গাজায় সফল, ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে অচলাবস্থায় কেন ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে আসন্ন এক শীর্ষ বৈঠক নিয়ে জোর গুঞ্জন চললেও, তা আপাতত স্থগিত হয়ে গেছে। মাত্র কয়েক দিন আগেই ট্রাম্প ঘোষণা করেন তিনি দুই সপ্তাহের মধ্যে হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। কিন্তু হঠাৎ করেই সেই বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রাথমিক বৈঠকটিও বাতিল করা হয়েছে।

মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের কাছে ট্রাম্প বলেন, আমি সময় নষ্ট করতে চাই না। অর্থহীন কোনো বৈঠক আমি করব না, দেখি কী হয়। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি। সাংবাদিক অ্যান্থনি আর্চার এতে আরও লিখেছেন, এ অনিশ্চিত শীর্ষ সম্মেলন ট্রাম্পের ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটানোর চেষ্টার সর্বশেষ অধ্যায়। গাজার যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি বিনিময় চুক্তিতে মধ্যস্থতা করার পর ট্রাম্প এখন ইউক্রেনের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। মিশর সফরের সময় সেই গাজা চুক্তি উদযাপন করতে গিয়ে ট্রাম্প তার মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক প্রধান কূটনৈতিক আলোচক স্টিভ উইটকফকে বলেন, এবার আমাদের রাশিয়ার কাজটা শেষ করতে হবে।

গাজায় সাফল্য, ইউক্রেনে অচলাবস্থা: কিন্তু গাজায় যে সব পরিস্থিতি একসঙ্গে হয়ে ট্রাম্পকে সফল হতে সাহায্য করেছিল, ইউক্রেনে  তার পুনরাবৃত্তি করা প্রায় অসম্ভব। উইটকফের মতে, গাজা চুক্তির মূল চালিকাশক্তি ছিল ইসরাইলের কাতারে থাকা হামাস প্রতিনিধিদের ওপর হামলা। এই পদক্ষেপে মার্কিন আরব মিত্ররা ক্ষুব্ধ হলেও ট্রাম্প এতে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। ক্ষমতার প্রথম মেয়াদ থেকেই ট্রাম্প ইসরাইলের দৃঢ় সমর্থক। তিনি তেল আবিব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর করেছেন। পশ্চিম তীরে ইসরাইলি বসতি বৈধ ঘোষণা করেছেন। সম্প্রতি ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে ইসরাইলকে সমর্থন সমর্থন দিয়েছেন। সব মিলিয়ে তিনি ইসরাইলে অত্যন্ত জনপ্রিয়। ফলে নেতানিয়াহুর ওপর তার এক ধরনের বিরল প্রভাব আছে। অন্যদিকে, ট্রাম্পের সঙ্গে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কও তার জন্য অতিরিক্ত কূটনৈতিক সুবিধা এনে দেয়।

ইউক্রেন নিয়ে কম প্রভাব:
কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধে ট্রাম্পের প্রভাব সীমিত। নয় মাস ধরে তিনি কখনও পুতিনকে, কখনও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে চাপ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু উল্লেখযোগ্য কোনো ফল আসেনি। তিনি রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানিতে নতুন নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছেন। আবার ইউক্রেনকে দীর্ঘপাল্লার অস্ত্র দেয়ার কথাও বলেছেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন এসব পদক্ষেপ বিশ্ব অর্থনীতিতে ধাক্কা দিতে পারে এবং যুদ্ধ আরও তীব্র করতে পারে। এদিকে তিনি প্রকাশ্যে জেলেনস্কির সমালোচনা করেছেন। কিছু সময়ের জন্য ইউক্রেনের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য শেয়ার বন্ধ করেছেন এবং অস্ত্র সরবরাহ স্থগিত রেখেছেন। কিন্তু ইউরোপীয় মিত্রদের চাপের মুখে পরে তা পুনরায় শুরু করতে বাধ্য হয়েছেন।

ট্রাম্প নিজেকে একজন ‘ডিলমেকার’ হিসেবে তুলে ধরতে ভালোবাসেন। মুখোমুখি বৈঠকে চুক্তি করার ক্ষমতা তার আছে বলে দাবি করেন। কিন্তু পুতিন ও জেলেনস্কির সঙ্গে তার একাধিক বৈঠক যুদ্ধের কোনো অগ্রগতি আনেনি। অনেকে মনে করছেন, পুতিন হয়তো ট্রাম্পের চুক্তিতে আগ্রহ এবং সরাসরি আলোচনায় বিশ্বাস ব্যবহার করছেন নিজের সুবিধার জন্য। জুলাইয়ে যখন মার্কিন কংগ্রেসে রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজ অনুমোদনের পথে ছিল, তখন পুতিন আলাস্কায় এক সম্মেলনের প্রস্তাব দেন। ফলে সেই বিলটি স্থগিত হয়। সম্প্রতি যখন ট্রাম্প ইউক্রেনে টমাহক ক্রুজ মিসাইল ও প্যাট্রিয়ট বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাঠানোর কথা ভাবছিলেন, পুতিন তাকে ফোন করেন- আর ট্রাম্প তখনই বুদাপেস্ট সম্মেলনের ইঙ্গিত দেন। পরের দিন জেলেনস্কি হোয়াইট হাউসে যান। কিন্তু ফলাফলহীন বৈঠকের পর ফিরে আসেন। ট্রাম্প বলেন, আমাকে কেউ বোকা বানাতে পারবে না। সারা জীবন আমি সেরাদের কাছ থেকে শিখেছি, আর সবসময় জিতে বেরিয়েছি।

কিন্তু জেলেনস্কির মন্তব্য ছিল তীক্ষ্ণ। তিনি বলেন, যখনই দীর্ঘপাল্লার অস্ত্র বা সহায়তার বিষয়টা দূরে সরে যায়, তখনই রাশিয়া কূটনীতি থেকে আগ্রহ হারায়। কয়েক দিনের মধ্যেই ট্রাম্প একদিকে ইউক্রেনকে ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানোর চিন্তা থেকে সরে এসে পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পরিকল্পনা করেন, আবার জেলেনস্কির ওপর চাপ দেন দোনবাস অঞ্চল ছেড়ে দিতে, যার কিছু অংশ রাশিয়া এখনও দখল করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত তিনি বর্তমান সীমান্তরেখা ধরে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন, যা রাশিয়া প্রত্যাখ্যান করেছে।
নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করতে পারবেন। এখন তিনি স্বীকার করছেন, বিষয়টি তার ধারণার চেয়েও কঠিন। এটি তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার এক বিরল স্বীকারোক্তি এবং এটা বাস্তবতা যে, যখন কোনো পক্ষই হার মানতে বা ছাড় দিতে রাজি নয়, তখন শান্তির কাঠামো তৈরি করা প্রায় অসম্ভব।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.