চীনের দাবিতে ভারত যে কারণে নীরব by শ্যাম সরণ

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাড়াবাড়ি রকমের আন্তরিকতার দৃশ্য দেখা গেল সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সম্মেলনে। এই আয়োজন চীনের নেতৃত্বের সামর্থ্যের প্রদর্শন। কিন্তু চীনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর তিয়ানজিনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ভারত ও চীনের দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধ আর দুই দেশের প্রতিযোগিতার প্রশ্ন খুব বেশি সমাধান হয়নি।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ক্রমে বেড়ে চলা দূরত্বের দিকে তীক্ষ্ণভাবে নজর রাখছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্ক–আঘাত এবং ট্রাম্প ও তাঁর অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট ও বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারোর ভারতবিরোধী তীব্র ও অবমাননাকর বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে চীন কোনো সময় নষ্ট না করে ভারতের পাশে দাঁড়ায়। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তিয়ানজিনে মোদিকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান।

রাশিয়া ও ভারতের সম্পর্কের বিশেষ ঘনিষ্ঠতার আভাস দিতে গিয়ে তিয়ানজিনে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে যোগদানের সময় পুতিন নিজের লিমুজিন গাড়িতে মোদিকে তুলে নেন। কিন্তু গত কয়েক দশকে রাশিয়া-ভারত সম্পর্কের গুরুত্ব যেমন কমেছে, আবার মাত্রাটাও অনেকটা ক্ষয় হয়েছে। বিপরীতে চীনের সঙ্গে রাশিয়া তার সম্পর্ককে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে। চীনের সঙ্গে এখন ‘অসীম অংশীদারত্বের’ সম্পর্ক রাশিয়ার। আর চীন ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।

সম্মেলনে পুতিন আবারও রাশিয়া-ভারত-চীন ত্রিপক্ষীয় ফোরাম পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেন। এ ফোরাম একসময় ব্রিকস ও এসসিও গঠনের পথ তৈরি করেছিল। বহুপক্ষীয় সম্পর্ক ও বাণিজ্য সমন্বয়ের পথ খুলে দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুতিনকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে সি চিন পিং ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত আলাপের আনুষ্ঠানিক আয়োজনে। প্রদর্শনীর জাঁকজমক যখন যখন বাড়ে, তখন আসল অগ্রগতির তখন খুঁড়িয়ে চলে। তিয়ানজিনে ভারত-চীন বৈঠকের বাস্তব অর্জনকে অবশ্যই এই মাপকাঠি থেকে বিচার করতে হবে।

ভূরাজনীতির পাল্টে যাওয়া সমীকরণ ভারত-চীন সম্পর্ককে প্রভাবিত করে। তবে এই সম্পর্কের গতিপথ নির্ধারণ করে নিজস্ব কিছু চালিকা শক্তি। এর কেন্দ্রে রয়েছে চীন ও ভারতের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা এবং এশিয়ায় চীনের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি, যেটা ভারত মানতে নারাজ। চীন বৈশ্বিক পরিসরে বহুমেরুবাদের পক্ষে কথা বললেও এশিয়ার ক্ষেত্রে সেই একই যুক্তি মানে না। ভারতের অবস্থান হলো, বহুমেরুর বিশ্ব মানেই বহুমেরুর এশিয়া।

তিয়ানজিন সম্মেলনেও দুই দেশের মধ্যকার এ পার্থক্য চোখে পড়েছে। নয়াদিল্লি বারবার বলে এসেছে, সীমান্ত সমস্যা সমাধান না হলে অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব কিংবা বৃহত্তর সম্পর্ক স্বাভাবিক করা সম্ভব নয়। বিপরীতে বেইজিংয়ের অবস্থান, সীমান্ত সমস্যা যেন পুরো সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত না করে। সি চিন পিং জোর দিয়ে বলেছেন, ভারত-চীন সম্পর্কের ভিত্তি হওয়া উচিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব।

এর সঙ্গে আছে পাকিস্তান ইস্যুটি। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের ‘লৌহদৃঢ় বন্ধুত্ব’ ভারত-চীন সম্পর্ককে স্থায়ী, শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক করার সম্ভাবনা স্পষ্টভাবে সীমিত করে। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক অনেক দিন ধরেই ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগের সস্তা ও ঝুঁকিহীন কৌশল হিসেবে কাজ করছে। ১৯৮০-এর দশকে পারমাণবিক সহযোগিতা থেকে শুরু করে ধরাবাহিকভাবে পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতা বাড়িয়ে তুলেছে।

এ বছরের গ্রীষ্মে কাশ্মীরে ২৬ জন ভারতীয় পর্যটক হত্যাকাণ্ডের পর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যে স্বল্পকালীন যুদ্ধ হয়, সেখানে পাকিস্তানি বাহিনী চীনা অস্ত্র ব্যবহার করে। এবারই প্রথম বেইজিং সরাসরি পাকিস্তানকে সামরিক অভিযানে সহায়তা দেয়। ভারতের বহুদিনের আশঙ্কা—চীন ও পাকিস্তান দুদিক থেকে যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে পারে। সেটা এখন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।

