গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ -জিও নিউজের নিবন্ধ by দিলাওয়ার হুসেইন

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ব রাজনীতির পরিমণ্ডলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জনসাধারণের রাজনৈতিক আস্থা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এর মূল কারণ হচ্ছে পপুলিস্ট বা জনতার পক্ষের রাজনৈতিক নেতৃত্বের উত্থান। ওইসব রাজনৈতিক পক্ষ প্রথাগত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি জনগণের আবেগকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসছে। এই প্রবণতার উত্থান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থায় গভীর প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে সংসদের ক্ষেত্রে। পপুলিস্ট রাজনীতি প্রায়ই স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং ইচ্ছামতো শাসনের সংস্কৃতি তৈরি করে, যা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বৈধতাকে দুর্বল করে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতা অল্প কিছু মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে। ফলে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়।

বিশ্বজুড়ে এমন অনেক দেশ আছে যারা একসময় তাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি দৃঢ় জনআস্থা উপভোগ করত, এখন নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি তারা। বৃটিশ জার্নাল অব পলিটিক্যাল সায়েন্সে প্রকাশিত সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা, ‘গ্লোবাল ট্রেন্ডস ইন ইনস্টিটিউশনাল ট্রাস্ট’ দেখিয়েছে যে, প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর (যেমন সংসদ, সরকার ও রাজনৈতিক দল) প্রতি আস্থা বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। গবেষণাটি সতর্ক করে বলেছে যে, এই পতন গণতন্ত্রের জন্য একটি কেন্দ্রীয় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে এবং এটি অগণতান্ত্রিক নেতাদের জন্য রাষ্ট্রকে ক্রমশ স্বৈরাচারী উপায়ে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন এবং লাতিন আমেরিকার ৩৬টি গণতান্ত্রিক দেশে সংসদের প্রতি আস্থা কমে গেছে।
পাকিস্তানে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি এই কম আস্থা মূলত পপুলিস্ট দলগুলোর উত্থান এবং ধারাবাহিক সরকারগুলোর নাগরিকদের সামাজিক-অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থতার ফল। সাম্প্রতিক বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে সরকারের অকার্যকারিতা এবং সামাজিক নিরাপত্তা ঘাটতিও এই আস্থাহীনতা বাড়িয়েছে। তবুও প্রমাণ রয়েছে যে নাগরিকরা গণতন্ত্রের ধারণাকে সমর্থন করে, তারা কেবল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর বিশ্বাস হারিয়েছে। যদি নিয়মিত সাধারণ নির্বাচন গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য যাচাইয়ের একটি উপায় হয়, তবে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কয়েক বছরে নিজেকে বেশ কার্যকর দেখাতে পেরেছে। তবে ঘন ঘন নির্বাচন হলেও যদি জবাবদিহিমূলক ও স্থিতিশীল সরকার না থাকে, তাহলে সেটি গণতন্ত্রের গভীরে থাকা এক অসুস্থতার ইঙ্গিত দেয়, যা জনগণের আস্থা আরও দুর্বল করে।

বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক আস্থা কমে যাওয়াকে অনেকেই ‘গণতন্ত্রের সংকট’ বলে মনে করছেন। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও এই আস্থা হ্রাস গণতন্ত্রের প্রতি নয়, বরং শাসনব্যবস্থার মানের প্রতি অসন্তোষের প্রতিফলন। এ প্রসঙ্গে ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন নেটওয়ার্কের ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের ভোটার উপস্থিতির প্রতিবেদন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দেয়। যদিও সেই নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ এবং ভোটগ্রহণে অনিশ্চয়তার আশঙ্কা ছিল, তবুও ৬ কোটি ৬ লাখ ভোটার ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সালের নির্বাচনে ভোট দেন। এটি ২০১৮ সালের চেয়ে ৫৮ লাখ বেশি ভোটার।

এটি প্রমাণ করে যে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা কমে গেলেও তা অপরিবর্তনীয় নয়। জনগণের আস্থা যদি মূলত নীতিগত কারণে নষ্ট হয়ে থাকে, তবে সেই নীতিগুলো পরিবর্তনের সময় এসেছে। এই পরিবর্তন রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র জোরদার করার মাধ্যমে সম্ভব। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর গণতন্ত্রচর্চা ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক স্বাস্থ্যের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করছেন। গবেষণাগুলো থেকে দেখা যায়, যদি রাজনৈতিক দলগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে পুরো গণতন্ত্রই বিপন্ন হয়। অর্থাৎ, গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের উপর নির্ভরশীল।

সংসদের প্রতি জনগণের আস্থা পুনর্গঠনে দরকার কিছু গঠনমূলক সংস্কার, যেমন- নাগরিকদের পিটিশনের প্ল্যাটফর্ম তৈরি, তথ্য অধিকার আইন জোরদার করা, উন্মুক্ত সরকারের নীতি গ্রহণ, অংশগ্রহণমূলক বাজেট প্রণয়ন।
রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রেও অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন দরকার। যেমন- দলীয় সদস্যদের প্রার্থী মনোনয়ন বা নেতৃত্ব নির্বাচনে বেশি ক্ষমতা দেয়া, ডিজিটাল পার্টি বা অনলাইন কাঠামোর মাধ্যমে সদস্যদের অংশগ্রহণ বাড়ানো, স্বচ্ছ সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা।
এমন সংস্কার অন্তত আংশিকভাবে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা পুনর্গঠন করতে এবং দলীয় কর্মীদের সক্রিয় করতে সহায়তা করতে পারে। পাকিস্তানে রাজনৈতিক দলগুলো আজ নানা সমস্যায় জর্জরিত। কেউ তাদের শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতার মূল উৎস মনে করে, আবার কেউ বলেন- দলগুলোর দুর্বলতাই গণতন্ত্রের পতনের ছায়া। তবুও, দলগুলো এখনো তাদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে পারে, যদি নেতৃত্ব নির্বাচনী রাজনীতির বাইরে চিন্তা করে এবং অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক উদ্ভাবন শুরু করে, যা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে ও জনগণের আস্থা পুনর্গঠন করবে।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক আস্থার পরিবর্তন সাধারণত নাগরিকদের প্রত্যাশা ও প্রতিষ্ঠানের বাস্তব পারফরম্যান্সের মধ্যকার ব্যবধানের প্রতিফলন। জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে কোনো একক ‘সমাধান’ নেই। তবে এটি সম্ভব রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন, নাগরিককেন্দ্রিক নীতি এবং জবাবদিহিমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সংসদীয় সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
* দিলাওয়ার হুসেইন, পাকিস্তানের পার্লামেন্টারি স্টাডিজে পিএইচডি ডিগ্রিধারী। তার এ লেখাটি অনলাইন জিও নিউজের অনুবাদ

https://mzamin.com/uploads/news/main/185495_Abul-11.webp

No comments

Powered by Blogger.