যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ: গাজায় ইসরাইলের বিমান হামলা

গাজায় নতুন করে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। তাদের অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে হামাস। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের পর অব্যাহতভাবে গাজা, পশ্চিমতীরে ইসরাইল হামলা চালিয়ে আসছিল। এ খবর মিডিয়ায় প্রকাশ হয়েছে। ইসরাইল সে বিষয়ে কোনো কথা বলে না। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ অভিযোগ করেন, মঙ্গলবার হামাস যোদ্ধারা গাজায় অবস্থানরত ইসরাইলি সেনাদের ওপর হামলা চালিয়েছে এবং নিহত জিম্মিদের মৃতদেহ ফেরত দেয়ার চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তবে ফিলিস্তিনি এই যোদ্ধাগোষ্ঠী জানিয়েছে, ইসরাইলি সেনাদের ওপর ওই হামলার সঙ্গে তাদের যোদ্ধাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা এখনো যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে অটল আছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি।

হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার সিভিল ডিফেন্স সংস্থা ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ৩৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজা সিটি, বেইত লাহিয়া, আল-বুরেইজ, নুসেইরাত ও খান ইউনুসে বাড়িঘর, স্কুল ও আবাসিক ভবনে হামলা করা হয়েছে। তবুও যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স জানিয়েছেন, তিনি মনে করেন যুদ্ধবিরতি এখনো কার্যকর আছে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দপ্তর থেকে প্রকাশিত এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলা হয়, তিনি সেনাবাহিনীকে ‘প্রবল আঘাত হানার’ নির্দেশ দিয়েছেন। তবে এর কারণ বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়নি।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাটজ বলেন, হামাস ইসরাইলি সেনাদের ওপর হামলা চালিয়ে ‘চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করেছে’। তিনি হুঁশিয়ারি দেন, হামাস এই আক্রমণ এবং জিম্মিদের মৃতদেহ ফেরত না দেয়ার চুক্তি ভঙ্গের জন্য বহু গুণ বেশি মূল্য দেবে। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, হামাসের এই হামলা হয়েছে ‘ইয়েলো লাইন’-এর পূর্বদিকে, যা যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী গাজায় ইসরাইলি নিয়ন্ত্রিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত।

ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম জানায়, মঙ্গলবার বিকেলে দক্ষিণ গাজার রাফায় ইসরাইলি সেনারা ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ও স্নাইপার হামলার মুখে পড়ে। একই সময়ে ফিলিস্তিনি গণমাধ্যম ইসরাইলি কামান থেকে গোলাবর্ষণের খবর দেয়। সন্ধ্যায় ইসরাইলি বিমান হামলার পর গাজা সিটি ও খান ইউনুসসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রবল বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। হামাস-নিয়ন্ত্রিত সিভিল ডিফেন্স সংস্থার এক মুখপাত্র জানান, গাজা সিটির দক্ষিণাঞ্চলীয় সাবরা পাড়ায় আল-বান্না পরিবারের একটি বাড়িতে বোমা হামলায় তিন নারীসহ চারজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া হামলার একটি লক্ষ্যবস্তু ছিল পশ্চিম রিমাল এলাকার আল-শিফা হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। খান ইউনুসের আল-কাসসাম স্ট্রিটে একটি গাড়িতে হামলায় দুই শিশু ও এক নারীসহ আরও পাঁচজন নিহত হয়েছেন। হামাস এক বিবৃতিতে জানায়, তাদের যোদ্ধারা কোনো ইসরাইলি সেনার ওপর হামলা চালায়নি এবং ইসরাইলি হামলার তারা নিন্দা জানায়। তারা বলে, রাফায় গুলিবর্ষণের সঙ্গে হামাসের কোনো সম্পর্ক নেই এবং সংগঠনটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, গাজা উপত্যকায় দখলদার (ইসরাইলি) সেনাবাহিনীর এই বর্বর বোমাবর্ষণ যুদ্ধবিরতি চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

হামাসের সামরিক শাখা জানায়, ইসরাইলের এই ‘লঙ্ঘনের’ কারণে তারা মঙ্গলবার পুনরুদ্ধার করা এক জিম্মির দেহ ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে। ওয়াশিংটনে সাংবাদিকদের সামনে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স বলেন, যুদ্ধবিরতি এখনো টিকে আছে। এর মানে এই নয় যে, মাঝেমধ্যে ছোটখাটো সংঘর্ষ হবে না। তিনি আরও বলেন, আমরা জানি হামাস অথবা গাজার অন্য কেউ একজন ইসরাইলি সেনাকে আক্রমণ করেছে। আমরা আশা করি, ইসরাইল এর প্রতিক্রিয়া জানাবে। তবে প্রেসিডেন্টের শান্তি পরিকল্পনা এই ঘটনাতেও টিকে থাকবে।

এর আগে সোমবার রাতে হামাস এক কফিনে করে মানবদেহের কিছু অংশ ফেরত দেয়, যা ১৩ জন মৃত জিম্মির কারও নয় বলে দাবি করে ইসরাইল। এরপর নেতানিয়াহু বলেন, হামাসের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে। নেতানিয়াহুর দপ্তর জানায়, ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে দেহাবশেষটি ২০২৩ সালের শেষ দিকে গাজায় উদ্ধার হওয়া ইসরাইলি জিম্মি ওফির জারফাতির, যা যুদ্ধবিরতি চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন। ইসরাইলি সেনারা এক ভিডিও প্রকাশ করে দাবি করেছে, সেখানে দেখা যায় হামাস যোদ্ধারা গাজা সিটির পূর্বাংশে এক স্থাপনা থেকে দেহাবশেষ সরিয়ে পাশেই কবর দিচ্ছে এবং পরে রেড ক্রস কর্মকর্তাদের ডেকে ভুয়া পুনরুদ্ধার নাটক সাজায়। হামাস এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে এবং বলেছে, ইসরাইল নতুন আগ্রাসনের অজুহাত তৈরি করতে চায়। পরে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি (আইসিআরসি) এক বিবৃতিতে জানায়, তারা ঘটনাস্থলে গিয়েছিল হামাসের অনুরোধে এবং সদিচ্ছা থেকে। ঘটনাটির আগে কোনো মৃতদেহ সেখানে রাখা হয়েছিল- এ ব্যাপারে তাদের কোনো ধারণা নেই। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এমন ভুয়া পুনরুদ্ধার নাটক অগ্রহণযোগ্য, যখন এত কিছু এই চুক্তির ওপর নির্ভর করছে এবং অসংখ্য পরিবার এখনো তাদের প্রিয়জনের খবরের জন্য অপেক্ষা করছে।

যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তিটি প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা গাজা শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ বাস্তবায়নের অংশ। চুক্তি অনুযায়ী, ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে হামাস ৪৮ জন জীবিত ও মৃত জিম্মিকে ফেরত দেবে। ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত হামাস ২০ জীবিত ইসরাইলিকে মুক্তি দিয়েছে। বিনিময়ে ইসরাইল ২৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দি ও ১,৭১৮ জন গাজাবাসীকে মুক্তি দিয়েছে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.