কেমন ছিল লুভ্যরের চুরির ঘটনা

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অবস্থিত বিশ্ব বিখ্যাত মিউজিয়াম ল্যুভরে ঘটে গেল এক বিস্ময়কর চুরির ঘটনা। দিবালোকে শত শত দর্শনার্থীর উপস্থিতিতে মাস্ক পরা একদল চোর ১০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের রাজকীয় গহনা চুরে করে পালিয়ে গেছে। যা ১৯১১ সালে মোনালিসা চুরির পর এটিই ল্যুভরের সবচেয়ে বড় চুরি। এই ঘটনায় এ পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে এখনও তাদের কাছ থেকে চুরি হওয়া গহনার হদিশ পায়নি তদন্তকারীরা। বলা হচ্ছে ইতিমধ্যেই চুরির গহনা বিক্রির চেষ্টা শুরু হয়ে গেছে।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, ঘটনাটি ঘটেছে ১৯ অক্টোবর সকাল ৯টা ৩৪ মিনিটে। প্যারিসে অবস্থিত ল্যুভর মিউজিয়ামের অ্যাপোলো গ্যালারিতে ঢুকে চোরের একটি দল। মিউজিয়ামের এই গ্যালারিতেই রয়েছে ফ্রান্সের রাজপরিবারের মূল্যবান গয়না। যার মধ্যে নেপোলিয়নের দ্বিতীয় স্ত্রীর জন্য উপহার দেওয়া একটি এমেরাল্ড ও হীরার হারও ছিল।

ফরাসি পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চারজন চোর একটি ট্রাক ও দুইটি মোটরসাইকেলে করে ঘটনাস্থলে আসে। ট্রাকের ওপরে চুরি করা একটি বৈদ্যুতিক মই স্থাপন করে তারা জাদুঘরের দ্বিতীয় তলায় উঠে যায়। চোরেরা নির্মাণশ্রমিক সেজে হলুদ সেফটি ভেস্ট পরে আসে। যেন তাদের দেখে কেউ সন্দেহ করতে না পারে। এরপর তারা বিশেষ ইলেকট্রিক ডিস্ক গ্রাইন্ডার ব্যবহার করে শক্তিশালী কাচ কেটে ঢোকে গ্যালারিতে।

দুইজন চোর সরাসরি লক্ষ্যবস্তুতে এগিয়ে যায়। যেখানে কাচের বাক্সে ছিল নেপোলিয়নের উপহার হিসেবে দেওয়া বিখ্যাত এমেরাল্ড নেকলেস ও রানী মেরি-আমেলির টায়ারা। ল্যুভরের নিরাপত্তা নির্দেশিকাতেই উল্লেখ আছে- আগুন লাগলে এই ধরণের ডিস্ক কাটার দিয়ে কাচ কাটা হয়। চোরেরা সেই কৌশলই ব্যবহার করেছে।
ল্যুভর মিউজিয়ামের পরিচালক লরেন্স দে কার্স ফরাসি সিনেটকে জানিয়েছেন, জাদুঘরের বাইরের নিরাপত্তা ক্যামেরাগুলোর অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল ও পুরোনো। যেখানে চোরের দল প্রবেশ করেছিল, সেখানে কেবল একটি ক্যামেরা ছিল। কিন্তু সেটির দৃষ্টি ছিল পাশের দিকে, ফলে চোরদের মই বেয়ে ওঠার দৃশ্য ধরা পড়েনি। পুলিশের তরফেও স্বীকার করা হয়েছে যে তাদের নিজস্ব রাস্তার ক্যামেরায় চোরদের ট্রাক ধরা পড়লেও কেউ বিষয়টি খেয়াল করেনি।

চোরদের ঢুকতে সময় লাগে মাত্র চার মিনিট, কিন্তু পুলিশের হাতে খবর পৌঁছায় যখন তারা কাচ কেটে গয়না বের করতে শুরু করেছে। ঘটনাস্থলে পুলিশের পৌঁছাতে সময় লাগে তিন মিনিট। কিন্তু ততক্ষণে চোরেরা পালিয়ে যায়। চোরেরা পালানোর সময় তাড়াহুড়ো করে প্রচুর প্রমাণ রেখে যায়। ঘটনাস্থলেই পাওয়া যায় গ্লাভস, মোটরসাইকেল হেলমেট, ব্লোটর্চ, হলুদ ভেস্ট, এমনকি একজোড়া গয়না ও সম্রাজ্ঞী ইউজেনির মুকুটও।

পুলিশ জানিয়েছে, ফেলে যাওয়া জিনিস থেকে সংগৃহীত ১৫০টির বেশি ফরেনসিক নমুনা সংগ্রহ করেছে তারা। যার মধ্যে ডিএনএ ও আঙুলের ছাপও রয়েছে। এ কারণেই দ্রুত দুই অভিযুক্তকে পাকরাও করতে পেরেছে পুলিশ। গত শনিবার রাতে চার্ল দ্য গোল বিমানবন্দর থেকে এক সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন তিনি একমুখী টিকিট নিয়ে আলজেরিয়া পালাতে চাচ্ছিলেন। ৪০ মিনিট পর তার সহযোগীকেও ধরা হয়। তবে আরও দুইজন এখনো পলাতক। গত বুধবার রাতে প্যারিস থেকে আরও পাঁচ সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়েছে। যাদেরকে এখন জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দেয়া হয়নি।

