কঠোর অভিযানের মধ্যে কৌশলে পাথর ‘লুট’ by সুমনকুমার দাশ

নদীতে বড় বড় নৌযান সারিবদ্ধভাবে নোঙর করা, যা ‘বাল্কহেড’ নামে পরিচিত। শত শত শ্রমিক নদীর পাড়ে জমা করে রাখা পাথর টুকরিতে ভরে সেই সব নৌযানে ওঠাচ্ছেন। কাছেই নদীতে চলছে খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর), যা দিয়ে পানির নিচ থেকে পাথর ওঠানো হচ্ছে।

সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় পাথর লুটকারীদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের মধ্যেও এই দৃশ্য দেখা গেল কানাইঘাট উপজেলার লোভা নদীতে। লোভা নদী সীমান্তের ওপার থেকে এসে সুরমায় মিশেছে। এই নদীতেও পানির স্রোতের সঙ্গে ওপার থেকে পাথর আসে।

লোভা নদীর বাংলাদেশ অংশের শুরুতে একটি পাথর কোয়ারি (যেখানে পাথর উত্তোলন করা হয়) রয়েছে। সেই কোয়ারিতে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাথর উত্তোলন করা যেত। তারপর সরকার আর কোয়ারি ইজারা দেয়নি, মানে হলো পাথর তোলা নিষিদ্ধ। তবে নিলামে বিক্রি করা পাথর স্থানান্তরের নামে এখন সেখানে লুট চলছে বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। তাঁরা বলছেন, পাথর লুটের সঙ্গে জড়িত বেশির ভাগ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা, যাঁরা বিএনপির কোনো কোনো নেতার সঙ্গে মিলে কাজটি করছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁদের সঙ্গে নিলামে পাথর কেনা ঠিকাদারের যোগসাজশ রয়েছে।

লোভা নদী সিলেট শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে। কানাইঘাট উপজেলা শহর থেকে এর দূরত্ব আট কিলোমিটারের মতো। গতকাল রোববার বেলা একটা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত নৌপথে সুরমা নদী হয়ে ভারতের সীমান্তবর্তী লোভা নদীর জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, সুরমা নদীর কানাইঘাট বাজারের বিপরীত অংশ স্টেশন এলাকায় একটি বাল্কহেডে অন্তত ১৫ জন শ্রমিক পাথর তুলছিলেন। আশপাশের অন্তত আধা কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পাথরের এমন স্তূপ দেখা গেছে। পাশে ক্রাশার মেশিনে (পাথর ভাঙার কল) পাথর ভাঙার কাজও করছিলেন শ্রমিকেরা।

সুরমা নদী পেরিয়ে সংযুক্ত লোভা নদীতে ঢোকার পরপরই নদীর দুই পাড়ে কয়েক শ পাথরের স্তূপ চোখে পড়ে। নদীর দুই পাশের চিন্তারবাজার, মেছারচর, বাগিচাবাজার, নয়াবাজার, মুলাগুল, সাউদগ্রাম, বড়গ্রাম এবং লোভাছড়া ছাব্বিশের পিলারের পাশের ভালুকমারা ও ডাউকেরগুল গ্রামের পাশে অন্তত ১০০ বাল্কহেড ভেড়ানো আছে। সেসব বাল্কহেডে পাথর ওঠানো হচ্ছিল। সব মিলিয়ে অন্তত ৫০টি খননযন্ত্র দেখা যায়, যা দিয়ে পাথর নৌযানে ওঠানো হচ্ছিল। ৩০ থেকে ৩৫টি ক্রাশার মেশিনে পাথর ভেঙে টুকরা করতে দেখা যায়।

পাথর তুলতে দেখা গেছে তিনটি জায়গায়। সেখানেও খননযন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছিল। কিছু মানুষকে নদীর নিচে থাকা পাথর হাত দিয়ে তুলে নৌকায় রাখতে দেখা যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একজন বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, লোভাছড়া এলাকাটি দুর্গম। এখানে প্রশাসনের লোকজন আসেন না। এ কারণে পাথর লুটে কোনো বাধা নেই। তিনি বলেন, রাতের বেলা পাথর সরানো হয়। তখন কেউ দেখে না।

