসাধ্য হবে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গরিব শিশুর আবাসস্থল যুক্তরাষ্ট্র। ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে এ বছর আরও ৩০ লাখ শিশু দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে আসবে।

No comments

Powered by Blogger.