গাজায় কি শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা বন্ধ হচ্ছে

আল–জাজিরাঃ গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছাতে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবের বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তারা সব ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে। তবে ২০ দফা চুক্তির অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চায় তারা।

ট্রাম্প ইতিমধ্যে ইসরায়েলকে অবিলম্বে গাজায় বোমা হামলা বন্ধ করার অনুরোধ জানিয়েছেন। ইসরায়েলের সরকারও সেনাবাহিনীকে গাজায় হামলা বন্ধ করতে বলেছে।

অবশেষে কি গাজায় দুই বছর ধরে চলা ইসরায়েলি যুদ্ধের অবসান হতে যাচ্ছে? নাকি সামনে আরও জটিলতা অপেক্ষা করছে? এমন প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে।

হামাস আসলে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে

হামাস বলেছে, তারা গাজায় জিম্মি অবস্থায় থাকা সব ইসরায়েলিকে মুক্তি দেবে। জিম্মিদের মধ্যে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের মৃতদেহও হস্তান্তর করা হবে। এর বিনিময়ে তারা চায়, গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ বন্ধ হোক এবং গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলি সেনারা সরে যাক।

হামাস আরও বলেছে, তারা একটি স্বাধীন ও অরাজনৈতিক ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (টেকনোক্র্যাট) কাছে গাজার শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করবে।

ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনার মধ্যে হামাসের অস্ত্র সমর্পণের বিষয়টিও আছে। ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিষয়ে হামাস বলেছে, একটি বিস্তৃত ফিলিস্তিনি জাতীয় রূপরেখার মধ্যে থেকে আলোচনা করা উচিত। ওই আলোচনায় হামাসও অন্তর্ভুক্ত থাকবে এবং পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে অংশ নেবে।

ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া কি ইতিবাচক

ট্রাম্প হামাসের প্রতিক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি তাঁর মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এ–সংক্রান্ত পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে ট্রাম্প লিখেছেন, তিনি মনে করেন ফিলিস্তিনি সংগঠনটি ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য প্রস্তুত’।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট আরও লিখেছেন, ইসরায়েলকে অবশ্যই অবিলম্বে গাজায় বোমা হামলা বন্ধ করতে হবে, যেন বন্দীদের মুক্তি দেওয়া যায়।

ট্রাম্প লিখেছেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে বিস্তারিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করেছি। বিষয়টি শুধু গাজা নিয়ে নয়, এটি মধ্যপ্রাচ্যে বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত শান্তি অর্জনের বিষয়।’

ট্রাম্প পরে একটি ভিডিও বার্তা দেন। সেখানে ট্রাম্প আবারও বলেন, তিনি হামাসের জবাবকে একটি বিজয় হিসেবে দেখছেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘এটি একটি বড় দিন। দেখা যাক সব কীভাবে এগোয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত করতে হবে। আমি শুধু বলতে চাই, এটি একটি বিশেষ দিন।’

ইসরায়েলের অবস্থান কী

ট্রাম্প গত সোমবার হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পাশে দাঁড়িয়ে গাজা শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। নেতানিয়াহু তখন বলেন, তিনি ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে সমর্থন করেন। কারণ, তিনি মনে করেন, এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েল তাদের যুদ্ধের লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে।

নেতানিয়াহু বলেন, ‘এটি আমাদের সব জিম্মিকে ইসরায়েলে ফিরিয়ে আনবে, হামাসের সামরিক সক্ষমতা এবং রাজনৈতিক শাসন বাতিল করবে এবং নিশ্চিত করবে যে গাজা আর কখনো ইসরায়েলের জন্য হুমকি হবে না।’

তবে নেতানিয়াহু কিছু সতর্কবার্তাও দিয়েছেন। হোয়াইট হাউসে তিনি বলেছেন, হামাস যদি চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে অথবা চুক্তি মানার ভান করে পরে উল্টোটা করার চেষ্টা করে—তাহলে ইসরায়েল ‘নিজেই কাজটি শেষ করে দেবে।’

এর কয়েক ঘণ্টা পর নেতানিয়াহু ইসরায়েলিদের উদ্দেশে হিব্রু ভাষায় বলেন, তিনি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের বিষয়ে একমত নন। ইসরায়েলি সেনারা গাজার বেশির ভাগ অংশে থাকবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।

