ডেমোক্র্যাটদের ক্ষমতায় ফেরা কি সহজ হবে

যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা ও নেতৃত্ব হারানোর এক বছর পর ডেমোক্রেটিক পার্টি এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। মাসের পর মাস আত্মসমালোচনার পর গত সপ্তাহে তিন বড় নির্বাচনে জয় ডেমোক্র্যাটদের নতুন করে রাজনৈতিক লড়াইয়ে অতি প্রয়োজনীয় গতি এনে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শহর নিউইয়র্কে ৩৪ বছর বয়সী এক ডেমোক্র্যাট সমাজতান্ত্রিক প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। অন্যদিকে ভার্জিনিয়ায় সাবেক একজন সিআইএ কর্মকর্তা প্রথম নারী গভর্নর হয়েছেন।

আবার নিউ জার্সিতে গভর্নর পদে নৌবাহিনীর সাবেক এক হেলিকপ্টার পাইলট প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প-সমর্থিত রিপাবলিকান প্রার্থীকে পরাজিত করে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছেন।

ডেমোক্রেটিক পার্টির জয়ী এ তিনজন হলেন নিউইয়র্ক শহরে জোহরান মামদানি, ভার্জিনিয়ায় অ্যাবিগেইল স্প্যানবার্গার ও নিউ জার্সিতে মিকি শেরিল।

তিন প্রার্থীর এ জয় ডেমোক্র্যাটদের ভবিষ্যৎ পথনির্দেশ নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে—২০২৬ সালের গুরুত্বপূর্ণ মধ্যবর্তী নির্বাচনে ও নির্বাচনের পরে দলের নেতৃত্ব কারা নেবেন—মধ্যপন্থি নাকি বামপন্থিরা? প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও ২০২৮ সালের ভোটের আগে কোনো নির্দিষ্ট নেতৃত্ব না থাকায় ডেমোক্র্যাটরা এখন ভাবছেন, কীভাবে তারা একটি স্পষ্ট বার্তা দেবেন, নিজেদের ভাবমূর্তি পুনর্গঠন করবেন ও ভোটারদের ফিরিয়ে আনার নতুন কৌশল তৈরি করবেন।

কেউ কেউ মনে করেন, জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয়সংকট মোকাবিলায় মনোযোগ বাড়িয়ে ডেমোক্র্যাটরা এ লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন। অন্যরা বলেন, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আরও জোরালো রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়া হবে জরুরি।

জাপানে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও শিকাগোর সাবেক মেয়র রাহম ইমানুয়েল বিবিসিকে বলেন, ‘এটা (ডেমোক্রেটিক পার্টির তিন প্রার্থীর বিজয়) ট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের বিরুদ্ধে জনরায়ের প্রতিফলন, আমাদের প্রতি সমর্থনের নয়।’

ইমানুয়েল আরও বলেন, ডেমোক্র্যাটদের জন্য প্রথম শিক্ষা ছিল, তারা নিজেদের ভুলে হোঁচট খাননি। তারা জনগণের বাস্তব উদ্বেগ নিয়ে কথা বলেছেন। এমন কোনো সাংস্কৃতিক বিতর্কে জড়াননি যেখানে জেতা অসম্ভব।

ডেমোক্র্যাটরা এ নির্বাচনের আগে বছরজুড়ে ছিলেন দিশাহারা। গত বছরের নভেম্বরে তারা শুধু হোয়াইট হাউসই হারাননি; কংগ্রেসের দুই কক্ষ, সব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্য এবং শ্রমজীবী, সংখ্যালঘু ও তরুণ ভোটারদের একাংশের সমর্থনও হারিয়েছেন।

নিউইয়র্ক টাইমসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ডেমোক্র্যাটদের ৪৫ লাখ নিবন্ধিত ভোটার রিপাবলিকান পার্টিতে যোগ দিয়েছেন।

যদিও ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা এখনো ৪০ শতাংশের নিচে, ডেমোক্র্যাটদের জনপ্রিয়তাও এ গ্রীষ্মে গত ৩৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে গেছে।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের জুলাইয়ের এক জরিপে দেখা গেছে, ৬৩ শতাংশ ভোটার ডেমোক্রেটিক পার্টি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। ১৯৯০ সালের পর এটি সর্বোচ্চ।

তবে চলতি বছরের ভোটগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, জনগণের অর্থনৈতিক কষ্টের বিষয়ে নিজেদের বার্তা স্পষ্ট করায় ডেমোক্র্যাটদের জন্য পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে।

ডেমোক্র্যাটরা এ নির্বাচনের আগে বছরজুড়ে ছিলেন দিশাহারা। গত বছরের নভেম্বরে তারা শুধু হোয়াইট হাউসই হারাননি; কংগ্রেসের দুই কক্ষ, সব গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্য এবং শ্রমজীবী, সংখ্যালঘু ও তরুণ ভোটারদের একাংশের সমর্থনও হারিয়েছেন।

