‘মামদানি মডেল’ কি নিউইয়র্কের বাইরেও ছড়িয়ে পড়বে by আদিত্য চক্রবর্তী

জোহরান মামদানি বেড়ে উঠেছেন বলা যায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে। ২০১৬ সালে বার্নি স্যান্ডার্সের প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতার প্রচার দেখে তিনি সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছিলেন। ওই বছরটি শেষ পর্যন্ত আমাদের ট্রাম্পের ‘প্রথম সংস্করণ’কে উপহার দিয়েছিল।

গত বছর নভেম্বর মাসে ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পরপরই মামদানি ভোটারদের কাছে যান এই প্রশ্ন নিয়ে—কেন তাঁরা এই লোকটিকে ভোট দিলেন? তাঁদের সঙ্গে সেই কথোপকথনগুলোই তাঁকে নিউইয়র্কের মেয়র হিসেবে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করেছিল। সেই আলাপচারিতার ভিডিওটিও সময়ের রাজনীতিকে বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক দলিল।

আমরা যারা বিল ক্লিনটন আর টনি ব্লেয়ারের রাজনৈতিক কৌশলের বিষয়ে জানি, তারা হয়তো এমন ‘জনতার কথা শোনা’ ধাঁচের অনুষ্ঠানের বিষয়ে সন্দিহান থাকি। কারণ, এ ধরনের অনুষ্ঠানে ক্ষমতার প্রতিনিধি এবং তাঁর সহযোগীরা আলোঝলমলে হলঘরে ‘জনতার পাশে’ থাকার অভিনয় করেন। কিন্তু মামদানির প্রচার একেবারেই তেমন নয়।

মামদানি ব্রঙ্কসের এক রাস্তার মোড়ে হাতে একটি প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন; যেন তিনি এক দৃঢ়বিশ্বাসী ধর্মপ্রচারক। তিনি প্রচলিত রাজনৈতিক বুলি আওড়াননি। তিনি সরাসরি কথা বলেছেন সেই সব মানুষের সঙ্গে যাদের চেহারায় ক্লান্তি, শরীরে নাগরিক শ্রান্তি। তাঁরা আগে কখনো কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতাধর লোকের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলেননি, এমনকি মামদানির মতো ছোট পরিসরের কোনো আইনপ্রণেতার সঙ্গেও নয়।

এই মানুষেরা মামদানিকে মন খুলে বলেছেন, কেমন করে জীবনের প্রতিদিনের চাহিদাগুলো পূরণ করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে; কীভাবে রাজনীতি তঁাদের জীবনকে সংকীর্ণ করে ফেলছে। এই মানুষেরা রাজনীতিকদের ব্যর্থ লোক হিসেবেই দেখেন। জনগণের এই হতাশাই একসময় ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউসে তুলেছিল। এই হতাশার কারণেই মামদানি আজ আমেরিকার বৃহত্তম শহর নিউইয়র্কের মেয়র।

বিশ্লেষকেরা প্রায়ই ট্রাম্প আর মামদানিকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁদের বক্তব্য ‘দুজনেই টিকটকে জনপ্রিয়’ বা ‘দুজনেই পপুলিস্ট’—ধরনের কথায় গিয়ে শেষ হয়। কিন্তু এই তুলনার গভীরে আরও বড় বিষয় আছে। দুজনেই নিউইয়র্কের মানুষ। কিন্তু তাঁরা এই শহরের দুই বিপরীত দিককে তুলে ধরেন। ট্রাম্প তুলে ধরেন ম্যানহাটানের দালানকোঠার ছবি। আর মামদানি হন সাধারণ মানুষের পাড়া-মহল্লার প্রতিনিধি। তাঁদের দুজনকে দেখলে মনে হয়, আমেরিকার দুই ভিন্ন ভবিষ্যৎ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।

ট্রাম্প টেনে নিচ্ছেন দেশকে জাতিগত বিভাজন আর নির্মম অর্থনীতির পথে। আর মামদানি অভিবাসী ও সাধারণ নাগরিকদের পাশে এমন এক শহরের স্বপ্ন নিয়ে দাঁড়াচ্ছেন, যেখানে সবার জন্যই বেঁচে থাকা সম্ভব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মামদানি বুঝতে পেরেছেন, শহরের শ্রমজীবী মানুষ মানে শুধু শ্বেতাঙ্গ নয়; তাঁদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ, বাদামি ও অভিবাসীরাও আছেন।

