দুর্নীতি দূর না করতে পারলে দারিদ্র্য হটবে না by মামুন রশীদ
এটির কারণ হিসেবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ভূরাজনৈতিক কারণকে দায়ী করা হলেও অনেকেই জোরেশোরে বলছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য না এলে দারিদ্র্য হ্রাসের প্রক্রিয়া টেকসই হবে না। সরকারের সাহায্য বা সুযোগ বণ্টনে বৈষম্য বরং দারিদ্র্য বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে।
সংগত কারণেই গত ৫৪ বছরে বাংলাদেশে অনেক সরকার এসেছে, অনেক সরকার বিদায় নিয়েছে। এঁদের মধ্যে কেউ বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, কেউবা এশিয়ার উদীয়মান শক্তি হওয়ার বাসনা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মৌলিক যে অধিকার—অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়নি।
দেশের ব্যক্তি খাতের আপাতবিকাশ ও সাফল্যে শহর-নগরে কোথাও কোথাও গতি, প্রবৃদ্ধি আর সেবার মান বাড়লেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমানের দৃশ্যমান উন্নতি লক্ষণীয় নয়। তদুপরি অধিক জনসংখ্যা, দুর্বল সড়ক-জনপথ পরিকল্পনা, জমির ব্যবহার নীতির দুর্বলতা আর বিচার না পাওয়ার সংস্কৃতি মানুষের জীবনকে প্রতিনিয়তই ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এখনো দেশের এক-চতুর্থাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছেন। একটি বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশে এখন দারিদ্র্যের হার ২৭ দশমিক ৯৩ বা প্রায় ২৮ শতাংশ। সরকারি হিসাবেই ২০২২ সালে এই হার ছিল ১৮ দশমিক ৭। দারিদ্র্য বৃদ্ধির এই িচত্র আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। সম্প্রতি পিপিআরসি পরিচালিত ‘ইকোনমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউসহোল্ড লেভেল ইন মিড ২০২৫’ শীর্ষক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, দারিদ্র্যের পাশাপাশি অতিদারিদ্র্যের হারও বেড়েছে। সরকারি হিসাবে ২০২২ সালে অতিদারিদ্র্যের হার ছিল ৫ দশমিক ৬। তিন বছর পর এসে অতিদারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৫-এ।
গবেষণামতে, মূলত ২০২০-২০২২ সালের করোনা মহামারি, মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। করোনার প্রভাব অনেকটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হার এখনো অনেক বেশি। অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগ বাড়ছে না। বিনিয়োগ না বাড়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাচ্ছে, অথচ প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণী কর্মবাজারে প্রবেশ করছেন। শিক্ষার মানের অধোগমনও এখানে প্রভাব ফেলছে।
বিগত সরকারের শেষ সময়ে অর্থনীতিতে যে বিশৃঙ্খল অবস্থা ও লুটপাট চলছিল, তা জনজীবনে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর সামষ্টিক অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এলেও সার্বিক পরিস্থিতি এখনো ভালো বলা যাবে না। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ মূল্যস্ফীতি কমাতে পারলেও বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৮ শতাংশের বেশি। যেখানে সাধারণ মানুষকে খাদ্যপণ্যের পেছনে আয়ের ৫৫ শতাংশ ব্যয় করতে হয়, সেখানে তাঁদের পক্ষে বেঁচে থাকার অন্যান্য উপকরণের জোগান দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। খাদ্যপণ্যের মতো পরিবহন, বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ব্যয়ও বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে; যদিও সেই অনুপাতে আয় বাড়েনি।
স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা ছিল অন্তর্বর্তী সরকার দারিদ্র্যের হার কমাতে টেকসই পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু গত এক বছরে তাদের নীতি-পরিকল্পনায় সে রকম ছাপ দেখা যায়নি। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো গতানুগতিকভাবে চলছে। জুলাই অভ্যুত্থানের আগে থেকে চলে আসা রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা পুরোপুরি চলে গেছে, তা বলার মোটেই সুযোগ নেই।
অনেকেই বলেছেন, দারিদ্র্য বৃদ্ধি ঠেকাতে সরকারের উদ্যোগ কম কিংবা উদ্যোগ থাকলেও সাধ্য নেই। তদুপরি সামাজিক সুরক্ষায় যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা-ও সব সময় উপযুক্ত ব্যক্তি পান না। স্বার্থান্বেষী মহল হাতিয়ে নেয়। প্রচুর দুর্নীতি হয়। গরিবের হক ধনীরা মেরে খায়।
অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করেছে। এ অবস্থায় তাদের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া কতটা সম্ভব হবে, সে বিষয়ে সংশয় আছে। কিন্তু সরকার অন্তত স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারত, যাতে দারিদ্র্যের হার কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা সম্ভব হতো।
এ বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়িত্ব আছে। দলগুলোর নেতৃত্ব রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক রূপরেখা নিয়ে মাসের পর মাস দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলেও জনগণের অর্থনৈতিক সমস্যার বিষয়ে সীমাহীন উদাসীনতা দেখিয়ে আসছেন। রয়েছে চিন্তার সক্ষমতার বিষয়টিও। দারিদ্র্য বিমোচনে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি ও নীতি-পরিকল্পনা কী, সেটা জানার অধিকার নিশ্চয়ই নাগরিকদের আছে।
সেই সঙ্গে আরও দুঃখজনক হলো দুর্নীতি দূরীকরণে কাউকে এখন পর্যন্ত জোরে শব্দ করতে শোনা যায়নি। বাংলাদেশে দুর্নীতি কমানো সম্ভব—এটা অনেকে সম্ভবত বিশ্বাসও করেন না। সাঁড়াশি অভিযানের জোর সম্ভবত ভোঁতা হয়ে গেছে কিংবা কাজ করানোতে কারও উৎসাহ নেই। অথচ আমরা জানি, দুর্নীতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র জনগোষ্ঠী।
উপরিউক্ত গবেষণাতেই বলা হয়েছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য তথা পুষ্টিতে পিছিয়ে পড়ছে দরিদ্র মানুষ। তাদের জন্য বরাদ্দ অর্থের অনেকটাই তাদের কাছে পৌঁছায় না। অন্যদিকে সরকারের আয় কম বলে বরাদ্দও কম। রাজনৈতিক বন্দোবস্তও তাদের পক্ষে নয় বা থাকে না। অধিকতর আয়বৈষম্য তাদের ওপর করালগ্রাস হিসেবে কাজ করে। তাই বলাই যায়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই টেকসই না হলে দারিদ্র্য হ্রাসও দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
* মামুন রশীদ, অর্থনীতি বিশ্লেষক

No comments