ডেমোক্রেটিক পার্টির কর্মকর্তা ও কৌশলবিদরা বলছেন, দলটির প্রার্থীদের ভাবাদর্শ ভিন্ন হলেও নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি ও ভার্জিনিয়ায় প্রচারের মূল বিষয় ছিল জীবনযাত্রার ব্যয় কমানো। এ বিষয়ে সবাই বিশেষভাবে মনোযোগ দিয়েছেন।

জোহরান মামদানি চালিয়েছেন এক বামপন্থি জনমুখী প্রচার; যেখানে মূল প্রতিশ্রুতি ছিল বাড়িভাড়া স্থিতিশীল রাখা, বিনা ভাড়ায় বাসযাত্রা ও সর্বজনীন শিশুযত্ন। এসবের অর্থায়ন হবে ধনীদের ওপর নতুন কর বসিয়ে।

মিকি শেরিল মনোযোগ দিয়েছেন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মতো খাতে খরচ কমানোর বিষয়ে। অন্যদিকে স্প্যানবার্গার তুলে ধরেছেন কীভাবে ট্রাম্প প্রশাসনের বাজেট কাটছাঁট ভার্জিনিয়ার হাজারো সরকারি কর্মীর জীবনে বিশৃঙ্খলা বয়ে এনেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষক সাইমন বাজেলন ২০২৪ সালে ডেমোক্র্যাটদের পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘ভোটাররা চান, তাদের নির্বাচিত নেতারা জীবনযাত্রার ব্যয়সংকট সমাধানে সময় ও শক্তি ব্যয় করুন।’

পাঁচ লাখের বেশি ভোটারের মতামত বিশ্লেষণ করে বাজেলন দেখেছেন, ডেমোক্র্যাটরা গণতন্ত্র, গর্ভপাত ও সাংস্কৃতিক ইস্যুতে খুব বেশি মনোযোগ দিয়েছিলেন। অথচ জনগণ চেয়েছেন জীবনযাত্রার খরচ, সীমান্তনিরাপত্তা ও জননিরাপত্তা নিয়ে কথা শুনতে।

বাজেলন আরও বলেন, ডেমোক্রেটিক পার্টির সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি বুঝতে দেরি করেছে। ভোটারদের বলা হয়েছে, ‘অর্থনীতি ভালো চলছে’, কিন্তু বাস্তবে মানুষ প্রতিদিনের খরচে কষ্ট পাচ্ছিলেন। ‘বাইডেনোমিকস’-এর প্রচারণা ফল দেয়নি, অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের কথাও মানুষকে বিশ্বাস করাতে পারেনি। অন্যদিকে জীবনযাপনের ব্যয় বেড়েই গেছে, জনগণও তা মনে রেখেছেন।

আগামী বছরের মধ্যবর্তী নির্বাচন ট্রাম্পের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, সাধারণত এ সময়ের ভোট ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তার ওপর জনরায় হিসেবে দেখা হয়। ট্রাম্প দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হলেও মুদ্রাস্ফীতি এখনো হোয়াইট হাউসের মাথাব্যথা।

বাজেলনের মতে, ‘জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা বন্ধ করতে হবে যে তাদের ভাবনা ভুল। গণতন্ত্রে জনমতকেই গুরুত্ব দিতে হবে। নইলে আমরা এমন লোকদের কাছে হারব, যারা গণতন্ত্রকেই গুরুত্ব দেন না।’

মঙ্গলবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের বিজয়ের পর রিপাবলিকানরা, এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও দৃশ্যত স্বীকার করেছেন, অর্থনৈতিক বার্তা নিয়ে লড়াইয়ে তারা পিছিয়ে পড়েছেন। নির্বাচনের পরদিন বুধবার ভোরে ট্রাম্প রিপাবলিকান সিনেটরদের হোয়াইট হাউসে ডেকে ইতিহাসের দীর্ঘ সময় ধরে চলমান সরকারি অচলাবস্থার (শাটডাউন) সমাধান বিষয়ে বৈঠক করেছেন।

হোয়াইট হাউসের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ও ট্রাম্পের সাবেক রাজনৈতিক পরিচালক জেমস ব্লেয়ার বুধবার পলিটিকোকে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট পুরো পরিস্থিতি খুব কাছ থেকে দেখছেন। তিনি জানেন যে অর্থনীতিকে ভালো করতে সময় লাগে। কিন্তু সব মূল বিষয় ঠিক আছে।’

