ট্রাম্পের গাজা পরিকল্পনার ব্যাখ্যা ও দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান by জেরেমি বোয়েন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের গাজা যুদ্ধ শেষ করা ও ধ্বংসস্তূপে পরিণত ভূখণ্ড পুনর্গঠনের জন্য প্রস্তাবিত কাঠামোগত চুক্তির পেছনে গতি তৈরি হয়েছে। এই গতি অনেকটাই এসেছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নিজের কাছ থেকে। আরব ও ইসলামিক শীর্ষ দেশগুলিও এই পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছে। এর মধ্যে আছে জর্ডান, মিশর, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্ক। এমনকি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে এটিকে মেনে নেয়- যদিও এর ভেতরে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথের কথা বলা হয়েছে, যা তিনি বারবার নাকচ করে এসেছেন। গতি ধরে রাখতে ট্রাম্প বলছেন, হামাসের কাছে ‘তিন থেকে চার দিন’ সময় আছে হ্যাঁ বা না বলার জন্য। যদি উত্তর না হয়, যুদ্ধ চলতে থাকবে। প্রস্তাবিত এই চুক্তি অনেকটা সেই পরিকল্পনার মতোই, যা জো বাইডেন দেড় বছর আগে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে বিশাল সংখ্যক ফিলিস্তিনি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন, গাজা আরও ধ্বংস হয়েছে, দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে, আর গাজায় বন্দি ইসরাইলি জিম্মিরা আরও দীর্ঘ যন্ত্রণা সহ্য করেছে।

ইসরাইলি গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে রিপোর্ট হয় যে, বাইডেনের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়, কারণ নেতানিয়াহু তার কট্টর ডানপন্থি মন্ত্রিসভার চাপের মুখে নতুন কিছু দাবি তুলে লক্ষ্যপোস্ট সরিয়ে দেন। তবুও, এই কাঠামোগত পরিকল্পনা একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। প্রথমবারের মতো ডনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইলের ওপর যুদ্ধ শেষ করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। ট্রাম্প নিজেকে এমন এক নেতা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন, যাকে না বলা কঠিন। কেউই চাইবে না ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে ভলোদিমির জেলেনস্কি যে কঠিন অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছিলেন, সেটির মতো পরিস্থিতিতে পড়তে। তবে নেতারা হোয়াইট হাউস ছাড়লে পরিস্থিতি বদলে যায়।

ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ইসরাইল ফেরার আগে নেতানিয়াহুর কর্মীরা তাকে নিয়ে একটি ভিডিও ধারণ করেন, যেখানে তিনি নিজের সংস্করণ তুলে ধরেন। সেখানে একটি বিষয় ছিল- ইসরাইলের পাশে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন, অর্থাৎ দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান, যেটিকে বৃটেন ও আরও কিছু পশ্চিমা দেশ সম্প্রতি ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়ে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে।
ট্রাম্পের দলিলটি ফিলিস্তিনি স্বাধীনতার ধারণাকে এক ধরনের অস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। তাতে বলা হয়েছে, রামাল্লাভিত্তিক ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সংস্কারের পর, যেটি মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে, তখনই ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে একটি বিশ্বাসযোগ্য সুযোগ তৈরি হতে পারে, যেটিকে আমরা ফিলিস্তিনি জনগণের আকাঙ্ক্ষা হিসেবে স্বীকৃতি দিই।
তবে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের দূরবর্তী সম্ভাবনার সামান্য ইঙ্গিতও নেতানিয়াহুর জন্য সহনীয় ছিল না। যদিও তিনি হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পকে পুরো সমর্থন দিয়ে ইংরেজিতে বলেন, আমি গাজা যুদ্ধ শেষ করার জন্য আপনার পরিকল্পনাকে সমর্থন করি, যা আমাদের যুদ্ধের লক্ষ্য পূরণ করে।

কিন্তু ভিডিওতে, হিব্রু ভাষায় নিজ দেশের জনগণকে বার্তা দিতে গিয়ে নেতানিয়াহুকে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি কি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রে সম্মত হয়েছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, না, একেবারেই না। এটা কোনোভাবেই চুক্তিতে লেখা নেই। তবে আমরা একটাই বলেছি- আমরা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে জোরপূর্বক প্রতিহত করব। তিনি বলেন, ট্রাম্পও এতে সম্মত হয়েছেন।
পরিকল্পনার শক্তি হলো এর গতি। দুর্বলতা হলো এর অভাব, যা ট্রাম্পীয় কূটনীতির বৈশিষ্ট্য। ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু যে দলিলে সই করেছেন, যেটিকে বৃটেনসহ আরও কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ সমর্থন করেছে, তাতে ইসরাইলি সেনাদের ধাপে ধাপে পিছিয়ে যাওয়ার একটি সাধারণ মানচিত্র আছে। কিন্তু সেসব সূক্ষ্ম দিক নেই যা নির্ধারণ করে একটি যুদ্ধ শেষ করার কূটনৈতিক চুক্তি টিকে থাকবে নাকি ভেঙে যাবে। এটি কার্যকর করতে হলে কঠিন আলোচনার প্রয়োজন হবে। সেই প্রক্রিয়ায় বারবার ভেঙে পড়ার সুযোগও থাকবে।

