মানবতাবিরোধী অপরাধে হাসিনার দণ্ড, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নতুন পরীক্ষা
২০২৪ সালের আন্দোলনে তিনি দেশ ছাড়েন। অন্তর্বর্তী সরকারে আসেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের কূটনৈতিক সঙ্কট চলছে। হাসিনাকে ফেরত চাইছে ঢাকা। তবে দিল্লি তাতে রাজি নয়। ফলে হাসিনাকে দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বাস্তবায়ন করা কার্যত অসম্ভব।
ভারত যেটিকে মানবিক আশ্রয় ভেবেছিল সেটি এখন কঠিন পরীক্ষায় পরিণত হয়েছে। পুরনো মিত্রের জন্য ভারত কতদূর যাবে এবং কতটা কূটনৈতিক মূলধন খরচ করবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পর্যবেক্ষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ভারতের সামনে চারটি অপ্রত্যাশিত বিকল্প রয়েছে। তারা হাসিনাকে ফেরত দিতে পারে। অথবা বর্তমান অবস্থায় থাকা, তবে সামনে নির্বাচিত সরকার এলে ভারতের জন্য এটা ঝুঁকি তৈরি করবে। আরেকটি দিক হলো- হাসিনাকে চুপ থাকতে বলা। যদিও তিনি এটা মানবেন না। আবার দিল্লিও এ বিষয়ে জোর করবে না। সর্বশেষ বিকল্প হচ্ছে- হাসিনাকে তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানো। তবে এখানে আইনগত ঝামেলা ও নিরাপত্তার বিষয়টি আছে। এক্ষেত্রে খুব কম দেশই এমন একজনকে গ্রহণ করতে রাজি হবে।
হাসিনার প্রত্যর্পণ ভারতীয় রাজনীতিতে অকল্পনীয়। ক্ষমতাসীন অথবা বিরোধী পক্ষই তাকে বন্ধু মনে করে। ভারত গর্ব করে যে তারা বন্ধুদের বিপক্ষে যায় না। দুই দেশের সম্পর্কের গভীরতা ও অসমতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। কারণ এই সম্পর্কের জন্ম ভারতের ভূমিকার মধ্যেই।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ভারতও বাংলাদেশের বড় রপ্তানি বাজার। বার্ষিক বাণিজ্য প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ বড় বাণিজ্য ঘাটতিতে থাকে এবং ভারতীয় কাঁচামাল, জ্বালানি ও ট্রানজিটের ওপর নির্ভরশীল। ভারত গত এক দশকে ৮–১০ বিলিয়ন ডলারের স্বল্পসুদের ঋণ দিয়েছে। রেল সংযোগ, বিদ্যুৎ, তেল ও এলএনজি সরবরাহ করেছে। এমন সম্পর্ক কোনো পক্ষই সহজে ছাড়তে পারবে না।
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় ভারতদ্বাজ বলেন, দুই দেশ পানি, বিদ্যুৎসহ বহু ক্ষেত্রে পরস্পরনির্ভরশীল। ভারতের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে চলা কঠিন। অনেকে মনে করেন, ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার এখন দ্রুত তাদের পররাষ্ট্রনীতি পুনর্গঠন করছে।
সিঙ্গাপুরের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, সরকারের প্রথম দিকের কূটনৈতিক পদক্ষেপ ছিল ‘ডি-ইন্ডিয়ানাইজেশন’। আগে যে সরকার ভারতকে সব ফোরামে অগ্রাধিকার দিত। সেক্ষেত্রে এখন তারা বিচার বিভাগীয় আদান–প্রদান বাতিল করছে, ভারতীয় জ্বালানি চুক্তি পুনর্বিবেচনা করছে, সংযোগ প্রকল্প ধীর করছে। পাশাপাশি চীন, পাকিস্তান ও তুরস্কের দিকে ঝুঁকছে।
বার্তাটি স্পষ্ট। বাংলাদেশ এখন কৌশলগতভাবে ভিন্ন দিকে সরে যাচ্ছে। জনমতেও এই পরিবর্তন ধরা পড়েছে। ঢাকার একটি জরিপ বলছে—৭৫ শতাংশ মানুষ চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে ইতিবাচকভাবে দেখে। যা ভারতের ক্ষেত্রে মাত্র ১১ শতাংশ। অনেকে মনে করেন, দিল্লি হাসিনার শেষ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনকে সমর্থন করেছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজনৈতিক সম্পর্ক বদলালেও বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া–সম্পর্ক সাধারণত স্থিতিশীল থাকে। বিএনপি–জামায়াত সরকারের সময়েও দুই দেশের বাণিজ্য বেড়েছিল। ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ শুধু নির্বাসিত এক মিত্রকে সামলানো নয়, বরং এমন এক প্রতিবেশীকে ধরে রাখা যা তাদের নিরাপত্তার কেন্দ্র। বিশেষ করে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ এবং উত্তর–পূর্বাঞ্চলে প্রবেশাধিকারের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত ৪০৯৬ কিলোমিটার। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশ অস্থির হলে বাস্তুচ্যুতি বা চরমপন্থা বাড়তে পারে। লন্ডনের এসওএএসের অধ্যাপক অবিনাশ পালিওয়াল বলেন, ভারতকে এখন তাড়াহুড়ো করা যাবে না। ঢাকার সকল রাজনৈতিক পক্ষ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে নীরব ও ধৈর্যশীল কূটনীতি প্রয়োজন। তিনি মনে করেন, আগামী ১২–১৮ মাস সম্পর্ক অস্থির থাকবে। নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতিই নির্ধারণ করবে সম্পর্কের গতি কোন পথে। যদি অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে পারে এবং নতুন সরকার আসে তবে সম্পর্ক পুনরায় গড়ার সুযোগ তৈরি হবে।
দিল্লি এখন শুধু তাৎক্ষণিক কৌশল নয় বরং বড় নীতি নিয়ে ভাবছে। কীভাবে মিত্রদের আশ্বস্ত করবে যে ভারত পাশে থাকবে কিন্তু মানবাধিকার বিতর্কে জড়াবে না। পালিওয়াল বলেন, এ সমস্যার সহজ সমাধান নেই। মূল প্রশ্ন হলো ভারত কেন এমন পরিস্থিতিতে পড়ল? দিল্লি কি হাসিনার ওপর অতিরিক্ত নির্ভর হয়ে ভুল করেছে?
বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ক্ষমতায় যারা থাকে, যারা বন্ধুসুলভ, তাদের সঙ্গেই কাজ করা হয়। পররাষ্ট্রনীতি জনমত বা নৈতিকতায় চলে না। ভারতের পক্ষেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ভারত এই রাজনৈতিক ফাটল মেরামত করতে পারবে কি না তা অনিশ্চিত। অনেক কিছু নির্ভর করছে বাংলাদেশের পরবর্তী সরকারের ওপর। নতুন সরকার হাসিনা ইস্যুকে কতটা প্রভাব ফেলতে দেবে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। যদি সম্পর্ক জিম্মি হয় অগ্রগতি কঠিন হবে।

No comments