ডেমোক্র্যাটরা বলছেন, ২০২৬ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে তাদের মূল ইস্যু হবে ট্রাম্পের অর্থনীতি। তাদের আশা, অন্তত কংগ্রেসের একটি কক্ষ তারা পুনরুদ্ধার করতে পারবেন। রিপাবলিকান পার্টির নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ট্রাম্পকে নির্বিঘ্নে তার নীতিমালা বাস্তবায়নে সাহায্য করছে এবং নির্বাহী ক্ষমতার সম্প্রসারণেও বাধা দিচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের আরোপিত বৈশ্বিক শুল্কের চাপ আসলে পড়ছে মার্কিন আমদানিকারকদের ওপরে, যা মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়িয়েছে। অন্যদিকে, শাটডাউনের কারণে সরকারি নানা কর্মসূচি বন্ধ থাকায় লাখো মার্কিন নাগরিক খাদ্যসহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অথচ স্বাস্থ্য বীমার প্রিমিয়াম বাড়ছে।

ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটির উপনির্বাহী পরিচালক লিবি স্নাইডার বলেন, ‘লোকজন একসঙ্গে অনেক অর্থনৈতিক আঘাত পাচ্ছেন। এটা একক কোনো সংকট নয়; বরং একাধিক সমস্যার চাপ একত্রে পড়ছে।’

তবে স্থানীয় পর্যায়ে অর্থনীতিকে তুলে ধরাই সব সময় যথেষ্ট নয়। কারণ, ডেমোক্রেটিক পার্টি এখন বড় পরিসরে বামপন্থি ও মধ্যপন্থি—এ দুই দিকই আঁকড়ে আছে। কিন্তু ২০২৮ সালের নির্বাচনে নেতৃত্ব বাছাইয়ের সময় তাদের এক দিক বেছে নিতেই হবে।

রিপাবলিকান কৌশলবিদ ম্যাট গোরম্যান বলেন, এই দিক (ডেমোক্র্যাটদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পথ বা কৌশল) নির্ভর করবে আগামী বছরের প্রাইমারি নির্বাচন ও ২০২৮ সালের নির্বাচনের প্রস্তুতির ওপর। তার মতে, ডেমোক্র্যাটদের অর্থ ও শক্তি এখন বামপন্থি ঘরানার দিকে ঝুঁকেছে।

রিপাবলিকানদের উচিত হবে জীবনযাত্রার খরচ কমানোর বার্তাকে কেন্দ্র করে সেই ভোটারদের টানার চেষ্টা করা; যাদের কাছে ট্রাম্প জনপ্রিয় ছিলেন।

রিপাবলিকানরা এরই মধ্যে জোহরান মামদানির জয়কে কাজে লাগিয়ে বলছে, ডেমোক্রেটিক পার্টি এখন সোভিয়েতধারার কমিউনিস্টদের দখলে চলে যাচ্ছে। বুধবার ফ্লোরিডার এক ব্যবসায়ী ফোরামে ট্রাম্প বলেছেন, দুই দলের পার্থক্য এখন ‘কমিউনিজম বনাম সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি’র মধ্যে সীমিত।

মধ্যপন্থি চিন্তাধারার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘থার্ড ওয়ে’-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ম্যাট বেনেট বলেন, ডেমোক্র্যাটদের ভেতরেও এখন বিতর্ক শুরু হয়েছে, ট্রাম্প ও দক্ষিণপন্থি জনতুষ্টিবাদীদের মোকাবিলা কি বামপন্থি জনতুষ্টিবাদ দিয়েই করা উচিত?

এদিকে অনেক ডেমোক্র্যাটই জোহরান মামদানির মতো নতুন প্রজন্মের প্রার্থীদের আগমনকে স্বাগত জানাচ্ছেন। তবে তাদের মতে, শুধু তরুণ মুখই সমাধান নয়। ২০২৪ সালের অশান্ত প্রচারের পর ভোটারদের আস্থা ফিরে পাওয়াই এখন মূল কাজ।

রান ফর সামথিং নামের সংগঠনের সহপ্রতিষ্ঠাতা অ্যামান্ডা লিটম্যান বলেন, ‘মানুষ এখন আমাদের বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে, আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি রাখব না।’ নতুন ডেমোক্র্যাটদের রাজনীতিতে আসার জন্য প্রস্তুত বা প্রার্থী হতে উৎসাহিত করে থাকে সংগঠনটি।

যেসব এলাকায় ডেমোক্র্যাটরা ভোট হারিয়েছেন, সংগঠনটি এরই মধ্যে পাঁচ কোটি ডলারের কর্মসূচি নিয়েছে সেসব জায়গায় দলটির প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে।

লিটম্যান বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো, নতুন মুখ যুক্ত করে দলের ভাবমূর্তি পুনর্গঠন করা।’

সেই নতুন মুখটা বামপন্থি হবে, নাকি মধ্যবামপন্থি ঘরানার? এটাই এখন বড় প্রশ্ন। 

ডেমোক্র্যাটদের ক্ষমতায় ফেরা কি সহজ হবে

No comments

Powered by Blogger.