ট্রাম্পের ‘মাগা’ যেভাবে পশ্চিমাদের ভাগ করে ফেলছে by ইয়োশকা ফিশার
এ সময়গুলো ইউরোপের জন্য সফল, সুখের ও স্বস্তির ছিল। কিন্তু এ স্বস্তি আমাদের মাত্রাতিরিক্ত আত্মতুষ্ট করে তুলেছিল। আমরা খেয়াল করিনি যে আমেরিকান সাম্রাজ্যের কেন্দ্র থেকে পৃথিবীকে দেখা এক রকম, আর আমাদের ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে আরেক রকম। যত দিন গড়িয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র তত নিজেকে অতিরিক্ত চাপের মধ্যে অনুভব করছিল। সাম্রাজ্যের স্বার্থে তারা ব্যয়বহুল যুদ্ধ করছিল। আর আমরা এদিকে কল্যাণরাষ্ট্র তৈরিতে ব্যস্ত ছিলাম।
ইরাক যুদ্ধ, ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকট, শিল্পক্ষেত্রের পতন এবং মার্কিন অভিজাত ব্যক্তিদের গ্রামীণ ও শ্রমজীবী মানুষকে অবহেলা—সব মিলিয়ে ধীরে ধীরে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, যেখানে একজন ক্ষমতালোভী নেতা সহজেই ক্ষমতায় চড়ে বসতে পারেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ২০১৬ সালের নির্বাচনে জিতে ঠিক সে ঘটনাই ঘটান। প্রথমবার তাঁর জয় সবাইকে এতটাই অবাক করে দিয়েছিল যে সম্ভবত তিনি নিজেও পুরো ঘটনাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি। কিন্তু এক বছর আগে দ্বিতীয়বার তাঁর নির্বাচিত হওয়ার পর বিষয়টি আর নতুন কোনো ব্যাপার ছিল না। গত জানুয়ারিতে ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার শপথ নেওয়ার পর থেকে ট্রান্স-আটলান্টিক বিশ্ব সম্পূর্ণ বদলে গেছে।
ট্রাম্প সম্পর্কে অনেক কিছু বলা যায়, কিন্তু তাঁকে কখনোই ‘ভাবাদর্শিক’ বলা যাবে না। তাঁর একমাত্র আদর্শ হলো তিনি নিজে। তবে তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, তাঁর হোয়াইট হাউসের পরামর্শকেরা এবং পুরো ‘মাগা’ (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন) আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন। তাঁদের কাছে মাগা আন্দোলন একটি আদর্শিক মতাদর্শ।
এ আন্দোলনের প্রধান ভাবাদর্শীদের একজন স্টিভ ব্যানন। তিনি পুরো দুনিয়াকেই এমন এক যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে দেখেন, যেখানে জুডিও-খ্রিষ্টান ঐতিহ্য (জুডিও-খ্রিষ্টান ঐতিহ্য বলতে মূলত জুডাইজম বা ইহুদিধর্ম এবং খ্রিষ্টধর্ম থেকে গড়ে ওঠা একটি যৌথ সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও ধর্মীয় ভিত্তিকে বোঝানো হয়। পশ্চিমা সভ্যতার অনেক মূল্যবোধ, আইন, নীতি ও সমাজব্যবস্থা এ ঐতিহ্য থেকে এসেছে বলে সাধারণভাবে মনে করা হয়) একদিকে, আর তার শত্রুরা অন্যদিকে।
এ জুডিও-খ্রিষ্টান ঐতিহ্যের শত্রুর তালিকায় পশ্চিমা উদার চিন্তাধারাও আছে। ব্যানন মনে করেন, এ সাংস্কৃতিক যুদ্ধে জিততে মিত্র দরকার। আর তিনি বিশ্বাস করেন, ইউরোপের ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদী দলগুলো এমন মিত্র হতে পারে। এখন যেহেতু মাগা যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায়, ব্যানন মনে করছেন ইউরোপের ‘পতনশীল’ সমাজগুলোর ওপর চাপ বাড়িয়ে এ আন্দোলনকে আরও ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।
জেডি ভ্যান্সও গত ফেব্রুয়ারিতে মিউনিখ প্রতিরক্ষা সম্মেলনে তাঁর কুখ্যাত বক্তৃতাটি দেওয়ার সময় এ ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। ওই বক্তৃতায় তিনি ইউরোপীয় নেতাদের কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, জার্মানির ডানপন্থী ‘অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি’ (এএফডি) দল নাকি সেন্সরশিপের শিকার। অথচ তিনি যখন ওই বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, ঠিক সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসন সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে মামলা করছিল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছিল। আসলে ব্যানন ও তাঁর সহযোগীরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূল আদর্শকেই প্রত্যাখ্যান করেন।
মনে রাখা দরকার, ইইউ গড়ে উঠেছে উদার মানসিকতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর। এর লক্ষ্য হলো জাতীয়তাবাদকে অতিক্রম করে ধীরে ধীরে আরও গভীর সংহতির পথে যাওয়া। কিন্তু মাগা আন্দোলন স্পষ্টভাবেই জাতীয়তাবাদী। তারা রাজনৈতিকভাবে যারা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে, তাদের সঙ্গে হাত মেলাতে আগ্রহী। তাই ট্রাম্পের আমলে ট্রান্স-আটলান্টিক সম্পর্ক পুরোপুরি উল্টে গেছে। এটি আর আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নয়; বরং জাতীয়তাবাদের রূপ নিচ্ছে।
হ্যাঁ, স্বীকার করতে হবে, ইউরোপ বহু দশক যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাছাতার নিচে বেশ স্বচ্ছন্দে থেকেছে। কিন্তু এখনকার মার্কিন প্রশাসনের চাপের কাছে তার নত হওয়া উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আমাদের অনেক ঋণ থাকলেও আমাদের নিজেদের প্রতিও দায়িত্ব আছে। যে মূল্যবোধ ও নীতির ওপর আমরা এত দিন চলেছি, তা রক্ষা করা আমাদের জন্য খুবই জরুরি। যুক্তরাষ্ট্র উদার মূল্যবোধ থেকে সরে গিয়ে জনতুষ্টিবাদী জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকেছে বলে আমাদেরও যে একই পথে যেতে হবে, এমন নয়।
* ইয়োশকা ফিশার, ১৯৯৮ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ডেপুটি চ্যান্সেলর ছিলেন।
- স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
![]() |
| মাগা আন্দোলনের প্রধান ভাবাদর্শীদের একজন স্টিভ ব্যানন। ছবি : রয়টার্স |

No comments