পুলিশ আশঙ্কা করছে, চুরি হওয়া গয়নাগুলো ইতিমধ্যেই টুকরো করে রত্ন আলাদা করা বা ধাতু গলিয়ে বিক্রির চেষ্টা চলছে। এখনো কোনো সম্পদ উদ্ধার করা যায়নি। ল্যুভরের অলঙ্কার বিভাগীয় পরিচালক অলিভিয়ে গাবে বলেন, রাতের বেলায় আমি যখন গ্যালারিতে ঢুকেছিলাম, চারদিকে এক ভয়ানক নীরবতা। কাচের বাক্সগুলো ফাঁকা পড়ে ছিল। যেন ইতিহাসের এক অংশ হারিয়ে গেছে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানাপোলিসের শিক্ষক হোলি বার্কার বলেন, আমি নেপোলিয়নের সেই হারটির ছবি তুলেছিলাম। মুহূর্তের মধ্যেই গর্জন শুনে আমরা দৌড়ে বেরিয়ে আসি। এখন ভাবলে মনে হয়, আমি হয়তো সেই হারটি শেষবার দেখেছিলাম।

মিউজিয়ামের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ: ল্যুভরের ক্ষেত্রে মারাত্মক ভুলটি ছিল নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতা। বিশেষ করে দেয়ালের বাইরের ক্যামেরায়। গত সপ্তাহে ফরাসি সিনেটে এমনটাই স্বীকার করেছেন জাদুঘরের পরিচালক লরঁস দে কার। তিনি শুনানিতে বলেন, বাইরের ক্যামেরাগুলো খুব পুরোনো, আর এত কম যে পুরো এলাকা কাভার করে না। সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদক জাদুঘরে গিয়ে দেখেছেন, বাইরের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ২৫টি ক্যামেরা আছে। এগুলোর মধ্যে মাত্র পাঁচটি বাইরের দেয়ালে, বাকিগুলো ভেতরের প্রাঙ্গণে। সেই তুলনায় আকারে অনেক ছোট বৃটিশ মিউজিয়াম বলছে, তাদের বাইরে কয়েক ডজন ক্যামেরা রয়েছে।

বাইরের এত কম ক্যামেরা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ল্যুভর কর্তৃপক্ষ মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়। জাদুঘরের পরিচালক বলছিলেন, সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, চোরের দল যে স্থানে লক্ষ্য করেছিল, সেই প্রান্তে বাইরে মাত্র একটি ক্যামেরা ছিল। সেটিও আবার ব্যালকনির পশ্চিম দিকে তাক করা ছিল। ফলে চোরের দলের কর্মকাণ্ড বা জানালা ভাঙচুরের দৃশ্য ধরা পড়েনি। ক্যামেরাটি অন্যভাবে বসানো থাকলে জাদুঘরের কন্ট্রোল রুমে থাকা নিরাপত্তারক্ষীরা দেখতে পারতেন, কীভাবে চোরের দল বৈদ্যুতিক মই বেয়ে ব্যালকনিতে উঠছে। চোরের দলের জানালা কাটতে যে কয়েক মিনিট লেগেছিল, তাতে আগে থেকে প্রহরীরা জানলে চুরি ঠেকানোর প্রস্তুতি নিতে পারতেন। কিন্তু সেই সময়ে প্রহরীরা কার্যত অন্ধকারে ছিলেন। ফলে পুলিশকে খবর দিতে তাদের দেরি হয়।

গত বুধবার সিনেটে সাক্ষ্যে এক পুলিশ কর্মকর্তা স্বীকার করেন, জাদুঘরের বাইরের প্রান্ত পাহারায় তাদেরও দায়িত্ব ছিল। তারাও গাফিলতি করেছে। প্যারিস পুলিশের ক্রাইম প্রিভেনশন সার্ভিসের প্রধান ভিনসাঁ আনরো বলেন, ল্যুভরের চারপাশে পুলিশের সাতটি স্ট্রিট ক্যামেরা আছে। একটি ক্যামেরায় চোরের দলের উপস্থিতি ধরা পড়েছিল। তবে কেউ সেটি খেয়াল করেনি বা সন্দেহ করেনি। জাদুঘর থেকে চুরির অ্যালার্ট আসার পর সবার হুঁশ হয়। এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, প্যারিসে নির্মাণকাজ নিত্যদিনের বিষয়। ক্যামেরা মনিটরিংয়ে পুলিশের কাছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নেই। জাদুঘরের পরিচালকসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার দেওয়া সময়সূচি মিলিয়ে মনে হচ্ছে, এক মিনিটের কম সময়ের ব্যবধানে চোরের দল পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে। প্যারিসের পুলিশপ্রধান বলেন, জাদুঘরকর্মীদের ফোন ও এক সাইকেল আরোহীর খবর পাওয়ামাত্র তিন মিনিটের মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিল; কিন্তু তাদের খবর দেওয়া হয়েছিল তখন, যখন চোরের দল প্রদর্শন বক্সের কাচ কাটাকাটি শুরু করে দিয়েছে। তিন মিনিটের কম সময়ের মধ্যে চোরের দল আটটি মূল্যবান জিনিস নিয়ে ছিটকে পড়ে।

https://mzamin.com/uploads/news/main/187391_Kaium-9.webp

No comments

Powered by Blogger.