যে কৌশলে সরানো হয় পাথর

স্থানীয় প্রশাসনের সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে কোয়ারি ইজারা বন্ধের পর ভ্রাম্যমাণ আদালত নদীর দুই পাড় এবং আশপাশে থাকা প্রায় এক কোটি ছয় লাখ ঘনফুট পাথর জব্দ করেন। এর মধ্যে ৪৪ লাখ ঘনফুট পাথর ওই বছরই নিলামে তোলা হয়। যদিও তখন মামলার কারণে বিক্রি সম্ভব হয়নি। পরে আইনি জটিলতা শেষে গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি) ৪৪ লাখ ঘনফুট পাথর নিলামে বিক্রি করে। মেসার্স পিয়াস এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান সাড়ে ২১ কোটি টাকায় পাথরগুলো কিনেছিল। শর্ত ছিল, কার্যাদেশে উল্লিখিত ৪৫ দিনের মধ্যে নিজ খরচ ও উদ্যোগে নিলামে কেনা পাথর কেবল দিনের বেলা অপসারণ করতে হবে। নতুন করে পাথর উত্তোলন ও সংরক্ষণ করে নিলামে কেনা পাথরের সঙ্গে মেশানো যাবে না।

সূত্র জানায়, ঠিকাদার গত ৭ মে পাথর অপসারণে কাজ শুরু করেন। ইতিমধ্যে নির্ধারিত ৪৫ দিন শেষ হয়ে যায়। তখন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে তাঁরা সময় আরও ৩০ দিন বাড়িয়ে নেন। বাড়তি সময়ও গত ২৩ জুলাই শেষ হয়েছে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিলামপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান পাথর অপসারণে সময় বাড়ানোর দাবিতে দ্বিতীয় দফায় আবেদন করেছিল। কিন্তু জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সময় বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে আবেদনটি নথিজাতপূর্বক নিষ্পত্তি করে।’

সময় শেষ হওয়ার পরও পাথর স্থানান্তর কেন করা হচ্ছে, জানতে চাইলে ঠিকাদার মেসার্স পিয়াস এন্টারপ্রাইজের মালিক কামরুল হাসান চৌধুরী দাবি করেন, তিনি অন্যায্যভাবে কোনো পাথর অপসারণ করছেন না। তাঁর ভাষ্য, তাঁকে বিপুলসংখ্যক পাথর সরানোর জন্য সময় দেওয়া হয় মাত্র ৪৫ দিন। এ সময়ে এত পাথর সরানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, নিলামে কেনা পাথরের মাত্র ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ স্থানান্তর সম্ভব হয়েছে। তাই আবার তিন মাস সময় চেয়ে আবেদন করেছেন। সময় বাড়ানো হয়নি। তিনি উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। আদালত তাঁকে তিন মাস সময় দিয়েছেন। তিনি শুনেছেন, সরকার পক্ষ এর বিরুদ্ধে আপিল করেছে। তবে স্থগিতাদেশ আসেনি। তাই পাথর স্থানান্তরে বাধা নেই।

রাতে পাথর কে সরায় জানতে চাইলে কামরুল হাসান চৌধুরী বলেন, সেটা তিনি জানেন না।

সিলেটের পরিবেশবাদীরা বলছেন, ৪৫ দিনের পর ঠিকাদার বাড়তি ৩০ দিন সময় পেয়েছেন। কিন্তু তারপরও সময় বাড়ানোর আবেদনের উদ্দেশ্য ভিন্ন।

সামনে বিএনপি নেতারা, নেপথ্যে আ.লীগ

স্থানীয় সূত্র বলছে, নিলামে পাথর কেনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক কামরুল হাসান চৌধুরী একসময় সিলেট মহানগর ছাত্রদলের সক্রিয় নেতা ছিলেন। তাঁকে সামনে রেখে ২০ থেকে ৩০ জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী পাথর লুটে জড়িত। কয়েকজন বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত।