ট্রাম্পের মতো লোকেরা যে ভয়াবহ বিপদের প্রতীক, তা গভীরভাবে ভাবলেই বোঝা যায়। আর সেটি বোঝা গেলেই বোঝা যায়, কেন মানুষ মামদানির মধ্যে এতটা আশা খুঁজে পেয়েছে। কয়েকটা উদাহরণ দিই—গত সেপ্টেম্বর ট্রাম্পের দেহরক্ষীরা হুন্দাই কারখানা থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েকজন প্রকৌশলীকে ধরে নিয়ে যান। সব কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকার পরও জোর করে তাঁদের দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার পরের মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বৈধ ভিসা নিয়ে ভ্রমণরত এক ব্রিটিশ সাংবাদিককে আইসিই কর্মকর্তারা ধরে নিয়ে যান। কারণ, তিনি ইসরায়েলের নৃশংসতার সমালোচনা করেছিলেন।

মামদানির জনপ্রিয়তার উৎস শুধু তাঁর তারুণ্য, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব নয়। তাঁর প্রতি এই প্রবল আগ্রহের মূল কারণ হলো, তিনিই প্রথম বামপন্থী রাজনীতিক, যিনি দেখিয়েছেন ট্রাম্পবাদের মুখোমুখি দাঁড়ানোই শুধু নয়, সেটিকে পরাজিত করাও সম্ভব। এটাই আমাদের সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ—আর নিউইয়র্কের নতুন মেয়র তা ভালোভাবেই জানেন।

বিজয় ভাষণে তিনি কৃতজ্ঞতা জানানোর পর বলেছিলেন, ‘যদি কেউ ট্রাম্পের বিশ্বাসঘাতকতায় ক্ষতবিক্ষত একটি জাতিকে দেখাতে পারে কীভাবে তাকে পরাজিত করতে হয়, তবে সেই শহরই পারে, যে শহর ট্রাম্পকে তৈরি করেছিল।’

এক বছর ধরে ট্রাম্পের দ্বিতীয় আমলে মধ্যপন্থী ও মধ্য-বাম রাজনীতিকদের সেরা মেধাবীরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। কীভাবে ট্রাম্পকে মোকাবিলা করবেন, তা তাঁরা বুঝে উঠতে পারেননি। ওবামা প্রায় কিছুই বলেননি। কমলা হ্যারিস আত্মজীবনী লেখায় ব্যস্ত ছিলেন।

মামদানিকে সবচেয়ে তীব্র আক্রমণ করেছেন তাঁর নিজের দিকের মানুষেরাই। ডেমোক্র্যাট প্রাইমারিতে হেরে গিয়ে যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িত অ্যান্ড্রু কুমো স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ান এবং এই নির্বাচনে প্রকাশ্যে ট্রাম্পের পছন্দের প্রার্থী হিসেবে প্রচার চালান। এই প্রচারে নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়র হতে চাওয়া মামদানিকে নিয়মিতভাবে ‘সন্ত্রাসবাদে সহানুভূতিশীল’ বলে অপবাদ দেওয়া হয়েছে।

ইউরোপজুড়ে এখন দেখা যাচ্ছে সামাজিক গণতন্ত্রের নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের ‘চরমপন্থার প্রধান’ ট্রাম্পের সামনে মাথা নত করছেন। ব্রিটেনের কিয়ার স্টারমার ট্রাম্পকে অভূতপূর্ব কায়দায় স্বাগত জানিয়েছেন। আর ন্যাটোর প্রধান মার্ক রুতে তাঁকে ‘ড্যাডি’ পর্যন্ত বলেছেন। পাঁচ বছর আগেও মার্কিন গণমাধ্যমের মালিকেরা বৈচিত্র্যের প্রতি প্রতিশ্রুতি দেখাতে হাঁটু গেড়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। এখন তারা হাঁটু গেড়ে বসছে এক বর্ণবাদী গালিবাজের সামনে।

ট্রাম্পবাদের বিরুদ্ধে যখন দুই দিনব্যাপী বিশাল বিক্ষোভে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ অংশ নেয়, তখন মার্কিন কলামিস্ট আর পডকাস্টাররা পরিবেশ বদলের গল্প শুনিয়েছেন। এ অবস্থায় মামদানির জয় প্রমাণ করে জনগণ এখনো প্রতিরোধে আস্থা রাখে।

* আদিত্য চক্রবর্তী, দ্য গার্ডিয়ান-এর কলামিস্ট
- গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

নিউইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি
নিউইয়র্কের নবনির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানি। ফাইল ছবি

No comments

Powered by Blogger.