হামাসের অস্ত্র সমর্পণের বিষয়টিও সমস্যাপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু বলছেন, হামাসকে অবিলম্বে অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে। তবে হামাস শুধু বলেছে, তারা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে চায়।

আল-জাজিরার সাংবাদিক আলী হাশেম বলেন, হামাসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গাজার ভবিষ্যৎ, সামগ্রিক সংগ্রামের ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনিদের সম্মতির ওপর নির্ভর করবে। তারা চায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য বড় পরিসরে ফিলিস্তিনি সম্মতি গড়ে তোলা হোক। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে হামাসের কথার মধ্যে যদি—কিন্তু...আছে।

মূল বিরোধের জায়গা কী হবে

হামাস পরিষ্কার বলে দিয়েছে, তারা ট্রাম্পের পরিকল্পনার কয়েকটি দিক মানতে রাজি নয়। যেমন ট্রাম্প ও সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী প্রশাসন গঠনের বিষয়ে তাদের সম্মতি নেই।

হামাসের শীর্ষ কর্মকর্তা মুসা আবু মারজুক আল-জাজিরাকে বলেন, ‘ফিলিস্তিনি নন এমন কেউ ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণ করুক, তা আমরা কখনো চাই না।’

টনি ব্লেয়ার আগে ইরাকে আগ্রাসনে জড়িত ছিলেন উল্লেখ করে তাঁর নিয়োগকে বিশেষভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত বলে উল্লেখ করেছেন মুসা।

অস্ত্রবিজ্ঞান বা নিরস্ত্রীকরণও সমস্যা হবে। ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু বলছেন, হামাসকে অবিলম্বে অস্ত্র ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু হামাস শুধু বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে রাজি আছে।

আল-জাজিরার আলী হাশেম বলেন, হামাসের বক্তব্যে বলা হয়েছে গাজার ভবিষ্যৎ এবং পুরো সংগ্রামের ভবিষ্যৎ—ফিলিস্তিনিদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে। তারা চায় ফিলিস্তিনিদের বিস্তৃত সম্মতি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হোক। স্পষ্ট হলো, হামাস বলেছে, ‘হ্যাঁ, কিন্তু...।

ইসরায়েল কি আসলেই হামলা থামাবে

এক্সিওসের প্রতিবেদক বারাক রাভিদ মনে করেন, ট্রাম্পের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার কারণে ইসরায়েল সরকার সম্ভবত অখুশি হবে। কারণ, হামাস একেবারে সব দাবির বিষয়ে সায় দিয়ে দেয়নি। শোনা যাচ্ছে, ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া শুনে নেতানিয়াহু ‘হতবাক’ হয়েছেন। তিনি হামাসের জবাবকে শান্তি পরিকল্পনা ‘প্রত্যাখ্যান’ হিসেবে দেখছেন।

নেতানিয়াহুর সরকারে উগ্র ডানপন্থীদের আধিপত্য রয়েছে। ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনাটি তাদের পছন্দ হয়নি। তারা ইতিমধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে, নেতানিয়াহু যদি চুক্তিতে সম্মত হন, তাহলে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যেতে হবে।

অবশ্য ইসরায়েলের বিরোধী দল চুক্তিটি সমর্থন করলেও নেতানিয়াহুর ওপর তাদের অবিশ্বাসের কারণে একসঙ্গে জোট গঠন করা কঠিন হবে।

এখন ট্রাম্প কতটা চাপ দিয়ে নেতানিয়াহুকে চুক্তিতে রাজি করাতে পারবেন, তার ওপর সবকিছু নির্ভর করছে।

ওয়াশিংটন থেকে আল-জাজিরার প্রতিবেদক শিহাব রতনসি বলেন, ‘ধারণা করতে পারেন কি, এখনই ওয়াশিংটন ডিসিতে কতগুলো পক্ষ জড়ো হয়েছে, যারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে।’