ইসরাইলের মূলধারার বিরোধী দলগুলো পরিকল্পনাটিকে সমর্থন করেছে। কিন্তু নেতানিয়াহুর জোটের চরমপন্থি জাতীয়তাবাদীরা এটি নাকচ করেছে। তারা বছরের শুরুতে যে ‘ট্রাম্প রিভিয়েরা’ পরিকল্পনা নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিল, সেটির ভিডিও প্রচারণায় ইসরাইল ও মার্কিন নেতাদের সমুদ্রসৈকতে ককটেল হাতে দেখানো হয়েছিল। সেখানে গাজার জায়গায় ঝকঝকে কাঁচের টাওয়ারসহ নতুন শহরের কল্পচিত্র আঁকা হয়েছিল। ইসরাইলি কট্টর ডানপন্থীরা আনন্দিত ছিল। কারণ ওই পরিকল্পনায় গাজার দুই মিলিয়নেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে উৎখাত করে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপনের কথা বলা হয়েছিল। নতুন পরিকল্পনা বলছে কোনো ফিলিস্তিনিকে উচ্ছেদ করা হবে না। চরম উগ্রপন্থী অর্থমন্ত্রী ও বসতি স্থাপনপন্থী নেতা বেজালেল স্মোটরিচ এটিকে ১৯৩৮ সালের মিউনিখ চুক্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন। তখন বৃটেন ও ফ্রান্স চেকোস্লোভাকিয়াকে নাৎসি জার্মানির কাছে ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে বাধ্য করেছিল এবং অল্প কিছুদিন পরই দেশটি স্বাধীনতা হারায়।
যদি হামাস চুক্তি মেনে নেয়, আর যদি নেতানিয়াহু তার জোটের ক্ষমতাশালী চরমপন্থীদের তুষ্ট করার উপায় খোঁজেন, তবে তার হাতে প্রচুর সুযোগ থাকবে আলোচনাকে এমনভাবে ভেঙে দেওয়ার, যাতে দোষ চাপানো যায় হামাসের ওপর। ট্রাম্প কাঠামোগত চুক্তির গঠন এমন যে ইসরাইল যেসব পদক্ষেপ পছন্দ করে না সেগুলো ভেটো করার বহু সুযোগ পায়।

এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলা গভীর সংঘাতের অবসান হয়তো সম্ভব নাও হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে বৃটেনসহ ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের বহু দেশ মনে করে, ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা ছাড়া কোনো সমাধান শান্তি বয়ে আনবে না। আরব ও ইসলামিক দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা তাদের সমর্থন জানাতে যে বিবৃতি দেন, তাতে বলা হয়, তারা বিশ্বাস করেন এই প্রক্রিয়া ইসরাইলি সেনাদের পূর্ণ প্রত্যাহার ও গাজা পুনর্গঠনের দিকে নিয়ে যাবে এবং ন্যায়সঙ্গত শান্তির পথ তৈরি করবে, যা দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ভিত্তিতে গাজাকে সম্পূর্ণভাবে পশ্চিম তীরের সঙ্গে একীভূত করে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এটি আন্তর্জাতিক আদালতের সেই সিদ্ধান্তের প্রতি এক ধরনের গোপন ইঙ্গিত হিসেবে ধরা যেতে পারে, যেখানে ফিলিস্তিনি ভূমি দখলকে ইসরাইলের জন্য অবৈধ বলা হয়েছে।

নেতানিয়াহু বিশ্বাস করেন এই চুক্তি তাকে হামাসের ওপর ইসরাইলের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা বিজয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি জর্ডান নদী থেকে সমুদ্র পর্যন্ত জমির ওপর কোনো ফিলিস্তিনি অধিকার অস্বীকার করেন। একটি পরিকল্পনা- কিন্তু এর অর্থ নিয়ে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাখ্যা। কাঠামোটি এতটাই অস্পষ্ট যে উভয় ব্যাখ্যাই সম্ভব। এটি কোনো আশাব্যঞ্জক সূচনা নয়।
(অনলাইন বিবিসি থেকে অনুবাদ)

mzamin

No comments

Powered by Blogger.