যাঁদের বিরুদ্ধে পাথর লুট ও পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন কানাইঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের অর্থবিষয়ক সম্পাদক তমিজ উদ্দিন, জ্যেষ্ঠ সদস্য কামাল উদ্দিন, আওয়ামী লীগ কর্মী মঈনুল (অন্য মামলায় ১২ আগস্ট গ্রেপ্তার), লক্ষ্মীপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন, সহসভাপতি বিলাল আহমদ, কানাইঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক আলমাস উদ্দিন।

নাম আসা তিনজনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়েছে। তাঁরা হলেন তমিজ উদ্দিন, বিলাল আহমদ ও আলমাস উদ্দিন। তাঁরা অভিযোগ অস্বীকার করেন। তমিজ উদ্দিন বলেন, ‘আমি এসবে জড়িত নই। যিনি নিলাম পেয়েছেন, তিনি কি অভিযোগ করেছেন? যদি তিনি না করেন, তাহলে কেন আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ? লোভাছড়ার দুই পাড়ে নিলামের বাইরে কোনো পাথর নেই।’

আলমাস উদ্দিন বলেন, ‘আমরার থুরাথুরি (সামান্য) মাল (পাথর) আছিল। সরকার নিয়া গেছে। এখন নিলাম যারা পাইছে, তারা নিতাছে। আমরা কিছুত জড়িত নাই।’

অবশ্য কানাইঘাট উপজেলার লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক নাজিম উদ্দিন বলেন, নিলাম পাওয়া প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা ও বিএনপির দু-একজন কর্মী মিলে পাথর এখন সরাচ্ছেন। নিলামের পাথর অপসারণের সময় শেষ হলেও পাথর নেওয়া থামছে না। এ ছাড়া নতুন করে পাথর তোলায় এলাকার পরিবেশও বিনষ্ট হচ্ছে।

নিলামের কাগজ ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে

সিলেটের বিভিন্ন জায়গা থেকে এক বছর ধরে পাথর লুট করা হয়। সর্বশেষ লুট করা হয় ভোলাগঞ্জ উপজেলার সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র থেকে। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সরকার বৃহস্পতিবার থেকে জোরালো অভিযান শুরু করেছে।

স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, গতকাল পঞ্চম দিনের মতো লুট হওয়া পাথর উদ্ধারে যৌথ বাহিনী ও টাস্কফোর্সের অভিযান পরিচালিত হয়েছে। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, সিলেট সদর, কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় টাস্কফোর্সের অভিযানে প্রায় ৩৯ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার করা হয়। এ সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সদর উপজেলার সালুটিকর এলাকা থেকে দুজনকে আটক করা হয়।

অভিযানের মধ্যে যখন পাথর স্থানান্তর কঠিন হয়ে পড়েছে, তখন লোভা নদী থেকে নিলামের কাগজ ব্যবহার করে পাথর সরানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেটের বিভাগীয় সমন্বয়কারী শাহ সাহেদা আখতার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিলামের বৈধ কাগজটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে একটি চক্র কোয়ারি ও আশপাশের এলাকায় নির্বিচার লুটপাট চালাচ্ছে।’

পাথর লুট চলছেই। সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়া থেকে খননযন্ত্র দিয়ে অবাধে পাথর তোলা হচ্ছে। পাথর ভাঙার পর তোলা হচ্ছে নৌযানে। গতকাল দুপুরে
পাথর লুট চলছেই। সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়া থেকে খননযন্ত্র দিয়ে অবাধে পাথর তোলা হচ্ছে। পাথর ভাঙার পর তোলা হচ্ছে নৌযানে। গত ১৮ আগস্ট ২০২৫, দুপুরে ছবি: আনিস মাহমুদ

No comments

Powered by Blogger.