রতনসি আরও বলেন, ‘এখন তিনি (ট্রাম্প) কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং মধ্যস্থতাকারীরা তাঁকে চুক্তির শর্তগুলো বহাল রাখা না রাখার ব্যাপারে কতটা চাপ দিচ্ছে, তার ওপর সবকিছু নির্ভর করছে। কারণ, অতীতে দেখা গেছে, হামাসকে চুক্তি মানতে বলা হয়েছে। আর ইসরায়েলকে নতুন করে হামলা শুরু করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

ট্রাম্পের আহ্বান সত্ত্বেও ইসরায়েল এখনো গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। আজ ভোর থেকে হামলায় কমপক্ষে ২০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

ট্রাম্পের কাছে নেতানিয়াহু কি আসলেই বোঝা, কী বলছেন ইসরায়েলি বিশ্লেষক

ইসরায়েল এখন শুধু তার ‘প্রচলিত শত্রু ও সমালোচকদের’ জন্যই নয়, বরং ট্রাম্প ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো ‘মহান বন্ধুদের’ জন্যও বোঝায় পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ওরি গোল্ডবার্গ গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা এবং বিশ্ববাসীর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ঠিক এভাবে কথাটি বললেন।

তেল আবিব থেকে আল-জাজিরাকে গোল্ডবার্গ বলেন, ‘কেউ এটা প্রকাশ্যে স্বীকার করবেন না। কিন্তু আমি মনে করি, হামাসের জবাবকে শান্তি স্থাপনের আগ্রহ হিসেবে দেখে ট্রাম্প যে আকস্মিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা এমনি এমনি নয়।’

গোল্ডবার্গ বলেন, ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত এটাই প্রমাণ করে, তিনি যখন নেতানিয়াহু বা ইসরায়েলের দিকে তাকাচ্ছেন, তখন তিনি একে একটি বোঝা হিসেবে দেখছেন। ট্রাম্পের বহুল পরিচিত ভাষায় বলতে গেলে, তিনি একজন ‘লুজার’ বা ‘ব্যর্থ ব্যক্তিকে’ দেখছেন।

ইসরায়েলি বিশ্লেষক আরও যোগ করেন, ইসরায়েল এমনটা একেবারেই আশা করেনি। কারণ, দেশটি তার ‘জাতিগত নিধনমূলক কর্মকাণ্ডের অন্তহীন চক্রে’ এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে তারা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার বাইরে অন্য কিছু স্বীকার করতে পারছিল না।

গোল্ডবার্গ বলেন, ‘গাজায় যাওয়ার চেষ্টা চালানো প্রথম ফ্লোটিলা ও গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার মধ্যে পার্থক্য দেখুন। আর এই (দ্বিতীয়) ফ্লোটিলার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের পদক্ষেপের পর বিশ্বজুড়ে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা খেয়াল করুন। কিছুই আগের মতো নেই। আমি মনে করি, গত দুই বছরের মধ্যে ইসরায়েল আজ শনিবার সকালে সবচেয়ে বেশি একাকী হয়ে পড়েছে।’

তবে গোল্ডবার্গ যুক্তি দিয়ে বলেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনা মেনে চলার ক্ষেত্রে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নিজস্ব একটি সুবিধা রয়েছে।

এই বিশ্লেষক বলেন, ইসরায়েলে যদি মধ্যবর্তী জাতীয় নির্বাচন দেওয়া হয়, তবে নেতানিয়াহুর জন্য এটাই সবচেয়ে সুবিধাজনক পরিস্থিতি হবে। কারণ, তিনি এমন একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার সুযোগ পাবেন, যিনি একটি অনিবার্য কঠিন যুদ্ধ লড়েছেন। একই সঙ্গে তিনি একটি অনিবার্য কঠিন চুক্তিও স্বাক্ষর করতে পেরেছেন।

ইসরায়েলি সামরিক অভিযানকে কেন্দ্র করে উত্তর গাজা থেকে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা দক্ষিণের দিকে সরে যাওয়ার পর বিশ্রাম নিচ্ছেন। ৩ অক্টোবর ২০২৫
ইসরায়েলি সামরিক অভিযানকে কেন্দ্র করে উত্তর গাজা থেকে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা দক্ষিণের দিকে সরে যাওয়ার পর বিশ্রাম নিচ্ছেন। ৩ অক্টোবর ২০২৫ ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.