এ সবকিছুই ভারতকে চীনের প্রতি এমন এক নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য করে, যেখানে শত্রুভাবাপন্নতার মধ্যেও সীমিত সহযোগিতা ও সমন্বয় থাকবে। এশিয়ায় চীনা আধিপত্য প্রতিরোধের সূত্র থেকেই ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের গভীরতাকে ব্যাখ্যা করা যায়। দুই দশকের বেশি সময় ধরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক দল ও জনসাধারণ এ সম্পর্ককে সমর্থন করে যাচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলটি এশিয়ায় আমেরিকার প্রাধান্য বজায় রাখতে প্রণয়ন করা হয়েছে। চীনের প্রভাবকে সীমিত করতে এটি ভারতের জন্য স্বাগত জানানোর মতো একটি সমর্থন। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের কোয়াড জোট; অস্ট্রেলিয়া-যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক সাবমেরিন জোট (অকাস); দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের সঙ্গে শক্তিশালী ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা জোট—এই কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মূল লক্ষ্য হচ্ছে, এশিয়া-প্যাসিফিকে চীনের সম্প্রসারণকে সীমিত করা। এর প্রধান একটি উদ্দেশ্য হলো চীনের তাইওয়ান দখলের চেষ্টা প্রতিহত করা। চীন যদি জবরদস্তি করে তাইওয়ান দখল করতে সক্ষম হয়, তাহলে কৌশলটি সবচেয়ে দৃশ্যমানভাবে ব্যর্থ হবে।

ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ এশিয়ায় অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে। ওয়াশিংটন থেকে পাওয়া কিছু সংকেত এ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর পূর্বসূরিদের তুলনায় তাইওয়ান রক্ষায় কম প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অকাস নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি এখন পুনর্মূল্যায়নের অধীন আছে। এ বছরের শেষ দিকে ভারতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া কোয়াড শীর্ষ সম্মেলনে ট্রাম্প যোগ দেবেন না বলে মনে করা হচ্ছে।

এসব ঘটনার সঙ্গে চীনের সঙ্গে ট্রাম্পের ‘চমৎকার সম্পর্ক’ এবং সি চিন পিংয়ের সঙ্গে একটি ‘বড় চুক্তি’ করার আগ্রহ—সব মিলিয়ে ভারত ও এই অঞ্চলের অন্যান্য আমেরিকান মিত্রর মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। এর কারণ হলো, তারা জি-২ বা যুক্তরাষ্ট্র-চীনের জোট পুনর্জীবনের আশঙ্কা করছে।

২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও তাঁর উপদেষ্টারা জি-২ এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে ‘কৌশলগত প্রতিশ্রুতির’ ধারণা চালু করেছিলেন। কিন্তু চীনের অতিরিক্ত দাবি ও ওবামা প্রশাসনের ‘পিভট টু এশিয়া’ বা এশিয়ায় নোঙর ফেলার ঘোষণার কারণে সেটা কেবল বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন এবং দীর্ঘ অচলাবস্থার পর কোয়াড পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। এখন মনে হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কোয়াড ভেঙে দিতে প্রস্তুত। চলমান ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের টানাপোড়েনের বাইরে এই পরিবর্তনগুলো পুরো অঞ্চলে আরও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চীন বর্তমানে ট্রাম্পের বারবার উত্থাপিত প্রস্তাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। চীনা বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র নিজের ধ্বংস ডেকে আনছে। আর বিনা মূল্যে প্রতিদ্বন্দ্বীকে তার অবস্থান থেকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে চীন তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। এটা নিঃসন্দেহ, ট্রাম্প বিশ্বব্যবস্থায় যে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছেন, তার মূল ভূরাজনৈতিক সুবিধাভোগী চীন।

তিয়ানজিনে চীন দেখিয়েছে যে বড় দেশগুলোকে এক জায়গায় আনার ক্ষমতা তার রয়েছে। গ্লোবাল সাউথ বা বৈশ্বিক দক্ষিণে চীনের নেতৃত্বের দাবি আরও জোরালো হচ্ছে। সি চিন পিং মোদিকে বলেছেন, ভারত ও চীন গ্লোবাল সাউথের অংশ এবং উন্নয়নশীল দেশেগুলোর স্বার্থ রক্ষা করতে তাদের একসঙ্গে কাজ করা উচিত।

মোদি এ বিষয়ে সরাসরি কিছু বলেননি। নীরব থেকে কি মোদি চীনের নেতৃত্বের দাবিকে চ্যালেঞ্জ করছেন? সি পঞ্চশীল ঘোষণার প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন। ১৯৫৪ সালে ভারত ও চীন যৌথভাবে পঞ্চশীল ঘোষণা করেছিল। মোদি এ বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি।

সি ও মোদি একমত হয়েছেন যে চীন ও ভারত প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং অংশীদার। তবে এটিকে বাস্তবতা হিসেবে নয়, বরং আশা হিসেবে নেওয়া উচিত।

* শ্যাম সরণ, ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব
- টাইম ম্যাগাজিন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

তিয়ানজিনে এসসিও সম্মেলনে সি চিন পিং, ভ্লাদিমির পুতিন ও নরেন্দ্র মোদি
তিয়ানজিনে এসসিও সম্মেলনে সি চিন পিং, ভ্লাদিমির পুতিন ও নরেন্দ্র মোদি। ছবি : এএফপি

No comments

Powered by Blogger.